‘হাওয়া’ ও হাশিম: বেদনার সব কথা মানুষ বলে না

সকল অসংলগ্নতা নিয়ে হাশিম মাহমুদ শুধু হারিয়ে যেতেন। জীবনের সমান্তরালে এখনও হারানোই আছেন। আজ যে হাশিম মাহমুদকে দেখছেন, হয়তো ‘হাওয়া’ ছবির মাধ্যমে তিনি ফিরেছেন আলোচনায়, তিনি আসলে সেই ‘হারানো’তেই ফিরে গেছেন। লিখেছেন আহসান কবির।

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 28 July 2022, 02:35 PM
Updated : 28 July 2022, 02:35 PM

সকল অসংলগ্নতা নিয়ে হাশিম মাহমুদ শুধু হারিয়ে যেতেন। জীবনের সমান্তরালে এখনও হারানোই আছেন। আজ যে হাশিম মাহমুদকে দেখছেন, হয়তো ‘হাওয়া’ ছবির মাধ্যমে তিনি ফিরেছেন আলোচনায়, তিনি আসলে সেই ‘হারানো’তেই ফিরে গেছেন।

অভিমান তার জীবনটাকে জীবনের অন্যভূবনে নিয়ে গেছে। হাশিম ছাড়া সেই জীবনে এখন আর কেউ থাকেন না! জনপ্রিয়তা তাকে খুঁজে বের করেছে যেটা ১৯৯৩-১৯৯৪ তে তার পাওয়া উচিত ছিল। হুমায়ূন আহমেদ এর সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এর মতো! খোকা, ছোটকালে যে বাবার কাছে একটা ভালো ফুটবল চেয়ে পায়নি। বহুদিন পরের একদিন, অসংখ্য ফুটবল কিনে দেয়ার মানুষ তখন খোকার চারপাশে, কিন্তু ফুটবল খেলার সেই দিনগুলো খোকার ছিল না, যেমন হাশিম মাহমুদের এখন নেই। ফিরে আসা এই দিন তার আনন্দেও নেই, দীর্ঘশ্বাসেও নেই। অনেকটা গায়ক সুমন কবীরের সেই গানের মতো- ‘সাপলুডু খেলছে বিধাতার সঙ্গে...কিছু নেই তার অনুসঙ্গে’। হাশিম আসলে অনেকদিন ধরে সাপলুডো খেলছেন। কার সঙ্গে খেলছেন সেটা আমরা কেউ হয়তো জানতে পারিনি।

মিডিয়ার কল্যাণে হাশিম মাহমুদ আজ অনেক বেশি পরিচিত। হাল আমলের একটা শব্দ হচ্ছে ‘ভাইরাল’। কিন্তু অনেক আগে থেকে যে মানুষটা নিঃস্ব কিংবা নিঃসঙ্গ এক দ্বীপে বাস করেন, বিচ্ছিন্নতার ভাইরাল যাকে দেশান্তরে যেতে বাধ্য করে, গল্পের রিপভ্যান উইংকেলের মতো সে আর কখনো ফেরে না। জনপ্রিয়তার একটা ধূসর দিক আছে। জনপ্রিয়তার হিমালয়ে যখন বরফ জমে, যখন আলোচনার কোলাহল থেমে যায় তখন আর নীরবতার জল সেঁচা যায় না, পাল ওড়ানো যায় না, তখন পুরোনো নিঃসঙ্গতা ফিরে আসে মারমুখো ঢেউ হয়ে। হয়তো অবহেলা ফিরে আসে দ্বিগুণ হয়ে। হাশিমের কী হবে জানি না, সে যেন একটু শান্তি নিয়ে তার গান গাইতে পারে এই কামনা করি। একদিন যেন তার হারিয়ে যাওয়া গানগুলো ফিরে আসে তার স্মরণে। যেন বেঁচে থাকে গানগুলো ভালো কোন মানুষের মুখে।

ভালো শব্দটা বললাম ভিন্ন একটা কারণে। হাশিম মাহমুদের সাথে আড্ডাকালে কবীর সুমন কিংবা লালনের গান গাইতেন তিনি। কবীর সুমনের একটা গানের কথা এমন, যেটা গাইতেন হাশিম-

‘পুকুর পাড়ের নোয়ানো গাছ

চিনতো একটা ছোট পুটি মাছ...

সবই অতীত তাইতো তাইতো

রইলোটা কী বর্তমানে?

মানুষ জানে মানুষ জানে..

পাড়ার পুকুর কে বোজালো

যুগের হাওয়া অন্যমনে

জমি বেচার টাকা গোনে..’

গানের নেশা ছিল কিন্তু হাশিমের এই টাকা গোনার নেশাটা ছিল না। টাকা গোনার নেশা না থাকা অনেক সময় পাপের পর্যায়ে পড়ে। হাশিম দিনের পর দিন এই পাপ করেছেন। সারারাত গান গেয়েছেন। কেউ তাকে ঠিকমতো খেতেও দেয়নি। যে টাকার মালা তার গলায় পরানো হয়েছিল সেই টাকার মালার দিকে তার নজর ছিল না। গান গাইলে যে টাকা পাওয়া যায় সেই চিন্তাও ছিল না তার মাথায়। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার শাহবাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা বা ছবির হাটে আসার দিনগুলো ছিল অন্যের সাহায্য নির্ভর। আসতেন, দলবেঁধে গান গাইতেন, কখন খাবেন, খাবার টাকা কীভাবে জুটবে- সেই চিন্তা তার মাথায় আসেনি। এই মাথায় না আসার পাপে যে জীবন যাপন করেছেন হাশিম সেই জীবন তাকে জীবন থেকেই নির্বাসন দিয়েছে। হাশিম এখনো সেই ‘নির্বাসনে’ই আছেন। নির্বাসনে থেকেও কেউ কেউ জীবনের সাথে বাজি ধরতে পারেন। দেবদাস কিংবা হাশিমও হয়তো বাজি ধরেছিলেন-

‘একবার আমি গিয়েছিলাম পাহাড়ি অঞ্চল

পাহাড়ি মেয়েটার চোখ দুটো ছল ছল

ছল?

নাকি জল?

চ ল?

মেয়ে তুই বল

তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি

আবার আমি গিয়েছিলাম নীল সাগরের জল

সাগরের কন্যারে মন পাইনি সে অতল’....

‘তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি’- এই বাজিতে কী জিতলেন বা হাশিম আদৌ কোনও বাজি ধরেছিলেন কিনা সেই প্রসঙ্গ আজ থাক। সকল অসংলগ্নতা নিয়ে হাশিম ‘আড়াল’ খুঁজতে শুরু করেছিলেন এক যুগ আগে থেকেই। ১৯৯০-৯১ থেকেই গানের আড্ডা, গানের দল করা, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে পরে থাকা, চাকরিতে মনোসংযোগ করতে না পারা সব অভিজ্ঞতাই তিনি নিয়ে ফেলেছিলেন। তারপরও হয়তো চেষ্টা করেছিলেন। তার অসফল ভালোবাসার গল্প জনপ্রিয় হলেও দেবদাস হয়েছিলেন কিনা সেটাও জানতে চাইনি। ‘কালা কালা সাদা সাদা’ গানের গল্পের ভেতরেও যেতে ইচ্ছে করেনি। কালো রঙের প্রেমিকার কালো রঙের স্বামী হলে ছেলেমেয়ের গায়ের রঙ কী হবে- সেই চিন্তাও মাথায় রাখিনি।

হাশিম গাইলেন ‘কালো পাখি’ কিন্তু হাওয়া ছবিতে কেন কালা পাখি গাওয়া হলো সেটাও ভাবিনি। ভাবনার বিষয় একটাই-হাশিম মাহমুদ আসলে কোন জগতে আছেন?

অবহেলার দিনগুলোর কথা কী মনে আছে তার? তার গানগুলো রেকর্ড হোক তিনি বারবার চেয়েছেন। গানগুলো কি রেকর্ড হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে হাশিম কি কোনও টাকা পেয়েছিলেন? নিঃস্ব হয়ে যাওয়া হাশিমের পাশে কী ভাইবোনরা সবসময় ছিলেন? বন্ধুরাও কি একসময় তাকে বোঝা মনে করতেন? নিরাময় ও পুর্নবাসন কেন্দ্রের দিনগুলো কেমন ছিল? তার অনেক গান বিভিন্ন শিল্পীরা গেয়েছেন, গানের ক্যাসেট বা সিডিও আছে। এর বিনিময়ে গীতিকার ও সুরকার হাশিম মাহমুদ কি কোনও অর্থ পেয়েছিলেন? হাশিম মাহমুদ যে জগতে আছেন সেখানে কি এইসব দুঃখগুলো ফিরে আসে বার বার? ‘পিরীত ভালা গলার মালা কইলে কী আর হয়? যারে ভালো লাগে আমার দেখলে তারে আমার চক্ষে নেশা হয়’- সেই নেশার কোনও স্মৃতি কি এখনও তার জগতজুড়ে আছে? হাশিম মাহমুদ আসলে কোন জগতে আছেন?

এখন যে সময় যাচ্ছে সেই ‘হাওয়া’র সময়ে অনেক মানুষ আসছেন তার সাথে দেখা করতে। আসছেন টেলিভিশন চ্যানেলের লোকজন। আসছেন পুরোনো বন্ধুরা, টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের সময় পাশে থাকছেন ভাইবোনরাও। হাশিম কি সেই জগতেও আছেন? হাশিম মাহমুদ নাকি বার বার বলতেন- “দেখিস একদিন! অনেক বিখ্যাত হবো আমি। সেদিন আমি নীল স্যুট পরে থাকবো। পাশে থাকবি তোরা। মা’কেও পাশে রাখবো। সাক্ষাৎকার দেব আমি, তোরাও দিবি!” হাশিম কি সেই জনপ্রিয়তাকে স্পর্শ করতে পারছেন? নাকি তিনি সাপুলুডো খেলছেন আগের মতোই? যে জীবন গীতিকবির, যে জীবন সুরকারের, যে জীবন গায়কের তার সাথে কখনো কি আর দেখা হবে হাশিম মাহমুদের?

নাকি জনপ্রিয়তার ঘূর্ণিঝড় থেমে গেলে হাশিমের সেই অভিমান আর অবহেলার দিন ফিরে আসবে? ঘোর দুর্দিনে বৃদ্ধা মা তাকে ফেলে দিতে পারেননি। এখনও তিনি সেই মায়ের মমতার আঁচলেই বাঁধা আছেন। প্রকৃতি যদি কোনদিন তাকে নিঃসঙ্গতা ফিরিয়ে দেয় তখন?

মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ ছবি নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় চলছে। শুভকামনা ‘হাওয়া’ এর সাথে জড়িত সবাইকে, যেন ব্যবসা সফল ও মনে রাখার মতো ছবি হয় এটা। অনেকে জানিয়েছেন ‘হাওয়া’ টিম এর ভালো অনেক মানুষের সাথে একটা পত্রিকা ও কয়েকজন সহৃদয় মানুষ হাশিম মাহমুদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। ভালোবাসার এই হাওয়া যেন বয়ে যায়, যেন নিজস্ব ভূবনে হাশিম মাহমুদ তার গানের স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে পারেন। দেবদাসের জন্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা শুভকামনা ছিল শেষে। তেমন করে যেন বলা যায়-কিছু সহৃদয় মানুষ আর মমতাময়ী মা ও বোনের কোমল করস্পর্শ ঘিরে রাখুক হাশিম মাহমুদকে। নিজস্ব ভূবনে সাপলুডো খেলা মানুষটা যেন হাসি আর আনন্দে থাকে। যেন সে নিয়তির সাথে বাজি ধরে গাইতে পারে- ‘সাদা সাদা কালা কালা, রঙ জমেছে সাদা কালা/হইছি আমি মন পাগেলা বসন্ত কালে..তুমি বন্ধু কালো পাখি আমি যেন কী?’

গানের জগতের সেরা সর্বহারাদের একজন হাশিম মাহমুদ। প্রতারক স্মৃতি আর জীবন ভরে পাওয়া নিদারুণ অবহেলা ছাড়া আর কিছু নাই তার সম্পদ। যে আগুনে শুধু নিজের হৃদয় অঙ্গার হয় সেই আগুনটা দারুণভাবে চিনতেন হাশিম। তাই লিখতে পেরেছিলেন, গাইতে পেরেছিলেন সেই গান- ‘আগুন নিয়ে খেলছো তুমি আগুন চিনলা না!’

এই আগুন নিয়েই বাঁচুন হাশিম মাহমুদ। যে ভূবনে আছেন সেখানেই যেন থাকতে পারেন, সেই দেশান্তরেই যেন যেতে পারেন ঠিক তার গানের মতো- ‘আমি বাউল হইয়া হইলামরে দেশান্তর, ও দয়াল…আমি কান্দিয়া কান্দিয়ারে গেলাম…’

হাশিম মাহমুদ আসলে কাঁদছেন। যারা তার গান নিয়ে ব্যবসা করেছেন, যারা তাকে বঞ্চিত করেছেন তাদের অভিশাপ দিচ্ছি। এদেশে ন্যায্য পাওনা আর ‘রয়ালিটি’ বলে কিছু আছে কিনা আবারো জানতে চাচ্ছি।

কামনা করছি ‘হাওয়া’ বদলে দিক হাশিম মাহমুদের নিজস্ব ভূবন।