“আদৌ গণপরিষদের প্রয়োজন আছে কি না, সেজন্য জাতীয় নির্বাচনের সময় আলাদা ব্যালটে মতামত নেওয়া যেতে পারে,” বলেন অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ।
Published : 20 Mar 2025, 01:55 AM
বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া জুলাই অভ্যুত্থানের সাত মাস পরেও দেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে সংস্কার উদ্যোগ এবং জাতীয় নির্বাচনের দাবির মধ্যে।
অবশ্য, রাজনৈতিক পরিসরে নতুন মাত্রা যোগ করেছে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের সারিতে থাকা শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির গণপরিষদ নির্বাচন দাবি।
সংসদ নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন এক সঙ্গে হতে পারে বলেও মনে করছে দলটি। তবে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়ার বড় অংশীদার বিএনপির অবস্থান গণপরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে।
প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করা বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচিত সংসদই বাকি সংস্কার করবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, না কি স্থানীয় সরকার নির্বাচন- কোনটি আগে হবে, তা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় উঠে এসেছে গণপরিষদ নির্বাচন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনকে’ চিরতরে বিদায় করার সুযোগ এসেছে বলে মনে করছে ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার।
সেই লক্ষ্যে গত অক্টোবরে প্রথম ধাপে সংবিধান, পুলিশ, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে ছয়টি কমিশন করা হয়, যাদের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
যেভাবে আলোচনায় এল গণপরিষদ
অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিসরে বিচ্ছিন্নভাবে ‘গণপরিষদ’ ও ‘সংবিধানসভা’ নির্বাচন আলোচনায় আসে।
গত ডিসেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবি তুলে বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘কবর দেওয়ার’ কথা বলা হয়।
পরে নতুন দল এনসিপির ঘোষণপত্রে নতুন সংবিধান প্রণয়নে ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ লক্ষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দলের আত্মপ্রকাশ মঞ্চ থেকে এই ঘোষণাপত্র তুলে ধরেন উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দলটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, “আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।”
চলতি মাসে এনসিপির ইফতারে দলের উদ্দেশ্য তুলে ধরে নাহিদ বলেন, দেশে একসঙ্গেই সংসদ ও গণপরিষদ নির্বাচন ‘সম্ভব’।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেওয়ার পর নাহিদ এ বিষয়ে আবারও কথা বলেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রের সংস্কার গণপরিষদের মাধ্যমে না হলে তা ‘টেকসই হবে না’ বলে তিনি মনে করেন।
গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকার হটানোর এক দফা দাবি তুলে ধরেছিল গত ৪ অগাস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে।
সেই এক দফা ঘোষণা করে নাহিদ ইসলাম ‘ছাত্র নাগরিক অভ্যুত্থানের’ জন্য নাগরিক ছাত্রসংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে মিলে ‘সম্মিলিত মোর্চার’ ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা খুব শিগগিরই হাজির করব।”
এর ধারাবাহিকতায় নতুন রাজনৈতিক ‘বন্দোবস্ত’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে গঠিত এনসিপি নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলছে।
দলের ইফতার আয়োজনে বিষয়টি আরও খোলসা করে নাহিদ বলেন, “শাসন কাঠামোর মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা দেশের সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি স্থাপন করতে চাই।
“তাই একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে একটি নতুন রিপাবলিকের কথা আমরা বলছি। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।”
গণপরিষদ নির্বাচনের পক্ষে বলেছেন শিক্ষার্থীদের সমর্থন দেওয়া কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারও।
সম্প্রতি যশোরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “একাত্তর পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান জনঅভিপ্রায় বাস্তবায়ন করেননি। তাছাড়া গণপরিষদ ভোটও হয়নি। ফলে রাষ্ট্র গঠন করাও সম্ভব হয়নি। অথচ রাষ্ট্র গঠনে গণপরিষদ ভোট স্বীকৃত পদ্ধতি।”
বাহাত্তরের সংবিধান ‘কখনো বাংলাদেশের জনগণের সংবিধান ছিল না’ মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার, যার স্ত্রী ফরিদা আখতার অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, “এটা ছিল পাকিস্তানের সংবিধান। কারণ, সেটা যারা প্রণয়ন করেছেন, তারা পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
“তারা যুদ্ধের সময় ছিলেন না। যে কয়েকজন ছিলেন, তারা দিল্লির সাথে সহযোগিতা করে বাংলাদেশকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন।”
ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনীতির মাঠে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা জামায়াতে ইসলামীও বাহাত্তরের সংবিধানের কঠোর সমালোচক। দলটির আমির শফিকুর রহমানের ভাষায়, “এ সংবিধান ভারতে বসে রচিত হয়েছিল।”
গত অক্টোবরে জামায়াতে ইসলামীর তরফে ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ তুলে ধরার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে দলটির আমির বলেছিলেন, “এটায় অনেক পক্ষ অনেক কনসার্ন এক্সপ্রেস করেছে। পরবর্তীতে এসে আবার অনেক সংশোধনী এসেছে। এবং এই সংশোধনীগুলো তারা যেটা প্রথম সংবিধান করেছিল, ওই জায়গায়ও থাকেনি।”
সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন প্রশ্নে এনসিপি ও জামায়াতের অবস্থান প্রায় এক হলেও কয়েক দফায় দেশের শাসনভার সামলানো বিএনপি গণপরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে।
দলটির নেতারা মনে করেন, এই দাবির মধ্য দিয়ে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া আরও ‘বিলম্বিত’ হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই নির্বাচন কেন? কেন সেকেন্ড পাবলিক। বাংলাদেশ তো আছেই।
“যারা গণপরিষদ নির্বাচন চান, গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান চান আমি তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, আসুন সবাই মিলে একটি শক্তিশালী একটি জাতীয় সংসদ বিনির্মাণ করি, যেখানে সকল সংস্কার প্রস্তাব আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হবে এবং সেই সংবিধানকে আপনারা নতুন সংবিধান হিসেবে বা সেকেন্ড রিপাবলিক হিসেবে যে নামে অভিহিত করুন না কেন আমাদের কোনো আপত্তি নাই।”
সালাহ উদ্দিন মনে করেন, এখন গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি সামনে আনা মানেই হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের যে প্রক্রিয়া তারা চাইছেন, তা ‘দীর্ঘায়িত’ করা।
দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবিরও। গত জানুয়ারিতে তারা নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবির পাশাপাশি বাহাত্তরের সংবিধানের পক্ষেও অবস্থান জানিয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে সিপিবি সভাপতি বলেন, “দেশে আজ সাম্প্রদায়িক শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠী ৭২ এর সংবিধানকে কবর দেওয়ার কথা বলছে। তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খেলা করতে চাচ্ছে। তাদের এই খেলা দেশের জনগণ মেনে নেবে না।”
গত ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণসহ সময়ে সময়ে বেশ কিছু দাবি অভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছিল।
তবে বিএনপির সায় না পাওয়ায় এসব দাবি আলোর মুখ দেখেনি। যদিও আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসের দায়ে’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গণপরিষদ কী?
গণপরিষদ হচ্ছে কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত সভা, যারা কোনো দেশের সংবিধান বা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কিংবা সংস্কার করেন।
গণপরিষদ বা সংবিধান সভার (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) সদস্যরা সাধারণত জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। পরাধীন উপনিবেশে সংবিধান সভার সদস্যদের নিয়োগ করে সরকার। কিংবা অন্য উপায়ে তাদের বাছাই করা হতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংবিধান সভার নির্বাচন হয়নি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান সভা, যাকে গণপরিষদ নাম দেওয়া হয়েছিল।
প্রায় ১৬ বছর আগে নেপালে রাজতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক উত্তরণে সংবিধান সভা নির্বাচনের নজির রয়েছে।
গণপরিষদ এখন কতটা প্রয়োজন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকলেও অনেকেই জানেন না গণপরিষদ কি?
বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে টুপি ও আতর বিক্রি করেন সলিম উদ্দিন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গণপরিষদের নাম তিনি শোনেনি। তার ভাষায়, “এইডা আবার কি?” জরুরি নির্বাচন বলতে তিনি সংসদ নির্বাচনকেই বোঝেন।
গণপরিষদ নিয়ে সংসদ বিষয়ক গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন গণপরিষদ কেন প্রয়োজন পড়ছে? এর কোনো প্রয়োজন নেই।”
তিনি বলেন, “সংবিধান কীভাবে পরিবর্তন করা হবে সে বিষয়ে বতর্মান সংবিধানেই বলা আছে। কাজেই সংবিধান পরিবর্তন, সংশোধনের জন্য গণপরিষদ কোনোভাবেই বাধ্যতামূলক কিছু নয়, এর প্রয়োজন নেই। সংসদই যথেষ্ট।”
তবে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের দাবির কথা তুলে ধরে নিজাম উদ্দিন বলেন, “আমি মনে করি- আদৌ গণপরিষদের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের সময় আলাদা ব্যালটে মতামত নেওয়া যেতে পারে।
“আপনি কি মনে করেন সংবিধান পরিবর্তনের জন্য গণপরিষদ প্রয়োজন? আরও যদি বলতে চান- হ্যাঁ হলে এ সংসদ গণপরিষদ হিসেবে কাজ করবে কি না? হ্যাঁ বা না বলেন।
“এটা আইন পরিষদ এবং গণপরিষদ দুটো হিসেবে কাজ করতে পারবে।”
সংবিধান পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন হবে না, এমন কথা অসাংবিধানিক বলে মনে করেন তিনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে ‘এক অর্থে’ সাংবিধানিক সরকার আছে মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, “আদালতের মতামতও নিয়েছে। পরে প্রত্যেকটা সদস্য সংবিধানসম্মতভাবে শপথ গ্রহণ করে দায়িত্ব পালন করছেন। সবকিছু সংবিধান সম্মতভাবে করা আছে। তাই সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করার রাস্তা এখানে নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহবুবর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো কি চায় সেটা খেয়াল করতে হবে। যদি তারা কিছু বিষয়ে সংস্কার চায় সেক্ষেত্রে অধ্যাদেশ দিয়ে বাস্তবায়ন করা যায়। পরবর্তীতে সংসদে তা পাস করে নিতে হবে।”
অথবা সংসদ ভোটের সময় একটা গণভোট নেওয়া যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
এ শিক্ষক বলেন, “সংস্কার প্রশ্নে সংবিধানের ব্যাপারে (গণপরিষদ হবে, অধ্যাদেশ হবে নাকি গণভোট হবে) কোন ধরনের পদক্ষেপ নেবেন তা নির্ভর করবে আপনি কী করতে চান তার ওপর।
“এখন একটা পক্ষ নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলছে। নতুন সংবিধান তৈরি করতে চাইলে তো গণপরিষদের প্রক্রিয়া ছাড়া কঠিন। নতুন সংবিধান হলে গণপরিষদে যেতে হবে।
“আর কিছু কিছু বিষয়ে সংস্কার করতে চাইলে আগেও অধ্যাদেশ জারি করে সংস্কার আমরা করেছি। পরবর্তীতে সংসদ এগুলো পাস করিয়ে নিয়েছি। সেটা করা যেতে পারে যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়।”
বাংলাদেশের ইতিহাস ‘মুক্তিযুদ্ধের স্তম্ভের উপর’ দাঁড়িয়ে আছে মন্তব্য করে রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেই স্তম্ভের পরিবর্তন বা বাতিল হয়েছে এমন কিছু ঘটেনি। এখন গণপরিষদের বিষয়টি আমার কাছে মনে হয় প্রয়োজনীয় নয়।”
গণপরিষদের এখনকার ধারণা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও তিনি মনে করেন।
পাকিস্তান আমলের গণপরিষদ প্রক্রিয়ার বিষয়টি তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, “গণপরিষদের বিষয়টি আমার কাছে মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার মত। কারণ যে মুক্তিযদ্ধের ভিত্তি ছিল গণপরিষদের জায়গা, যারা মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতাকে মানতে পারছে না, তারা কিন্তু গণপরিষদের মাধ্যমে আবার নতুন করে দেশকে দেখার চিন্তা করতে পারে।”
এ রাজনীতি বিশ্লেষকের ভাষ্য, “সংবিধান সংস্কার হতে পারে, এর মাধ্যমে কিছু পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন হতে পারে। কিন্তু সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন একেবারে ভিন্ন বিষয়।“
সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন ও সংস্কার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং নির্বাচিত সরকার ছাড়া ‘সম্ভব নয়’ মন্তব্য করে তিনি জনগণের সমর্থনের বিষয়টি সামনে আনেন।
“মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সব কিছুকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধানের বিষয়টি আসে। সব কিছুকে অস্বীকার করলে গণপরিষদ, নতুন সংবিধান- একটার সঙ্গে একটা জড়িত। তাহলে ইতিহাস অস্বীকার করতে হবে,” বলেন তিনি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, সংবিধান নতুন করে লেখার দাবি অবাস্তব কিছু নয়। প্রতিবছরই বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে এটা হচ্ছে। সংবিধান হচ্ছে, নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক দলিল।
একটি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, নতুন সংবিধান প্রণয়ন হলে তার বৈধতার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের প্রয়োজন।
“গণপরিষদ ও সংসদ একসঙ্গে থাকলে সেই সংসদ গণপরিষদের কাজ কিছুটা করবে আবার পাশাপাশি দেশ শাসন করবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের কাছে গিয়ে সেটা মানুষকে বোঝানো।”
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভ্যুত্থানের পর মানুষ দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতির মাধ্যমে যে আকাঙ্ক্ষার কথা লিখে গেছেন তা পূরণের জন্য সংবিধান সংস্কার, গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন।
“অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রয়োজন। আমরা একমত হতে না পারলে জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।”
‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’
১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ আদেশ জারি করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত মোট সদস্য ছিলেন ৪৬৯ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেন এবং কয়েকজন অযোগ্য ঘোষিত হন। ফলে ৪০৪ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। পরদিন ৩৪ জন সদস্য সমন্বয়ে ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।
গণপরিষদের বিবেচনার জন্য ১২ অক্টোবর সংবিধান বিল উত্থাপন করা হয়। খসড়া সংবিধানের প্রথম পাঠ শুরু হয় ১৯ অক্টোবর এবং ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
দ্বিতীয় পাঠ চলে ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। তৃতীয় পাঠ শুরু হয় ৪ নভেম্বর এবং ৬৫টি সংশোধনীসহ তা অনুমোদন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হয়।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারপারসন অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ মনে করেন, স্বাধীনতার পরপরই যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেটা ছিল ‘জোড়তালির গণপরিষদ’। এটা নিয়ে বিতর্ক গোড়া থেকেই রয়ে গেছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময়ও আরেকটা গণপরিষদ নির্বাচন করা যেত বলে অনেকে বলেছেন তখন। এখন নতুন করে সংবিধান নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে।
নেপালের উদাহরণ দিয়ে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, “আমাদের এখানে এখন সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। সবাই একমত হতে পারলে গণপরিষদ, সংবিধান এবং সেই অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। ঐকমত্য হলে যে কোনো প্রক্রিয়ায় এসব হতে পারে।”
ভারত ও পাকিস্তানের গণপরিষদের বিষয়টি তুলে ধরে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনকার বাস্তবতায় এই দুটি অভিজ্ঞতা থেকে একটা নতুন সমাধান বের করা সম্ভব।
গণপরিষদ করেই সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারে দলগুলো। এতে আইনি কোনো সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে কোনো কোনো পয়েন্টে একমত হতেই হবে।”
‘নেপালের সংবিধান সভা’
নেপালে রাজতন্ত্র বিলোপের পর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ২০০৮ সালের ১০ এপ্রিল সংবিধান সভার নির্বাচন হয়েছিল। একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এবং ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার গঠনপ্রক্রিয়া ঠিক করাই ছিল নেপালের সংবিধান সভার মেন্ডেট। দুই মেয়াদে চার বছরে নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর নেপালের সংবিধান সভা বিলুপ্ত হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে কী আছে?
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি সংবিধানের সংস্কারে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মত সুপারিশ রয়েছে।
১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন তুলে দেওয়ার পর কমিশন প্রধান আলী রীয়াজ বলেছিলেন, “১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।”
বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রয়েছে।
সেই মূলনীতির আলোকে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ করাকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে সংবিধানে।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশও করেছে কমিশন।
গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের বিতর্কের বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, “গণপরিষদের অপশনটা আমরা রেখেছি; এর আগে শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হতে হবে।
“যখন এই বিষয়ে এক ধরনের ঐকমত্য হবে, তখন গণভোটের মাধ্যমে হতে পারে, গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে হতে পারে, একই সঙ্গে গণপরিষদ ও সংসদের মাধ্যমে হতে পারে। সেজন্য আমরা বলছি, আগে রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে পরে প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
“গণপরিষদ নির্বাচনের কথা এনসিপি বলেছে। অনেকে আবার বলছেন দ্রুততার সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন এবং তার মাধ্যমে সংস্কার। সেটাও অপশন হিসাবে আমরা লিখে রেখেছি।”
বিতর্কে যেতে চায় না নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে এর আগে যেহেতু কখনও গণপরিষদ নির্বাচন হয়নি, তাই এর আইনি কাঠামো সম্পর্কে এখন কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
“সংবিধানের ১১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে এখন যা আছে, এর সঙ্গে গণপরিষদ নির্বাচন যুক্ত করা যেতে পারে। অথবা সরকার যদি গণপরিষদ নির্বাচন নামে কোনো আইন করে সেই আইনে কমিশনকে ক্ষমতা অর্পণ করলে এই নির্বাচনটা হতে পারে।”
গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, “কমিশন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কোনো রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে যেতে পারবে না ইসি।”
৪ মার্চ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, “সরকারপ্রধান যেখানে একটি টাইমফ্রেম ঘোষণা করেছেন, ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারির শুরুর দিকে, আমরা ডিসেম্বর ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের চিন্তাভাবনা জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই।”
এনসিপির জাতীয় ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে করার দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কথা বলে। আমরা তো রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে যেতে পারব না। আমরা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী।”
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সুমন মাহমুদ]