খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের দিন অশ্রুনয়নে মেয়র পদে আরেকবার জনগণের সমর্থন চেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক।
Published : 14 May 2018, 05:19 PM
২০০৮ সাল থেকে পাঁচ বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করে ২০১৩ সালে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির কাছে হেরেছিলেন খালেক। তবে এবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী নজরুল ইসলাম মঞ্জু।
ভোটের আগের দিন সোমবার লোয়ার যশোর রোডের মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যের এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন দক্ষিণাঞ্চলের বর্ষীয়ান এই আওয়ামী লীগ নেতা।
৬৮ বছর বয়সী এই রাজনীতিক বলেন, “আমি পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করে হেরেছি। আমি আর নির্বাচন করব না ভেবেছি। আমার দল, আমার নেত্রী আমাকে ভালো লাগায় (মনোনয়ন) দিয়েছেন। আমি চাই, সারাজীবন এই খুলনার উন্নতি করতে চাই। খুলনার মানুষের সঙ্গে আমার শেষ জীবন আমি থাকতে চাই।”
বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মোংলা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন খালেক; এবারও সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে খুলনার মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
খালেক বলেন, “আপনারা দেখছেন, যে এলাকার সংসদ সদস্য আমি, মোংলা বন্দর এলাকা কত সুন্দর এলাকা। সেই এলাকা ছেড়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন খুলনার উন্নয়নের জন্য। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন, আপনাদের সেবায় যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে পারি।”
মঙ্গলবার রাত পোহালে সিটি করপোরেশনের নতুন জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দেবে খুলনার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন ভোটার।
মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেবেন তারা। এছাড়া ৩১ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের দশটি পদে ৩৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।
দলীয় প্রতীকের এ নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার খালেকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের প্রার্থী মঞ্জু বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক।
নির্দলীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত খুলনা নগরীতে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তালুকদার খালেক।
এরপর ২০১৩ সালেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর মনিরুজ্জামান মনির কাছে হেরে যান খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের এই সভাপতি।
বাড়ি খুলনা শহরে হলেও ১৯৯১ সাল থেকে চারবার মংলা-রামপাল নিয়ে গঠিত বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তালুকদার খালেক।
১৯৯৬ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এই নেতা এবার সেখানকার সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে মেয়র নির্বাচনে লড়ছেন।
মেয়র থাকায় ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাগেরহাট-৩ আসনে প্রার্থী হতে না পারায় তার স্থলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছিলেন তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার।
তালুকদার খালেকের এমন জনপ্রিয়তা এবং রাজনৈতিক দক্ষতার প্রশংসা জুটেছে এবারের নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর কণ্ঠেও।
সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার খালেকের ‘নৈতিক পরাজয় ঘটেছে’ বলে মন্তব্য করলেও তিনি বলেছেন, “খালেক সাহেবের মতো নেতা... কারণ উনি মন্ত্রী ছিলেন, উনি অনেক উন্নয়ন করেছেন এই শহরে, ওনার ভাষায়। ওনার সবকিছু বৃথা গিয়েছে, আমার মতো রাস্তার-রাজপথের কর্মীর কাছে।”
সংবাদ সম্মেলনে তালুকদার খালেক অভিযোগ করেন, পাঁচ বছর ধরে মেয়রের দায়িত্ব পালন করলেও সিটি করপোরেশনে জলাবদ্ধতা নিরসন, রাস্তাঘাট ঠিক করার মতো সেবামূলক কাজ বিএনপির মনি করতে পারেননি।
“আমার এই নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম যেই সমস্যার কথা বলেছি, সেটা হচ্ছে জলাবদ্ধতা দূর করে খুলনার মানুষকে মুক্ত করার জন্য। খুলনার উন্নয়নের জন্য প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। যে কেউ আসুক সেটা বাস্তবায়ন করবে।”
নির্বাচনকে ঘিরে ৩১টি ওয়ার্ডে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলেন, “মানুষ ভোট দিতে যাবে এবং তাদের ভোট প্রয়োগ করে তাদের মেয়র নির্বাচিত করবেন। এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অনেকে বিভিন্ন অভিযোগ করছেন।”
২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কথা তুলে বিএনপি প্রার্থী মঞ্জুর বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর ছোড়েন তালুকদার খালেক।
সেবার মেয়র প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক হিসেবেও মঞ্জু নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবারের মতোই অভিযোগ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত এসব কথা বলেছেন। ভোটে তো আপনারা দেখেছেন, আমি হাজার কোটি টাকা এনে কাজ করানোর পরেও হেরেছি; অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কারণে। তখনও আমার দল ক্ষমতায় ছিল। তখন কারচুপি হয় নাই।”
বিএনপিকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের ‘হোতা’ আখ্যায়িত করে তালুকদার খালেক বলেন, “আমার আহ্বান থাকবে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীদের গ্রেপ্তার করে ভোটের সুন্দর পরিবেশ তৈরি করার জন্য।”
ভোট কারচুপির চক্রান্ত চলছে বলে বিএনপির অভিযোগের পাল্টায় তিনি বলেন, “ভোট হইল আগামীকাল, এখন কীভাবে বলে মারামারি হবে! এটা হল একটি দুরভিসন্ধি তাদের। ওনারা বলছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং হবে। আওয়ামী লীগ কখনও ইঞ্জিনিয়ারিং করে না।”
গণগ্রেপ্তারের অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নে তালুকদার খালেক বলেন, “আপনারা থানায় খোঁজ নিন, কাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের নামে কোনো মামলা আছে কি না, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কি না।
“একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গেলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও অবৈধ অস্ত্রধারী যেন শহরে যেন না থাকতে পারে, সেটা নির্বাচনের শর্ত। সেটা যদি নির্বাচন কমিশন করে এক্ষেত্রে কারও আপত্তি থাকা উচিত না।”
আওয়ামী লীগেরও ‘অনেককে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করলেও তার পরিসংখ্যান দিতে পারেননি তালুকদার খালেক।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহসীন হল শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হওয়ায় তার আগে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
নির্বাচন পরিচালনায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিও বি এল কলেজে ইসলামী ছাত্রশিবির করতেন বলে দাবি খালেকের।
তিনি বলেন, “একজন অফিসার হিসাবে যে বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারে না, এখনও পুরনো সংগঠনের সাথে জড়িত, তাদের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। তারপরও নির্বাচন কমিশন তাদেরকে এখানে দায়িত্ব দিয়েছেন।
“আমরা আপত্তি দিয়ে রাখছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরায় নাই। তারপরেও আমরা কিন্তু বলি নাই।
“আমরা বলছি, ঠিক আছে, তারা যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে পারে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। কারণ তারা তো একা না, এখানে সরকার আছে, নির্বাচন কমিশন আছে, তারা উনাদের উপর নজর রাখে।”