অবশেষে দেশের শীর্ষ আদালত তার জামিন স্থগিত করলো

"মাননীয় বিচারপতির কথাটি বিকৃতভাবে উপস্থাপনের পেছনে ধর্মান্ধদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা চেয়েছিল, হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে জিন্স-টপস পরার বিরুদ্ধে কথা ছড়ালে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা রাস্তাঘাটে জিন্স পরা নারীদের ওপর আক্রমণ চালাতে সাহস পাবে।"

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 24 August 2022, 05:12 AM
Updated : 24 August 2022, 05:12 AM

নরসিংদীতে জিন্স পরিহিত এক তরুণীকে মারধর এবং হেনস্তা করার অভিযোগে মার্জিয়া আকতার শিলা নামের যে আসামিকে গত সপ্তাহে মহামান্য হাইকোর্ট জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন, ২১ অগাস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি জনাব এনায়েতুর রহিম সেই জামিনের আদেশ নাকচ করে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি, অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি, ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতির প্রতি বিশ্বাসী সকলেই এ খবরে সন্তুষ্ট হয়েছেন।

জামিন দেওয়ার সময় হাইকোর্ট এই মর্মে মত প্রকাশ করেছিল বলে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক রটিয়েছিল যে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের মাননীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি উল্লেখ করেছিলেন যে, “এই ধরনের পোশাক পরে গুলশান-বনানীতেও যাওয়া যায় না, সেখানে এই মহিলা কি করে নরসিংদীর মতো জায়গায় এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পোশাক পড়ে গেলেন।” অর্থাৎ আসামি মহিলার সমালোচনা না করে মাননীয় বিচারপতি বরং আক্রান্ত মহিলার বিরুদ্ধে এবং তার পোশাকের সমালোচনা করে তার বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিলেন বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

আমি শুরুতেই বলতে চাই, এই মাননীয় বিচারপতিকে আমি গত চার দশক ধরে অতি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন অদম্য সৈনিক। তিনি আপসহীনভাবে অসাম্প্রদায়িক, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে কঠোর, যাকে একজন কঠিন বঙ্গবন্ধু সৈনিক বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। সেই অর্থে এই মাননীয় বিচারপতি এ ধরনের কথা বলে থাকতে পারেন এটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন ছিল। আমার ধারণা কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী লোক সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে মাননীয় বিচারপতির উক্তি বিভ্রান্তিকরভাবে প্রকাশ করেছে।

একজন বাঙালি হিসেবে আমি শাড়ি পরার পক্ষে। কেননা শাড়ি, কপালে টিপ এগুলোই হচ্ছে বাঙালি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীরা এবং কর্মজীবী নারীদের পক্ষে সব সময় শাড়ি পড়া সম্ভব হয় না, কেননা শাড়ি এমনি একটি পোশাক যেটি পড়ে কাজকর্ম করা কঠিন। সে কারণেই এই শ্রেণিভুক্ত নারীদের প্রায়ই শাড়ির বিকল্প পোশাক পড়তে হয়, যথা সালোয়ার কামিজ, জিন্স ইত্যাদি। আমাদের দেশের প্রচুর নারী একই কারণে সালোয়ার কামিজ পড়ে থাকেন। সালোয়ার কামিজও কিন্তু আমাদের জাতীয় পোশাক নয়, এটি এসেছে উত্তর ভারত এবং পাকিস্তান থেকে। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে এটিও মাঝে মাঝে পরতে হয়, যেমন পরতে হয় জিন্সের ট্রাউজার। আজ সারা বিশ্বে জিন্সের ট্রাউজার একটি কমন পোশাকে পরিণত হয়েছে। স্থান-কাল-ধর্ম-পাত্র নির্বিশেষে এবং ভৌগোলিক সীমা রেখা অতিক্রম করে জিন্সের ট্রাউজার আজ সারা বিশ্বের নারীদের সার্বজনিন পরিধেয় পোশাক হিসেবে প্রচলন পেয়েছে। বলা যেতে পারে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ মহিলা কোন না কোন সময় ট্রাউজার, বিশেষ করে জিন্সের ট্রাউজার পরিধান করে থাকেন প্রয়োজনের তাগিদে। এতে মোটেও কোন অশালীনতা নেই, এটি আদৌ কোন অবৈধ পোশাক নয়। সেই অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রী জিন্সের ট্রাউজার এবং টপস পড়ে নরসিংদী গিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই কোন আইন ভঙ্গ করেননি এবং তার পোশাকে (যেটি সংবাদ মাধ্যমে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে) আদৌ কোন অশালীনতা বা আপত্তিকর কিছু ছিল না। বরং মার্জিয়া (শিলা) নামক যে আসামি তাকে মারধর করলো এবং আরো দশজনকে জড়ো করিয়ে জিন্স পরিহিত তরুণীর উপর হামলা চালালো, দৃশ্যত ধর্মান্ধ শিলা নামক সে নারী অভিযুক্ত আসামি, অভিযুক্ত অপরাধের জন্য যার বিচার হওয়াই আইনের শাসনের নির্দেশনা। আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে তা হলো, এই যে শিলা নামক নারী দৃঢ়ভাবে জামাতি আদর্শে বিশ্বাসী এবং আক্রান্ত তরুণী জামাতি পোশাক পরেননি বলেই শিলা তার ক্ষোভ ঝেড়েছে দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। দেশে কোন মানুষেরই অধিকার বা ক্ষমতা নেই, কেউ তার অপছন্দের কোনও পোশাক পড়লে তাকে মারধর করার। আদালতেরও কোন ক্ষমতা নেই- কে কোন পোশাক পড়বে তা নির্ধারণের। এ ঘটনা প্রমাণ করছে, জামাতিরা নারী মহলে প্রবেশ করে কত নারীর মস্তিষ্ক ধোলাই করতে সক্ষম হয়েছে।

এ বিষয়টি নিয়ে একটি বেসরকারি চ্যানেল টক শো করলে সেখানে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে গিয়েই দেখি আবুল হাসেম নামের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি রাখঢাক না রেখেই বলে ফেললেন- ‘যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র তাই এ ধরনের পোশাক গ্রহণযোগ্য নয়’। এই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কথায় আমি অবাক হয়েছিলাম- কেননা এটিতো জামাতিদের কথা!

প্রশ্ন করেছিলাম, এই লোকটি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের সময়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন? আমি বলেছিলাম, “বাংলাদেশ আদৌ মুসলিম দেশ নয়, সাংবিধানিকভাবে এটি একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ।” আমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ব্যক্ত করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধান লংঘন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। তাই তাকে অনতিবিলম্বে এই পদ থেকে অপসারণ করা প্রয়োজন।

আমি আরও বলেছিলাম, “সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে এরকম আরও ধর্মান্ধ জামাত/হেফাজতি লোক ঘাপটি মেরে রয়েছে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রত্যয় নিয়ে।”

মাননীয় বিচারপতির কথাটি বিকৃতভাবে উপস্থাপনের পেছনে ধর্মান্ধদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা চেয়েছিল, হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে জিন্স-টপস পরার বিরুদ্ধে কথা ছড়ালে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা রাস্তাঘাটে জিন্স পরা নারীদের ওপর আক্রমণ চালাতে সাহস পাবে। অর্থাৎ এই উক্তিটি আধুনিক পোশাকে পরিহিত নারীদের উপর ধর্মান্ধদের আক্রমণ চালানোর সুযোগ করে দেবে, ধর্মান্ধরা এভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লাইসেন্স পেয়ে যাবে। একথা ভেবে অনেকেই শংকিত হয়ে পড়েছিলেন। আমি নিজেও শঙ্কায় ছিলাম কেননা আমার মেয়েরাও মাঝে মাঝে জিন্সের ট্রাউজার পরে থাকে। আমার প্রয়াত স্ত্রীও মাঝে মাঝে শাড়ির বিকল্প হিসেবে জিন্সের ট্রাউজার পরতো। আমার বহু আত্মীয়ও জিন্সের ট্রাউজার পড়ে থাকে। সারা বিশ্বে সম্ভবত এটি এখন সবচেয়ে পরিচিত এবং ব্যবহৃত শালীন পোশাক।

আরেকটি আনন্দের কথা হলো এই যে শিলাকে দেওয়া হাইকোর্ট কর্তৃক জামিনের আদেশ আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়েছিলেন স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল মহোদয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ গোষ্ঠির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি সমাজের প্রতি তার দায় পূরণ করেছেন, যার জন্য তিনি সকলের প্রশংসার দাবিদার।

তবে তার দায়িত্ব এখানেই শেষ হয়নি। তার অধীনস্ত সেই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে ওই পদ থেকে অপসারণ এখন সময়ের দাবি। ন্যূনতম পক্ষে ওই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে এই মর্মে কারণ দর্শাতে বলা উচিত যে, তিনি কিভাবে সংবিধানের নির্দেশনা লংঘন করে বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এ কথাটি যে ব্যক্তি জানে না, অথবা জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে অবজ্ঞা করার চেষ্টায় মেতে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য, তার কোন অধিকার নেই অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কোন পদ দখল করে থাকার।

অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে নিয়োজিত আইন কর্মকর্তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে থাকে নিজস্ব ডিস্ক্রিশন (Discretion), অর্থাৎ তারা নিজস্ব বিবেচনার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। রাষ্ট্রের অন্যতম স্বার্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ রক্ষা, অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার, সাম্প্রদায়িক শক্তিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং ধর্মান্ধদের শাস্তি নিশ্চিত করা। কোন আইন কর্মকর্তা যদি ঠিক তার উল্টোটি করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।

এটা ভুলে গেলে চলবে না, যারা পাকিস্তান ভেঙ্গে ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের সৃষ্টিকে মেনে নিতে পারেনি, পারেনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমর্থন করতে, এরা সব সময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে ধর্মান্ধ আদর্শ প্রচার করার। এরা যখনই ধরা পড়ে তখনই এদের সরিয়ে দেওয়া, এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান করা নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

জিন্স তথা আধুনিক পোশাক পরে কোন নারী বান্দরবান যাবেন নাjd সেন্টমার্টিন যাবেন, নাকি নরসিংদী যাবেন, সেটি তার সম্পূর্ণ নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার এই অধিকার সংবিধান প্রদত্তও বটে। তার পোশাক কারো পছন্দ না হলে, সেটি সেই পছন্দ না করা ব্যক্তিরই সমস্যা। যে ব্যক্তি পোশাকটি পছন্দ করতে পারেননি, তিনি যে অঞ্চলের মানুষই হোক না কেন তার কোন ক্ষমতা বা অধিকার নেই আধুনিক পোশাকে পরিহিত কোনও নারীর উপর আক্রমণ চালানোর। কোনও আইনই তাকে সে ক্ষমতা দেয়নি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিশ্চিতভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কর্তৃপক্ষ দেরিতে হলেও শিলা নামক সেই ধর্মান্ধ আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে সকলের প্রশংসা অর্জন করেছে। আধুনিক পোশাক পরিহিতা কোন ব্যক্তির উপর যেন ধর্মান্ধরা আক্রমণ চালাতে না পারে সেটি দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

একইভাবে আক্রমণকারীদের বিচারের আওতায় আনাও রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। রাষ্ট্র এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করায় আইনের শাসনের নীতিরই জয় হলো। দেশের আইন অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মেই শিলা নামক এই নারীর বিচার হবে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে তার শাস্তিও হতে পারে, আর সেটি দেখার জন্যই আমরা অপেক্ষায় থাকবো।