ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয়, বরং ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধ বা সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
Published : 01 Apr 2024, 07:23 PM
ক্যাম্পাসে ‘ছাত্র রাজনীতি’ থাকা উচিত কি উচিত নয়— ওই বিতর্ক বেশ পুরোনো। ২০১৯ সালেও এরকম একটি বিতর্ক উঠেছিল আবরার ফাহাদ নামে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) শিক্ষার্থী খুন হওয়ার পরে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার জের ধরে আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ওই ঘটনার পরে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত করার দাবি তুলেছিলেন এবং তাতে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল শিক্ষক সমিতিও।
আবরার হত্যার সাড়ে চার বছরের মাথায় এখন সেই বুয়েটে পুনরায় ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত করার দাবিতে সোচ্চার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। অবশেষে এক ছাত্রলীগ নেতার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ২০১৯ সালে জারি করা বিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা স্থগিত করে দিয়েছে হাই কোর্ট। যদিও গণমাধ্যমের খবর বলছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশই ক্যাম্পাসকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত রাখার পক্ষে। তবে ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে অপরাজনীতি ও জঙ্গিবাদের কারখানায় পরিণত করার চেষ্টা হলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে’ বলে সতর্ক করছেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি: কয়েকটি প্রশ্নের সুরাহা করা জরুরি
১. ছাত্র রাজনীতি আর ক্যাম্পাসে রাজনীতির নামে দলীয় মাস্তানি কি এক জিনিস?
২. রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) মূল দলের লাঠিয়াল হিসেবে প্রতিপক্ষ দমন তথা ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষা, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ উন্নত করা এবং দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের বিকাশে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখে?
৩. যে রাজনীতি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, সরকার ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়— ওই রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী?
৪. ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির নামে অতীতে কী হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কী হবে?
৫. জাতীয় রাজনীতি নিয়েই যেখানে সাধারণ মানুষ হতাশ, যেখানে ছাত্র রাজনীতির দ্বারা দেশের কী উপকার হবে?
৬. ছাত্রলীগ না থাকলে বুয়েট ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির এবং নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর শক্তিশালী হবে— এই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য?
৭. বুয়েটের যে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে, তারা কি ছাত্রশিবির ও হিযবুত তাহরীরকে মেনে নেবেন?
৮. কত শতাংশ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে?
৯. যদি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের বিরাট অংশই বিপক্ষে থাকেন তাহলে কি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত?
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরানোর দাবিতে গত রবিবার (৩১ মার্চ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করার পর কয়েকশ নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান। তারা বুয়েট শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার পর ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। এ সময় বুয়েটের মূল ফটক এবং বিভিন্ন হলের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর তিন দিন আগে গভীর রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন।
ছাত্রলীগ এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, বুয়েটে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকলেও গোপনে সেখানে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে ছাত্রশিবির ও হিযবুত তাহরীর। এ কারণে কেউ কেউ বুয়েটে জঙ্গিবাদের বিস্তার হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের দায় এড়াতে পারে না। কেননা আনুষ্ঠানিকভাবে যেখানে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ, সেখানে যদি সত্যিই শিবির ও হিযবুত তাহরীরের মতো সংগঠন সক্রিয় থাকে এবং সংগঠিত হতে থাকে, সেটি দুর্ভাগ্যজনক। তাহলে বুঝতে হবে বুয়েটের সিস্টেমে সমস্যা আছে। সেই সিস্টেম ঠিক করার দায়িত্বও বুয়েটকে নিতে হবে।
যদি রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে ছাত্রলীগের জন্য যেমন, তেমনি শিবির ও ছাত্রদলের জন্যও। নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের জন্য তো বটেই। বিপরীতে এটাও মনে রাখতে হবে, যদি বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তাহলে সেখানে শুধু ছাত্রলীগ থাকবে আর বাকিদের পিটিয়ে বের করে দেয়া হবে— সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। বরং বৈধ সকল দলের ছাত্র সংগঠনেরই অধিকার আছে বুয়েটে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন যদি মনে করে ক্যাম্পাসে তাদের বাইরে আর কোনো দল সক্রিয় থাকতে পারবে না বা কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারবে না এবং বিরোধী মত ও আদর্শের সংগঠনগুলোকে সশস্ত্র উপায়ে প্রতিহত করা হবে— সেটি কোনো অর্থেই রাজনীতি নয়। সেটি স্পষ্টতই ক্ষমতার বিকার এবং দলীয় লেজুড়বৃত্তি। অতএব শুধু বুয়েট নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের আগে এটা ঠিক করতে হবে যে, ছাত্র রাজনীতি মানে কী? ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য কী? ছাত্র সংগঠনগুলো কার স্বার্থ রক্ষা করবে, মূল দলের না শিক্ষার্থীদের?
ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছাত্র সংসদ গঠন। কয়টি প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়? নির্বাচন হলেও সেটি কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়? যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্র সংগঠনের বাইরে আর কোনো দল ক্যাম্পাসে থাকতে পারবে না বা থাকলেও তারা নানাবিধ নিগ্রহের শিকার হয়ে সংখ্যালঘু হয়ে থাকবে— এই ধরনের ছাত্র রাজনীতি দেশবাসী চায় কিনা, সবার আগে সেই প্রশ্নের মীমাংসা করা জরুরি।
বাস্তবতা হলো, ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি চান কি চান না— উন্মুক্ত পরিসরে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে কিংবা এই ইস্যুতে একটি নিরপেক্ষ গণভোট নেয়া হলে দেশের অধিকাংশ মানুষ যে বিপক্ষে ভোট দেবেন, তাতে সন্দেহ কম। তবে শুধু বুয়েটের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ নিয়ে একটি ভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। সেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যদি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি পুনরায় উন্মুক্ত করে দেয়ার পক্ষে ভোট দেন, তাহলে সেখানে ছাত্রলীগসহ বৈধ সকল সংগঠনের জন্যই কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
পরিশেষে, দেশ পরিচালনায় ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মূলত ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুতরাং ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ কোনো সমাধান নয়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে বহু বছর ধরে যা চলছে, সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ, অসন্তোষ, উদ্বেগ, হতাশা ও ভয়ের শেষ নেই। সম্ভবত এরকম একজন অভিভাবকও পাওয়া যাবে না যিনি মনে-প্রাণে চান যে তার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ুক। এই পরিস্থিতি কেন, কাদের জন্য এবং কোন প্রক্রিয়ায় তৈরি হলো— ওই আলোচনাটিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং, বুয়েটসহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি থাকবে— এটিই কাম্য। কিন্তু তার আগে ঠিক করতে হবে রাজনীতি বলতে আমরা কী বুঝি এবং কোন উদ্দেশ্যে আমরা চাইছি যে সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি উন্মুক্ত থাকুক।
অতএব ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয়, বরং ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধ বা সংস্কার এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে যে, যদি কোনো ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের অন্যান্য স্পেসগুলো বন্ধ হয়ে যাবে কিনা? রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে কোনো বিতর্কিত ও নিষিদ্ধ সংগঠন সেখানে শক্তিশালী হবে কি না— ওদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে।