আদানির সঙ্গে চুক্তির ভাগ ‘কে পাচ্ছে’, পদযাত্রায় বিএনপির প্রশ্ন

“ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে তাকে (আদানিকে)… বিদ্যুৎ দিক বা না দিক। আরে ভাই শ্বশুর বাড়ি আরকি, যেমনি খুশি তেমনি নিয়া যাইব’, বলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2023, 01:57 PM
Updated : 17 Feb 2023, 01:57 PM

ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার যে চুক্তি সরকার করেছে, তাতে ‘দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে’ বলে মনে করে বিএনপি; এই চুক্তির ‘ভাগ কে কে পাচ্ছে’, সে প্রশ্নও তুলেছে দলটি।

উন্নয়নের কথা বলে আওয়ামী লীগ ‘বর্গিদের মত দেশ লুট’ করছে বলে অভিযোগ করেছে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা দলটি।

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১০ দফা এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস-দ্রব্যমূল্য কমানোর দাবিতে ‘যুগপৎ আন্দোলনের’ অংশ হিসেবে শুক্রবার বিকালে রাজধানীর গোপীবাগে ‘নীরব পদযাত্রা’ কর্মসূচির আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপির নেতারা এসব কথা বলেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “আজকে বিদ্যুতের কি অবস্থা! আমি প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাই  না। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে কিছু লুটেরার সঙ্গে আঁতাত করে একটা সরকার কীভাবে একটা দেশকে লুট করতে পারে, তার একটা প্রমাণ ওই আদানি নাকি প্যাদানি একটা আছে।

“শুনছেন না, ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে তাকে। এক লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা ২৫ বছরে। বিদ্যুৎ দিক বা না দিক। আরে ভাই শ্বশুর বাড়ি আরকি, যেমনি খুশি তেমনি নিয়া যাইব।

“কার সঙ্গে এই চুক্তি করেছে? ভারতীয় সরকারের সঙ্গে নয়, একজন সাধারণ বাটপারের সঙ্গে এই কাজটা করল।”

২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ ও আদানি পাওয়ারের মধ্যে একটি ক্রয় চুক্তি হয়। চুক্তির আওতায় আদানি ঝাড়খণ্ডে ১৬০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে।

ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আগামী মার্চ নাগাদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ পাবে বলে গত মাসের শুরুতে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ২৫ বছরের মেয়াদে এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হবে।

তবে বিদ্যুৎ আসার আগে আগে কয়লার দাম নিয়ে শুরু হয়েছে মতবিরোধ। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আদানি পাওয়ারকে চিঠি লিখে বলেছে, আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম নির্ধারণ করেছে ৪০০ ডলার, যা আন্তর্জাতিক বাজার দরের তুলনায় বেশ বেশি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম টন প্রতি ২৫০ মার্কিন ডলারের মত। সুতরাং চুক্তির কয়লার দাম পুনর্বিবেচনা করা দরকার।

কয়লার দাম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মির্জা আব্বাসও। তিনি বলেন, “তার (আদানি গ্রুপ) ইন্দোনেশিয়ায় কয়লার খনি আছে। সেই কয়লার খনিতে কয়লার দাম হল দুইশ টাকা। বাংলাদেশের এই বিদ্যুতের জন্য কিনতে হবে চারশ টাকা দিয়ে। বাকি টাকা কোথায় গেল? কে কে ভাগ করছে? এই ভাগ কে কে পাচ্ছে আমরা জানতে চাই না।

“শুধু বলতে চাই, ভর্তুকির টাকা দেবেন না বলেছেন না? ওই টাকা থেকে ভর্তুকির টাকা দিন। চুরি করে দেশ সয়লাব করে দেবেন, দেশটা শেষ করে দেবেন আর আমাদেরকে বলবেন, ভর্তুকি দিতে হবে?”

আব্বাস বলেন, “কার টাকা কে ভর্তুকি দেয়? আমরা বলতে চাই, এই সরকার থাকা অবস্থায় মানুষের মুখে হাসি ফুটবে না, এদেশে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে চাই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, চাই আমার নেতা তারেক রহমানকে, চাই বিএনপিকে।”

এদিন রাজধানীতে বিএনপির দুইটি পদযাত্রা হয়। মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে গোপীবাগ ওয়াক্তিয়া মসজিদের সামনের সমাবেশ করে বিকাল ৪টায় শুরু হয় একটি যাত্রা। মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হল, টিকাটুলী, দয়াগঞ্জ, ধোলাইখাল মোড়, রায়সা বাজার মোড় হয়ে নয়াবাজারে নবাব ইউসুফ মার্কেট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সেটি শেষ হয়।

মহানগর উত্তরের উদ্যোগে অপর পদযাত্রাটি হয় উত্তরার কবি জসিম উদ্দিন সড়ক থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার পথে। এতে নেতৃত্ব দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। দুইটি কর্মসূচিতেই বিএনপির পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতা-কর্মী অংশ নেয়।

যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে একই সময়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) কারওরান বাজার থেকে এবং গণফোরাম-পিপলস পার্টি মতিঝিলের ইডেন কমপ্লেক্সের সামনে থেকে পদযাত্রা করে।

২০ দলের সাবেক শরিকদের জোট ‘সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট’ সকালে বিজয়নগরের আল-রাজি কমপ্লেক্সের সামনে থেকে এবং ‘পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট’ পুরানা পল্টন থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব পর্যন্ত কর্মসূচিটি পালন করে।

‘আওয়ামী লীগ বর্গির দল’

অষ্টাদশ শতকে ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদল বাংলায় যে লুটতরাজ চালিয়েছিল, তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সেই সেনাদল ‘বর্গি’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল এবং তাদের সেই অভিযানের কারণেই বাংলা অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে ধারণা করা হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বর্গিরা আগে যেভাবে আসত … আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই বর্গীর দল। যখনই তারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে সব লুট করে নিয়ে চলে যায়। এটা আর আমরা হতে দিতে পারি না।”

তিনি বলেন, “আজকে এমন চুরি করেছেন যে, এখন ব্যাংকে টাকা নাই। ডলার নাই। এলসি খুলতে পারে না, জিনিসপত্র আনতে পারে না। চুরির একটা সীমা আছে এরা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।”

ফরিদপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ, সেটি নিয়েও কথা বলেন বিএনপি নেতা। বলেন, “আজকের পত্রিকায় বেরিয়েছে ফরিদপুরের ওদের পাচারের ঘটনা। সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন না আরও অনেকে আছে জড়িত, তাদের আত্বীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই।

“এ গণলুট তো গণলুট। এখানে মনে হচ্ছে যে, খুলে দিয়েছে সব নিয়ে ওরা চলে যাবে। এই অবস্থার সমাপ্তি ঘটাতে জনগণের সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকারের পতন ঘটানো হবে।”

এই বিএনপি নেতা বলেন, “আমাদের সোজা কথা। অনেক ক্ষতি করেছেন আমাদের। এদেশের যে স্বপ্ন ছিল, যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সব কিছুকে ভেঙে ধূলিস্যাত করে দিয়েছে। মাত্র তারা তাদের পরিবার, তারা তাদের লোকজনকে ফুঁলে-ফেঁপে কলাগাছ করে তাদেরকে বিদেশে টাকা পাচার করে দিয়ে তারা আজকে এই বাংলাদেশকে শেষ করে ফেলেছে।

“আমরা আমাদের হিস্যা চাই। খুব বলেন, উন্নয়ন উন্নয়ন। উন্নয়ন কোথায়? উন্নয়ন আপনাদের সঙ্গে। সাধারণ মানুষের কাছে উন্নয়ন নাই। সাধারণ মানুষের দিকে তাঁকিয়ে দেখুন কী অবস্থা সাধারণ মানুষের?

“আজকে আমাদের একটাই কথা। দুই কথা, তিন কথা, চার কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার নাই। এই মুহূর্তে চাই পদত্যাগ, এই মুহূর্তে চাই পদত্যাগ।পদত্যাগ করুন, দেশের মানুষকে বাঁচতে দিন। অন্যথায় দেশের মানুষই তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”

‘কথা শুনে ঘোড়াও হাসে’

বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে দলের অবস্থান আবার তুলে ধরেন ফখরুল। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে ‘নিশ্চয়তা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়ে যাচ্ছেন, তা ‘হাস্যকর’।

তিনি বলেন, “ঢাকার লোক আপনারা, ঘোড়াও যে হাসে জানেন তো? কখন হাসে জানেন? যখন ওই ধরনের কথা শুনতে পায়, যে বিদেশি আসছে সেখানে বলতেছেন প্রধানমন্ত্রী যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকারের অধীনে খুব ভালো নির্বাচন হবে, সবাই অবাধে ভোট দিতে পারবে। ঘোড়াও হাসতে শুরু করেছে এই কথা শুনে।

“আমরা স্পষ্ট ভাষায় আজকে বলতে চাই, সেই নির্বাচনে বিএনপি, বাংলাদেশের মানুষ যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিনই সেই নির্বাচন মেনে নেবে না, যে নির্বাচনে কেউ ভোট দিতে যাবে না, যে নির্বাচনে সে তার ভোট প্রদান করতে পারবে না। আমাদের প্রধান (প্রয়াত শফিউল আলম প্রধান) সাহেবের কথায় বলতে হয় ‘কুত্তা মার্কা নির্বাচনে বিএনপি আর যাবে না, দেশে মানুষ যাবে না’।”

ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপির পদযাত্রায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে দাবি করে ফখরুল বলেন, “আজকে সত্যিকার অর্থেই এই সরকারের পদত্যাগের দাবি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

“এখনও সময় আছে পদত্যাগ করুন, পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করুন এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় তখন জনগণ আপনাদেরকে সেই সুযোগ দেবে না।”

‘এই সংবিধানে চলবে না’

মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া নিয়েও কথা বলেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, “এই যে রাষ্ট্রপতি বলে একজন নির্বাচন করেছে, আমরা কিছু জানি? কেউ কিছু জানে? উনি (নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি) নিজেও জানতেন না। টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে উনি বলেছেন, ‘আমি নিজেও জানতাম না’।

“এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনই প্রমাণ করে যে, সংবিধান যেটা আছে এই সংবিধান দিয়ে এদেশের সমস্যার এখন সমাধান হবে না। এজন্য এই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। অবশ্যই আমরা যে ২৭ দফা দিয়েছে সেই ২৭ দফার মধ্যে আমরা এই সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছি। আমরা বলেছি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, মন্ত্রীদের ক্ষমতা-এইগুলো সমস্ত ভারসাম্য আনতে হবে এবং সকল মানুষের অংশ থাকে সেই ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাকে কীভাবে স্থায়ী করা যায় তার চিন্তা করতে হবে।”

‘গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়া আনন্দের কথা না’

আওয়ামী লীগের ‘ব্যর্থতায়’ দেশটা ‘অকার্য্কর রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, “কোথাও কোনো সফলতা নেই। আজকে দেখুন গণতান্ত্রিক সম্মেলন হচ্ছে আমেরিকাতে। সেখানে বাংলাদেশকে দাওয়াত করে নাই, গতবারও করে নাই। এটা আমাদের জন্য আনন্দের কথা নয়।

“আমরা যুদ্ধ করেছিলাম একাত্তর সালে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য, আমরা লড়াই করেছি ৯০ সালে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সেই বাংলাদেশে যদি দেখা যায় আজকে গণতন্ত্র নির্বাসিত…।”

বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এই আন্দোলন করছে না দাবি করে ফখরুল বলেন, “বিএনপি লড়াই করছে জনগণের মুক্তির জন্য, এই দেশকে বাঁচানোর জন্য, এই দেশকে সত্যিকার অর্থে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য।”

‘দেশে নৈরাজ্য চলছে’

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, “বরিশালে একজনের দোকান দখল করে নিয়েছে। প্রায় ৭০টা দোকান এবং এখন লিখে দিতে হচ্ছে যে, দোকানের ভাড়া ওই আওয়ামী লীগারকে দিতে হবে, দোকানের মালিক দিতে পারবে না। এই একটা নৈরাজ্য চলছে। যেভাবে খুশি দেশটাকে তারা চালানোর চেষ্টা করছে।

“আওয়ামী লীগ মূলত একটা সন্ত্রাসী দল, আওয়ামী লীগ কোনোদিন জনগণের ভোট নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসে নাই, আওয়ামী লীগ সব সময়ই জনগণকে ভয় দেখিয়ে, ত্রাস সৃষ্টি করে একটা ত্রাসের রাজত্ব করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছে। আজকে আবারও সেইভাবে ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। একবার গেছে ২০১৪ সালে, আরেকবার গেছে ২০১৮ সালে এখন ২০২৩ সালে আবার নির্বাচনে তো আবার বলছে…।”