ক্ষমতার রাজনীতি পরিণত হয়েছে বড়লোক হবার সেই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপে। এই প্রদীপ সবাই চায়। ক্ষমতাসীনরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। বিরোধীরা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায়।
Published : 29 Jul 2023, 07:16 PM
সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা ও টানটান উত্তেজনার মধ্যে বিএনপি এক দফা দাবিতে গত ২৮ জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করেছে। একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ করে।
উভয় পক্ষের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও ক্ষমতাসীন দলের ‘শান্তি সমাবেশ’ শান্তি ধরে রাখতে পারেনি। সমাবেশ থেকে ফেরার পথে উপদলীয় কোন্দলের জের ধরে একজনের মৃত্যু হয়। মহাসমাবেশের পর পরদিন ২৯ জুলাই বিএনপি ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এতে করে উভয় সংগঠনের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপির কয়েকজন নেতাকে পুলিশ লাঠিপেটাও করে। সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
এই রাজনৈতিক সংঘাত কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। কারণ দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজপথে শক্তি দিয়ে একে-অপরকে মোকাবিলা করার হিংসাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করছে। উভয় পক্ষই আপসহীন, বেপরোয়া। তাতে করে আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির মঞ্চ আরো উত্তপ্ত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আমরা দীর্ঘদিন ধরেই একটা রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছি। প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অনড় অবস্থানে থাকায় সংকটের কোনো সমাধান সূত্র বের করা যাচ্ছে না। বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট আরো নানামুখী সংকটের জন্ম দিচ্ছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। অবশ্য এখন সময়টাই এমন যে, ভালো কথা কারো কাছেই খুব একটা ভালো লাগে না। নীতিকথা, জ্ঞান, উপদেশ দিলে শিশু থেকে প্রবীণ, সবাই কেমন চটে যায়। সবাই এখন টাকা চায়, টাকা বানানোর মেশিন চায়। রাতারাতি কীভাবে বড়লোক হওয়া যাবে, কম পরিশ্রম করে বা বিনা পরিশ্রমে কীভাবে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো যাবে, সেই পথের সন্ধান চায়।
ক্ষমতার রাজনীতি পরিণত হয়েছে বড়লোক হবার সেই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপে। এই প্রদীপ সবাই চায়। ক্ষমতাসীনরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। বিরোধীরা যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতা নিয়ে তাই এত মারামারি, খেয়োখেয়ি।
গত কয়েক দশক ধরে এক নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। বেশ কিছু প্রণালি গ্রহণ করে হয়েছে। অত্যন্ত কৌশলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে-চুড়ে জগাখিচুড়ি বানানো হয়েছে। বর্তমান শিক্ষায় যোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট করে একটা মানুষকে ঠিক সেই পরিমাণ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যেটুকু গ্রহণ করলে সে কোনো সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে না পারে, শিখতে না পারে, চাপ নিতে না পারে, ইংরেজি এবং অংকে দুর্বল হয়, বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের যোগ্য না হয়। যেন মৌলিক জীবন-দক্ষতা শিখতে না পারে, কিন্তু কায়িক পরিশ্রমকে ঘৃণা করতে শেখে।
উল্লেখ্য, এক সময় আমাদের দেশের শিক্ষাবিমুখ মানুষকে লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তুলতে—'লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে' বলে লোভ দেখানো হতো। যদিও এটা অত্যন্ত নেতিবাচক একটা কথা। এই বাক্যটিতে আদর্শমুখী শিক্ষার পরিবর্তে উপার্জনমুখী শিক্ষার সুফলের কথা বলা হয়েছে। আসলে লেখাপড়ার সঙ্গে আয়-রুজির তেমন সম্পর্ক নেই। লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এটা শিখলে আপনি ভালো থাকবেন। মানুষ হিসেবে উন্নত হবেন। যুক্তিবুদ্ধি, জ্ঞান, বিবেচেনাবোধ বাড়বে। অন্তত পতিত মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করবেন না। গাড়ি-ঘোড়া হতেও পারে, নাও হতে পারে।
'লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে' এই মিথ্যে ছবকের কারণে, আমরা তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা গাড়ি-ঘোড়ার জন্য নির্দয় অনাচারে লিপ্ত হই! আমরা ধরেই নেই, আমরা শিক্ষিত জন, এটা আমাদের প্রাপ্য! চাকরি মানেই শিক্ষিতের অনাচারের লাইসেন্স। বড় আসন, শ্রেষ্ঠ মর্যাদা পাবার একচেটিয়া অধিকার। শিক্ষিতজনের শ্র্রেষ্ঠত্ব ও অহংকারী হওয়ার পেছনে উল্লিখিত বাক্যটির একটি বড় প্রভাব আছে। এটা আমাদের পূর্বপুরুষের পাপ!
যা হোক, এই অন্তসারশূন্য শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনোজগৎ গঠনের জন্য হলিউড-বলিউডের সিনেমা-সিরিয়াল অবারিত করা হয়েছে। আমাদের মূল্যবোধ, বিবেকবোধ, রুচি, স্বপ্ন-সব কিছু গঠিত হচ্ছে এসব সিনেমা-সিরিয়ালের ভিত্তিতে। আমাদের স্বপ্ন এখন হলিউডি-বলিউডি নায়ক-নায়িকার স্বপ্ন, সেইরকম স্মার্ট লুক, চলা ফেরা, সেই রকম যন্ত্রপ্রযুক্তি ব্যবহার করা, গাড়ি চালানো, সেক্সি সুন্দরী গার্ল ফ্রেন্ড বা সুন্দরী বউ, ফ্ল্যাট এবং কর্পোরেট চাকরি। এসবকে আমরা জীবনের সবচেয়ে আরাধ্য মনে করি। এসব পাওয়াকেই সাফল্য ভাবি।
হ্যাঁ, আমাদের ধর্মমুখীও করা হয়েছে। ধর্মের মানবিক দিকগুলো উপেক্ষা করে, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের শিক্ষাকে অগ্রাহ্য করে আমাদের এখন এমনভাবে ধর্ম শেখানো হচ্ছে, যেন আমরা অত্যন্ত গর্ব ও দৃঢ়তার সঙ্গে অন্য ধর্মের লোককে ঘৃণা করতে পারি। ধর্মের মানবিক মূল্যবোধগুলোকে আড়াল করে আমরা শিখছি বলিউডি কায়দায় স্বপ্ন পূরণের উপায়, যেখানে সকল ধরনের মিথ্যা, অপরাধ, চুরি, অন্যায় সব কিছুই গ্রহণযোগ্য।
আমরা খুব সহজেই হাতে পেয়েছি একটা করে চাইনিজ স্মার্ট ফোন। শিখেছি ফেসবুকিং, শিখেছি সেলফি তোলা, ফটো আপলোড। আমরা গুগলে সার্চ দিয়ে কীভাবে আমাদের জ্ঞানের পরিধিকে বাড়াতে পারি, তা না শিখে শিখেছি ইউটিউব ব্রাউজিং। এখানে আমরা খুব সহজেই পেয়ে যাই উফরি জাভেদ, মিয়া খলিফা, সানি লিয়নকে। বিকৃত যৌনতা আর অবদমনের মিশ্রণে আমরা আমাদের সন্তানদের এক ভয়াবহ মনস্তত্ত্বের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।
আমরা দেশপ্রেম শিখছি, কিন্তু দেশের প্রতি কর্তব্য, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখছি না। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিতে ম্যাচিং করা কালো ড্রেস পরতে শিখেছি, শহীদ মিনারে ফুল দিতে শিখেছি, কিন্তু বাংলাটা শিখছি না। ফেসবুকেও বাংরেজি চর্চা অব্যাহত রাখছি। আমরা শিখছি, আইন না মেনে,দেশের ক্ষতি করে, অন্যায় করে, অন্যকে ঠকিয়ে, হারাম উপার্জন করেও ধর্মচর্চা করা যায়। দেশের প্রতি কোনো কর্তব্য পালন না করে ষোলই ডিসেম্বর কিংবা ছাব্বিশে মার্চে সবুজ লাল পোশাক পরে বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে ‘চিল’ করেও দেশপ্রেমিক হওয়া যায়।
আমরা হয় পাকিস্তান, নয় ভারতকে ঘৃণা করতে শিখছি। জানছি, এই ঘৃণাই হচ্ছে দেশপ্রেম। ক্রিকেট দিয়ে এই দেশপ্রেমকেপুষ্ট করা হচ্ছে। আমরা নিজের দেশেরমানুষকেও ঘৃণা করতে শিখছি। শিখছি এই দেশে বাস করে, একদল ভারতপ্রেমী বা পাকিস্তানপ্রেমী। আমাদের প্রতিপক্ষকে এমনভাবে ঘৃণা করতে শেখানো হচ্ছে যে, তাদেরকে এই দেশ থেকে মুছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছি। আমাদের এমন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আমরা প্রতিনিয়ত নাকাল হচ্ছি। ভাঙ্গা রাস্তায়, ডাস্টবিনের গন্ধের পাশে, অনড় জ্যামে, সিএনজি, মোটরসাইকেল, রিকসা, বাসের ঘামে জীবনটাকে একটা যন্ত্রণাময় উপহাস করে তোলা হয়েছে।
একটা বিভ্রম দিয়ে দেশটা গড়ে তোলা হয়েছে। শেয়ার বাজার ধ্বংস করে, ব্যাংকিং খাতসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রুগ্ণ বানিয়ে, সকল প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকিকরণ করে, দেশের উন্নয়নের সকল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন আর্থিক উন্নয়নের ধারাপাত শোনানো হচ্ছে। দেশের উৎপাদনমুখী সেকেন্ডারি ইকনমিকে মজবুত না করে, দেশকে একটা ট্রেডিংয়ের দেশে পরিণত করা হচ্ছে। দেশের কাঁচামাল দেশের বাইরে গিয়ে, পণ্যে রূপান্তরিত হয়ে, সেই পণ্য ডলারের বিনিময়ে আমদানি করে একটা ভোক্তামুখী বাজার গড়ে তোলা হয়েছে।
এখানে চাকরির বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেক কষ্টে স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর যোগ্যতা নিয়ে সর্বোচ্চ চাকরির সম্ভাবনা হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি। যা দিয়ে তিনজনের পরিবার চালানোর কোনো সুযোগ নাই। এসব চাকরির কাজ হচ্ছে: চাইনিজ বা ইন্ডিয়ান মাল মার্কেটিং করা। অথবা টুকটাক ফুটফরমাইশ খাটা বা অল্প কিছু টুকটাক টেকনিকাল কাজ করা। যেই চাকরিতে সে পরিষ্কার বুঝতে পারবে, তার যে যোগ্যতা, তার যে শিক্ষা তাতে তার আগামী ১০ বছরে, কোনো দক্ষতা অর্জন এবং বেতন বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই।
এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে আছে আদম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। সরকারি হুমকি-ধমকি উপক্ষো করে তারা বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লোক পাঠানোর কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছে। তাদের হাত ধরে সর্বস্বান্ত হয়ে লক্ষ্মীন্দরের মতো সাগরে ভাসতে ভাসতে দেশের সোনার সন্তানরা কোনো তীরে পৌঁছতেও পারেন, আবার গণকবরে, কিংবা বিদেশের জেলেও ঠাঁই পেতে পারেন।
এমন একটা সমাজে বানানো হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনে হেয়ারস্টাইল, ফ্যাশন, কুলনেস, চুলের জেল, শ্যাম্পু, সাবান, বডি স্প্রে, পারফিউম, সর্বাধুনিক সব গ্যাজেটের সমারোহ সব কিছু দিয়ে এক স্বপ্নময় জগতের হাতছানি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে স্বপ্নহীনতায় এক অলীক ব্যবস্থায় সবাইকে পিষে মরতে হচ্ছে। যুবরা বিয়ে করতে পারছে না। পিতামাতা অসুস্থ হলে কোনো সাহায্য করতে পারছে না। বেশিরভাগ যুব স্বপ্নহীন, সম্ভাবনাহীন জীবনকে ধারণ করছে, কিন্তু সেই জীবন থেকে মুক্তির কোনো উপায় তার চোখের সামনে থাকছে না।
এই হতভাগাদের যা আছে তা হলো ফেসবুক। ক্রিকেটে কিছু বিজয়। আছে নেশার উপকরণ। আছে এফএম রেডিও। এভাবে একটা স্বপ্ন ও সম্ভাবনাহীন প্রবৃত্তিসর্বস্ব জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করা হচ্ছে। যারা যে কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলে, মেয়েদেরকে নিপীড়ন করে, বাসে বা ভিড়ে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়। যে তার প্রিয় খেলোয়াড়ের বোন, কিংবা বউ, এমনকি প্রিয় বন্ধুর বোনের ছবিতেও লেখে, ‘মালটা ভালো’। যাদের কাছে নারী মানেই মাল। এর বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না। সেই শিক্ষা, সেই মূল্যবোধ, সেই মানসিক স্থিরতা যে তার নেই। ক্রমাগত বঞ্চিত ও নিগৃহীত হতে হতে, সে নিজে যখন নিপীড়ক হবে, তখন সে এর মধ্যে কোনো অপরাধ দেখবে না।
এমন একটা ব্যবস্থা কে বা কারা বানালো, কীভাবে বানালো, কেন বানালো, এর শেষ কীভাবে হবে—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে মাথাটা কেমন বিগড়ে যায়! নিজেকে পাগল পাগল লাগে!