জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ওই ট্রাস্টে এতিমদের জন্য আসা একটি টাকাও তছরুপ বা অপচয় করা হয়নি, তা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে।
Published : 19 Oct 2017, 03:02 PM
বিচারাধীন এই মামলা নিয়ে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ’ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরার পরদিন বৃহস্পতিবার ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট ও এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন নেন খালেদা।
পরে বিচারক মো. আখতারুজ্জামান এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা খালেদার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানি শুরু করেন।
আত্মপক্ষ সমর্থনে বেলা সোয়া ১২টা থেকে এক ঘণ্টা লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া।
এরপর তিনি পরবর্তী সময়ে বাকি বক্তব্য শেষ করার অনুমতি চাইলে আদালত তা মঞ্জুর করে ২৬ অক্টোবর শুনানির পরবর্তী দিন ঠিক করে দেন। জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলাও একই দিনে আদালতে আসবে।
এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক।
তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ অভিযোগ গঠন করে খালেদাসহ ছয় আসামির বিচার শুরু করেন।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এ মামলায় খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা ছিল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি। কিন্তু দফায় দফায় তার আইনজীবীদের সময়ের আবেদন ও বিচারকের প্রতি অনাস্থার আবেদনে তা পিছিয়ে যায়।
“প্রতিটি পয়সা গচ্ছিত রয়েছে। ব্যাংকের সুদ যুক্ত হয়ে সেই টাকা এখন অনেক বেড়েছে। একটি টাকাও তছরুপ বা অপচয় করা হয়নি।”
নিজেকে নির্দোষ দাবি করার পাশাপাশি খালেদা তার ছেলে মুদ্রা পাচার মামলায় সাত বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানকেও নির্দোষ দাবি করেন।
ঘুষ হিসেবে আদায়ের পর ২০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে করা ওই মামলায় ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মো. মোতাহার হোসেন ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর তারেককে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দুদকের আপিলে হাই কোর্ট গতবছর ২১ জুলাই বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকার অর্থদণ্ড দেয়।
পরিবার নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তারেক রহমানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টাসহ দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানীর অভিযোগে কয়েক ডজন মামলা রয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, “তারেক রহমানকে মুদ্রা পাচারের একটি মামলার বানোয়াট অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন একটি আদালত। সেই বিচারককে শাসক মহল হেনস্তা এবং হয়রানির উদ্দেশ্যে এমন তৎপরতা শুরু করে যে তিনি আত্মরক্ষার জন্য বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেই বিচারক নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এসব ঘটনা অহরহই ঘটছে।”
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে শাসক মহলের ‘বিরোধ’ সম্প্রতি প্রায় প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে মন্তব্য করে খালেদা বলেন, “মাননীয় প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি প্রকাশ্যেই বলেছেন যে বিচার বিভাগের হাত-পা বাঁধা। তিনি আরও বলেছেন- ‘বিচারকগণ স্বাধীন নন’। এসব কারণে আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে কিনা, তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।”
জিয়া এতিমখানা ও দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচার কেন আদালত পাড়ার বাইরে আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে বিশেষ এজলাসে হচ্ছে - সেই প্রশ্নও তোলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
বিচারককে তিনি বলেন, “মাননীয় আদালত, আপনি কোথায় বসে এ মামলার বিচার কাজ পরিচালনা করছেন? কোথায় বসে? এটা কি বিচারের কোনো প্রাঙ্গণ? এটা কি কোর্ট কাচারির কোনো এলাকা? এই মাদ্রাসা প্রাঙ্গণের সঙ্গে বিচার বিভাগ ও কোর্ট কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক আছে কি?
“ফখরুদ্দীন (২০০৭-২০০৮ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ) ও মঈনুদ্দিনের (তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ) অবৈধ সরকার যেমন গণতন্ত্র, সংসদ ও জনপ্রতিনিধিদের অসন্মান, অপমান ও হেয় করার উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের এজলাস বসিয়েছিল, আজও কি দেশে তারই ধারাবাহিকতা চলছে?”
খালেদা জিয়া বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের পর পিলখানা হত্যা মামলার বিচারের জন্য আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে বিশেষ জজ আদালতের এই এজলাস বসানো হয়েছিল।
“খুন, ধর্ষণ, শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিচারের আয়োজন এখানে করা হয়েছে। এ এজলাসে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার কেন?”
এরপর বিচারকের উদ্দেশে খালেদা বলতে থাকেন, “এখানে বিচারের এ সিদ্ধান্ত আপনি নিজে নেননি । কোথায় বসে আমার বিরুদ্ধে মামলার বিচারকাজ পরিচালিত হবে সেটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে শাসক মহলের অভিপ্রায় ও ইচ্ছা জড়িত।
“ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য- এর মাধ্যমে বিচারের নামে আমাকে জনসম্মুখে হেয় করা, অপমান করা। এটাও বিচার প্রক্রিয়ায় এক ধরনের হস্তক্ষেপ।”
তিনি বলেন, “এর প্রতিকার চাইব কোথায়? বিচার প্রভাবিত করা এবং বিচারাধীন বিষয়ে বল্গাহীন মন্তব্য করা হচ্ছে।”
এসব মামলা নিয়ে সংবাদপত্রে আসা খবর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য উদ্ধৃত করে খালেদা জিয়া বলেন, “‘এতিমদের টাকা মেরেছেন, আবার আদালতে একদিন আসেন তো দশদিন যান না’- প্রধানমন্ত্রীর ওই উক্তি কি বিচারবিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়?”
আত্মপক্ষ সমর্থনে দাঁড়িয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা বলতে থাকেন, “বিচারাধীন মামলা নিয়ে প্রকাশ্যে মানহানিকর কদর্য জঘন্য উক্তির আমি কি জবাব দেব? তার বিরুদ্ধেও তো দুর্নীতি ও আত্মসাতের মামলা ছিল। তার নিকট আত্মীয় শেখ সেলিম এবং তার দল আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে সেসব দুর্নীতির কথা অনর্গল বলেছিলেন…।
বিচারক আখতারুজ্জামান এ সময় খালেদা জিয়াকে বলেন, “ম্যাডাম, এসব নাম না বলে বক্তব্য দেওয়া যায় না?”
খালেদা তখন বলেন, “এসব স্মৃতি এখনও মুখে মুখে রয়েছে। ইউটিউবে সে সবের ভিডিও রয়েছে। অথচ সেসব দুর্নীতি মামলা একে একে সব প্রত্যাহার করা হয়েছে।”
খালেদার পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার, আবদুর রেজাক খান, এ জে মোহাম্মদ আলী ও সানাউল্লাহ মিয়া। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।
এতিমখানা দুর্নীতি মামলার আসামিদের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে এবং মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ কারাগারে আছেন। খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান আছেন লন্ডনে।
আর সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক।