নির্বাচন নিয়ে নানা হুঙ্কার প্রতিনিয়তই দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির নেতারা। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিরোধীদের রাজপথে মোকাবিলা করার হুমকি দিতে ছাড়ছেন না। এ অবস্থায় নির্বাচন-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
Published : 07 Sep 2022, 09:23 PM
এ দফায় বিএনপির মিছিল-সমাবেশে হামলা-সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ডাকা কর্মসূচি ঘিরে। পরে দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মিছিল-সমাবেশ ঘিরে আরও বেড়ে যায় সংঘর্ষ-সহিংসতার মাত্রা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ২২ অগাস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির কমপক্ষে ২৮টি সমাবেশে হামলা হয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় হামলা হয়েছে বিএনপি নেতাদের বাড়িঘরেও। আরও কয়েক জায়গায় বিএনপিকে সমাবেশই করতে দেয়নি পুলিশ। ১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জে বিএনপি আয়োজিত মিছিল পুলিশ ভেঙে দিতে চাইলে সংঘর্ষ বাধে। ওই সময় পুলিশের গুলিতে শাওন প্রধান নামের এক তরুণ নিহত হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও ২৬ জন। শাওন প্রধান স্থানীয় যুবদলের কর্মী। গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ অনুযায়ী, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে এবং তাতে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়েই শাওন মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জ, নেত্রকোনা, নরসিংদীসহ কোথাও কোথাও বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশের বাধাদানের মাধ্যমে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলেও চট্টগ্রামের মিরসরাই, টাঙ্গাইলের কালীহাতী, পিরোজপুরের স্বরপকাঠীসহ বেশিরভাগ স্থানে হামলা করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠন। বাম দলগুলোর কর্মসূচিতেও পুলিশি বাধাসহ সরকারি দলের কর্মীদের হামলা চালানোর ঘটনাও ঘটছে।
যদিও প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কিছুদিন আগেই গণভবনে দলীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছিলেন, তার সরকার বিরোধীদের ‘ডিস্টার্ব’ করবে না। গত ১৪ অগাস্ট সাংগঠনিক এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বিরোধী দল একটা সুযোগ পাচ্ছে, তারা আন্দোলন করবে, করুক। আমি আজকেও নির্দেশ দিয়েছি, খবরদার, যারা আন্দোলন করছে, তাদের কাউকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয় বা ডিস্টার্ব করা না হয়। তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিসও ঘেরাও দেবে, আমি বলেছি, হ্যাঁ আসতে দেব।’
জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ-উত্তেজনা দেখা দেবে– এমনটা কমবেশি আঁচ করতে পারছিলেন সবাই। চাপের মুখে থাকা অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, প্রভাবশালী কোনো কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাধুর্যে কিছুটা ভাটা পড়ায় খানিকটা আগেভাগেই মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সেই সঙ্গে দমন-পীড়নেরও শিকার হচ্ছে তারা। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, নির্বাচনের সময় যতই কাছে আসবে রাজনৈতিক সহিংসতাও বাড়বে।
এক সময় দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বলতে বোঝাত বোম-ককটেল ফাটিয়ে জনসনে ভীতি সঞ্চার করা কিংবা যানবাহন ভাংচুর ও রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকে। গত প্রায় এক দশকের ব্যবধানে রাজনৈতিক সহিংসতার চরিত্র বদলে গেছে মৌলিকভাবে। বোমাবাজি করে ভয় দেখানো ছাড়াও এখন বেড়েছে টার্গেট কিলিং বা বেছে বেছে হত্যা। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং তা ঠেকাতে আন্দোলনে নেমেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। তখন গাড়িতে পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণসহ নাশকতার নানা ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে অনেক মানুষের।
ওই নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করার ঘোষণা আগেই দিয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। কার্যত ২০১৩ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরই নির্বাচন ঠেকাতে মাঠে নামে তারা। তবে তাদের ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল সরকারও। কিন্তু তারপরও প্রাণহানি থামানো যায়নি। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরদিন থেকে নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ছয় দফায় ২৬ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ওই সময় সারা দেশে প্রাণ হারিয়েছেন ১২৩ জন। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় নিহত হন কমপক্ষে ১৮ জন। সব মিলিয়ে ওই নির্বাচনের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল কমপক্ষে ১৪১ জনকে।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সাতটি। তবে দশম সংসদ নির্বাচনের মতো এত প্রাণহানির ঘটনা আর কোনো নির্বাচনে ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করেছিল বিএনপি। ওই বছর নির্বাচন ঘিরে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪১ জন। আর ২০০১ সালের নির্বাচন ঘিরে নিহত হয়েছিলেন ৩৮ জন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অবশ্য কোনো ধরনের সহিংসতা হয়নি। ওই নির্বাচনটি হয়েছিল সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতায় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ২০১৩ সালে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, সেবার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘিরে এবং বছরের শেষদিকে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও বিরোধী জোটের অবরোধ কর্মসূচির মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সারা বছরে ৫০৭ জন মারা যান। আর আহত হন ২২ হাজার ৪০৭ জন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করেছিল বিএনপি। এমনকি বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র দল জামায়াতও অংশ নেয়নি ওই নির্বাচনে। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ২১ দিন হরতাল করেছিল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৮ ও ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকলেও তা উপেক্ষা করেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ সারে বিএনপি। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল এবং নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। তারপরও নির্বাচন করে বিএনপি। এরপর শুরু হয় ‘অসহযোগ’। ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ খালেদা জিয়ার সরকার জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিল পাস করালে অসহযোগ আন্দোলন শেষ হয়। টানা আন্দোলন চললেও ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা এত ভয়াবহ ছিল না। ওই এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গিয়েছিলেন ৪৯ জন।
এ দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাস অনেক পুরোনো। বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই এর সূচনা। সদ্য স্বাধীন দেশে সমাজে উগ্রপন্থার বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান নিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল–জাসদ। অথচ দলটির প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের শোকাবহ হত্যাকাণ্ডের আগে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল জাসদ। আবার জাসদের সশস্ত্র অঙ্গ-সংগঠন গণবাহিনীকে ঠেকাতে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করেছিল রাষ্ট্রীয় রক্ষীবাহিনী। অন্যদিকে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিও হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছিল। সিরাজ শিকদার গ্রেপ্তার হয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হওয়ার পরও কয়েক দশক দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল দলটি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে অন্তত ১৭টি ক্যু চেষ্টা, অতঃপর তার হত্যাকাণ্ড এবং এর কিছুকাল পরই জেনারেল এইচ এম এরশাদের প্রলম্বিত সামরিক শাসনেও কমবেশি উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে দেশে।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতনের পরে বাংলাদেশে আইনের শাসন নির্ভর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হওয়ার যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় অচিরেই। একদিকে শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান, অন্যদিকে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমাবনতি ভঙ্গুর করে তুলেছে গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থাকে। দিনদিনই কমে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা।
বিরোধীদের দমন করার জন্য শক্তি প্রয়োগের প্রবণতার সূচনা অনেক আগে হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারবিরোধী আইনানুগ কর্মসূচিকেও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম তথা গুরুতর অপরাধ বলেই গণ্য করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘিরে ২০১৩ সালজুড়ে জামায়াতের সহিংসতা ও নাশকতা, বিএনপি-জামায়াতের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও তা ঠেকানোর আন্দোলনের সময় ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও যেন সরকারকে এমন আচরণ করতে কিছুটা ‘ন্যায্যতা’ দিচ্ছে। বিরোধীরা মাঠে নামলেই সরকারের পক্ষ থেকে সেই নাশকতা জুজুর ভয় দেখানো হতে থাকে। বিএনপিও সে নিয়ে অনেকটাই কোনঠাসা। নেতৃত্বের সংকটসহ নানা কারণে দলটির মধ্যে সামনের নির্বাচন ঘিরে বড় কোনো স্বপ্ন বা আশা দেখা না গেলেও খুব সহজে ওয়াকওভার দিয়ে দেবে বলেও মনে হয় না। নির্বাচন নিয়ে নানা হুঙ্কার প্রতিনিয়তই দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির নেতারা। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিরোধীদের রাজপথে মোকাবিলা করার হুমকি দিতে ছাড়ছেন না। এ অবস্থায় নির্বাচন-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।