সম্পাদকীয় পাঠ থেকে বঞ্চিত কেন অনলাইন সংবাদমাধ্যমের পাঠক?

অনলাইনে সংবাদপ্রাপ্তির বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছে। আর তাই অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় অবস্থান জনগণ এবং সমাজের কাছে উপস্থাপন করা জরুরি।

আহসান হাবীব রাভীআহসান হাবীব রাভী
Published : 30 Jan 2023, 02:35 PM
Updated : 30 Jan 2023, 02:35 PM

বাড়ির বারান্দায় বসে সকালে এক কাপ চায়ের সাথে পত্রিকা পড়া ছিল এক সময়ের খুবই চেনা-পরিচিত দৃশ্য। অভিরুচি অনুযায়ী বিভিন্ন পাতাও ছিল একেকজনের পছন্দের তালিকায়। কেউ হয়তো খেলার পাতায় নিমগ্ন হয়ে থাকতেন, কেউ পড়তেন শুধুই বিনোদন পাতা। আবার কারও পছন্দ ছিল আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, কারও সারাদেশের সংবাদ। সংবাদপত্রের আধেয়ের বিভিন্ন ধরনের পছন্দের সেই চল এখনও আছে। এখনও খেলাপ্রেমীরা খেলার সংবাদেই বেশি নজর রাখেন, সংগীত অনুরাগীরা খোঁজ রাখেন বিনোদনধর্মী সংবাদে। তবে ওই ছাপা সংবাদপত্র পড়ার যে প্রচলিত অভ্যাস তা অনেকখানি বদলে গিয়েছে। যদিও দেশের সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে সরকারি নথিতে। তা নিয়ে অবশ্য ভিন্নমতও রয়েছে। সারা দুনিয়ায় এখন অনলাইনের জয়জয়কার। কমে যাচ্ছে ছাপা সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যাও। জলজ্যান্ত প্রমাণও আছে। প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট- এর ছাপা সংস্করণ বন্ধের খবর ছাপা পত্রিকার চাহিদা পড়তির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এখন পত্রিকাটি শুধু ডিজিটাল সংস্করণ চালু রেখেছে। বিশ্বব্যাপী ছাপা সংবাদপত্র যে সংকট সময় পার করছে তা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে দেখা যায়। বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র বর্ণনায় সরকারি নথি ভিন্ন কথা বললেও এটি অনেকটা নিশ্চিত বলা যায় আমাদের দেশেও ছাপা পত্রিকার পাঠক কমেছে। যথেষ্ট তথ্য ছাড়াই এ দাবি তুললেও এটিই বাস্তবতা।

তরুণ প্রজন্মের (বিশেষত জেনারেশন জেড) সংবাদ পাঠের অভ্যস্ততা বদলেছে। সংবাদপ্রাপ্তির আঙ্গিকের ধরনও বদলেছে। বাংলাদেশে অনলাইন সংবাদপত্রের আগমন ঘটে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর হাত ধরে। এরপর থেকে নতুন নতুন অনলাইন সংবাদমাধ্যমের আগমন ঘটছেই। চাহিদার বিষয়টি অনুভব করে ছাপা পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও অনলাইন সংস্করণ এনেছে। এমনকি অনলাইনেই মিলছে ছাপা সংস্করণের ই-ভার্সন। অনলাইনের এই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে বাজারে ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালও যুক্ত হয়েছে। সংবাদপ্রাপ্তির আঙ্গিকের এ ধরন এখনও জনপ্রিয়। তবে এখন নতুন আরও এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে সংবাদ বিপণন এবং সংবাদপ্রাপ্তির অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্ম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমের বিচরণ তৈরি হয়েছে। ইনস্টাগ্রাম, ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটার, লিংকড-ইন, টিকটকে সব সংবাদমাধ্যম নিজেদের অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সংবাদ শেয়ার দিচ্ছে। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকেই অসংখ্য পাঠক সংবাদ পড়ছেন। সংবাদের লিংক, ভিজ্যুয়াল সংবাদের লিংক শেয়ার করা ছাড়াও নতুন ধরনের মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সংবাদের ইনফোগ্রাফ। একটি সংবাদের চুম্বক অংশ দিয়ে ছবি আকারে তৈরি ইনফোগ্রাফ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

সংবাদমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন নিউজ শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব হয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘নাট শেল’, ‘ক্যাবল্গ্রাম’, ‘দ্য ফ্রন্ট পেজ’ প্রভৃতি। এসব নিউজ শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম নিজেরা সংবাদ তৈরি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকছে না। কিন্তু প্রতিদিন মূলধারার গণমাধ্যম থেকে সংবাদের চুম্বক অংশ নিয়ে ছবি আকারে ইনফোগ্রাফ তৈরি করছে। উল্লেখ করছে সংবাদসূত্রও এবং কমেন্ট থ্রেডে যুক্ত করে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংবাদের লিংক। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাঠকের ধরন অনুযায়ী সংবাদমাধ্যম এবং নিউজ শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো সংবাদ ও ভিজ্যুয়াল সংবাদের লিংক এবং ইনফোগ্রাফ শেয়ার করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লিংকড-ইনে পেশাদারদের জন্য সম্পর্কযুক্ত আধেয় শেয়ার করা হচ্ছে। আবার রেডিও স্টেশন এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বেশি তৎপর থাকছে ভিজ্যুয়াল আধেয়’র চাহিদা রয়েছে এমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আ আল মামুন বলছেন, সংবাদের বাজার দুটি। “প্রথমত সংবাদমিডিয়া অডিয়েন্সের কাছে সংবাদ বিক্রি করে; দ্বিতীয়ত, এই অডিয়েন্সকে আবার বিক্রি করে দেয় বিজ্ঞাপনদাতা ও নানামুখী স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর কাছে। ফলে, সংবাদ বিক্রির মাধ্যমে এমন শ্রেণীর অডিয়েন্সকে ধরতে হয়, ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি করতে হয় যাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিজ্ঞাপনদাতা ও স্বার্থগোষ্ঠীগুলো আগ্রহী হবে।” (মগজে কারফিউ: কোনটাকে বলি সংবাদ?, আ আল মামুন)

সংবাদ যে মাধ্যমেই পড়া হোক না কেনো শেষ পর্যন্ত কোনো ঘটনার সংবাদ হয়ে ওঠাই মূল কথা। যুগের পরিবর্তনে সংবাদপ্রাপ্তির উৎসের পরিবর্তনকে মেনে নেওয়াও স্বাভাবিক। এখানে ব্যক্তিগত অবস্থানের কথা তুলে ধরতে পারি। অনলাইন পরিসরে অভ্যস্ত হওয়ায় ছাপা পত্রিকা পড়া এবং কেনা হয় না। তবে প্রতিদিন অসংখ্যবার চোখ বুলিয়ে যাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ আরও তিনটি সংবাদমাধ্যমে। প্রতিদিন অন্তত একবারও যদি এসব সাইটে প্রবেশ না করি তবে দিনটি কেমন ছন্দহীন হয়ে যায়।

সংবাদ পড়ার পাশাপাশি বিশেষ আগ্রহ থাকে সম্পাদকীয়তে। প্রতিদিনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমগুলোর অবস্থান জানতেই আমার এ আগ্রহ। দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণে ছাপা সংস্করণের সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। তবে যে সাইটটি পড়া আমার অভ্যস্ততা সেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ সম্পাদকীয় নামে সেকশন এর অভাব আমার পাঠক মনকে হতাশই করে। গণযোগাযোগ শাস্ত্রের শিক্ষার্থী হওয়ায় সংবাদ লেখা, বিবরণ, সোর্স এবং গণমাধ্যমের মতাদর্শ নিয়ে খানিকটা কৌতুহল আমার রয়েছে। সেজন্যই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংবাদ অন্য সংবাদমাধ্যমে পড়লেও সেটিই আবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এও পড়ি। অথচ সংবাদ লেখার ধরনে পছন্দে থাকা এই সংবাদমাধ্যমে সম্পাদকীয়-এর অনুপস্থিতি এক ধরনের শূন্যতাবোধ তৈরি করে। এরপর খোঁজ শুরু করি শুধু অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নিয়ে। শুধু অনলাইন সংবাদমাধ্যমে উপ-সম্পাদকীয়- এর জন্য মতামত সেকশন থাকলেও সম্পাদকীয়-এর জন্য আলাদা করে কোনো সেকশন নেই। অর্থাৎ প্রথমসারির অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোতে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় না।

দেশের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংবাদমাধ্যম তার নিজের আদর্শিক অবস্থান তুলে ধরে সম্পাদকীয়-এর মাধ্যমে। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট দিনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে একটি বা দুটি ইস্যু নিয়ে সংবাদমাধ্যম তার অবস্থান এবং সেই ঘটনার নানা আঙ্গিক তুলে ধরে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সম্পাদক এবং সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে যুক্ত একটি দল প্রতিদিনকার এই সম্পাদকীয় লিখে থাকেন।

একটি সংবাদমাধ্যমের জন্য সম্পাদকীয় কত গুরুত্বপূর্ণ তা তুলে ধরতে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, “সংবাদপত্র সংবাদই দেয়, কিন্তু প্রত্যেক সংবাদপত্রেরই একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সংবাদপত্র কোনো যন্ত্র নয়। সে একটা জীবন্ত সত্তা। তার পেছনে তাই পরিকল্পনা, নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সবকিছু থাকে। অর্থাৎ একটা কেন্দ্র থাকে, যাকে মস্তিষ্ক বলা যায়, আর ওই যে কেন্দ্র, সেটা ধরা পড়ে সম্পাদকীয়তে। সম্পাদক ছাড়া যেমন পত্রিকা হয় না, সম্পাদকীয়বিহীন পত্রিকার তেমনি অসম্ভব তা সে-সম্পাদকীয় যেভাবেই লিখিত হোক না কেন।” (সম্পাদকীয়: সংবাদপত্রের দিকনির্দেশক; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী; দেশ রুপান্তর অনলাইন, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮)

অর্থাৎ সম্পাদকীয়-এর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যম কোনো ইস্যুতে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার পাশাপাশি পাঠক ও সমাজের কাছে সেই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপস্থাপন করে। এর প্রভাব যেমন আলোচনা করা হয় তেমনি এটি জনমত তৈরি, এমনকি নীতিনির্ধারণেও ভূমিকা রাখে। ফলে অনলাইনে সংবাদপ্রাপ্তির যে বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছে সেই অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় অবস্থানও জনগণ ও সমাজের কাছে উপস্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম তো শুধু সংবাদ পরিবেশন ও সরবারহ করে না। এর বাইরেও বৃহৎ পরিসরে সমাজের ওপর সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সমাজের ওপর সংবাদমাধ্যমের দায়বোধের প্রতিফলন হতে পারে সম্পাদকীয় এর মাধ্যমে। আধেয়’র আঙ্গিক, সংবাদ পরিবেশন বিচারে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের পরিসর বিস্তৃত হলেও পাঠক সম্পাদকীয় পাঠ থেকে কেন বঞ্চিত হবেন?