একাত্তরের পর বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে আর কোনো ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ বুদ্ধিজীবী জন্মেছেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আশির বা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যদিও খুবই অল্প কয়েকজনকে মাঝেমধ্যে নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গিয়েছে, নতুন শতাব্দীতে সেই সংখ্যা যেন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
Published : 13 Dec 2023, 10:48 PM
‘বুদ্ধিজীবী’ বা ইংরেজি ‘Intelligentsia’ শব্দটির নানাবিধ ব্যাখ্যা বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গিয়েছে। তবে, সাধারণভাবে মনে করা হয় বুদ্ধিজীবী হলো সমাজের শিক্ষিত অংশের মানুষকে নিয়ে গঠিত এমন একটি সম্প্রদায়, যারা জনমত, রাজনীতি ও মূল্যবোধকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি শুনলে যে সৌম্যকান্তি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন, শ্বেত-শুভ্র চরিত্রের মানুষের চেহারা বা অবয়ব ফুটে ওঠে, তিনি তথাকথিত বৈষয়িক বিষয়ে উদাসীন এবং মূলত জ্ঞানচর্চাকেই জীবনের প্রধান আরাধ্য বিষয় বলে মনে করেন। এমন মানুষ সাধারণত পারিপার্শ্বিক নানা বিষয়ে খুব একটা বিচলিত হন না। তবে, সারাজীবনের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে সঠিক সময়ে সঠিক দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য বা মতামত দিয়ে যেকোনো গভীর সংকটের সহজ সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারেন। আর এই অনন্য গুণের জন্যই বুদ্ধিজীবীদের সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে মনে করেন। তারা হয়ে ওঠেন ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বিভিন্ন সময়ে জন্ম নিয়েছেন এমন অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, যারা ক্রান্তিকালে যথার্থ এবং কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। তাদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতি, অর্থনীতি বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না থাকলেও যেকোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সংকটের সময় নিজের মেধা ও মননের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কখনো তা করতে গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছেন, প্রাণও হারিয়েছেন। এমনই সহস্রাধিক ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে।
একাত্তরে যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় সেখানে কে ছিলেন না? ওই সময়কার পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ এমন কোনো পেশার গুণী মানুষ ছিলেন না, যারা রাজাকার, আল-বদরের নৃশংসতার শিকার হননি। একটি জাতির প্রায় সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেধা ও মননশীল মানুষগুলোকেই সেদিন বেছে বেছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল। যাতে করে তারা তাদের রচনাবলি, প্রবন্ধ, গানের সুরে, পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল বা রাজনীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে রাখার সুযোগ না পান। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে চিরঅন্ধকারে ডুবে যায় স্বাধীন বাংলাদেশ।
পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর এদেশীয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের ওই পরিকল্পনা যে অনেকাংশেই সফল হয়েছিল তা বলা হয়তো বাহুল্য হবে না। সত্যিকার অর্থেই দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধকারে ডুবে আছে প্রিয় স্বদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় তারা ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ ছিলেন কারণ তাদের বেশিরভাগই নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতেন না। সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে জাতি তথা সাধারণ মানুষের জন্য সর্বোত্তম যে পথ, সেটিই বাতলে দেয়ার চেষ্টা করতেন তারা। কিন্তু, তাদের হারিয়ে ফেলার পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে আর কোনো ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ বুদ্ধিজীবী জন্মেছেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আশি বা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যদিও খুবই অল্প কয়েকজনকে মাঝেমধ্যে নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গিয়েছে, নতুন শতাব্দীতে সেই সংখ্যা যেন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। কখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে ছদ্মনামে নতুন সামরিক শাসন, কখনো রাজনীতি বা রাজনীতিবিদদের সাধারণ জনগণের কাছে অপাংক্তেয় করে তোলার চেষ্টা, কখনো ষড়যন্ত্র-আঁতাতের মাধ্যমে যুদ্ধপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টা হয়েছে। কখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হাস্যকর প্রক্রিয়ায় পরিণত করা, কখনো আন্দোলনের নামে নির্বিচার মানুষ হত্যা এবং রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ ধ্বংস, কখনো রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার নাম করে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। কখনো শ্রমিক-মেহনতী মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করা, পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যক্রমের সাম্প্রদায়িকীকরণ, আবার কখনোবা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি মৌলিক অধিকার পাওয়া থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা— এমন অসংখ্য সংকট ও বিপর্যয় মোকাবিলা করে চলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এসব ঘটনার কোনোটির সময়ই এমন কোনো বুদ্ধিজীবীকে পাওয়া যায়নি যিনি শতভাগ নিরপেক্ষতার সাথে সঠিক ও ন্যায্য কথাটি প্রকাশ্যে উচ্চারণ করার সাহস দেখিয়েছেন। যারাই যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন তারা সবাই নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শ বা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই তা দিয়েছেন।
বর্তমানে এই সংকট যেন আরও ঘনীভূত হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের নামের পাশে আশ্চর্যজনকভাবে ‘পন্থী’ বিশেষণটি যুক্ত হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে কোন বুদ্ধিজীবী কী বিবৃতি দেবেন তা তাদের ‘পন্থী’ পরিচয় দিয়েই সাধারণ মানুষ বুঝে নিতে পারেন। যিনি যেই রাজনৈতিক আদর্শ বা দলের অনুসারী, সেই আদর্শ বা দলের সর্বোচ্চ সুবিধা হয় এমন মতামতই তিনি নির্দ্বিধায় দিয়ে দেন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোনো মতামত বা পরামর্শ দিতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আরও কিছু ‘অবুদ্ধিজীবীসুলভ’ ভয়াবহ প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই আছেন যারা নিজের প্রতিভা বা সৃষ্টিকর্ম নিয়ে এতটাই বিমোহিত থাকেন যে অন্য কারও কোনকিছু তাদের কাছে ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে তাদের এ প্রবণতা আরও প্রকট হয়ে সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে। ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ শব্দ দুটির চাইতে তাদের কাছে ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দযুগল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। ফলে, একটা সময় গিয়ে তারা যত ভালো কথাই বলুন না কেন, মানুষ আর তাতে কর্ণপাত করে না। আবার এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন যারা মানুষের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার চাইতে দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনকেই বেশি উচিত কাজ বলে মনে করেন। তাদের কাছে ‘মানুষ’ নয়, দলপ্রধান বা তার পছন্দের পাত্র হওয়াটাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এমন সব প্রবণতা ও আচরণের জন্যই বর্তমানে আর ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ বুদ্ধিজীবী বলে কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। এটিই স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশের প্রধানতম সংকট বলে মনে হয়। কেননা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তথা জাতিকে জাগিয়ে রাখার জন্য যাদের সর্বদা সজাগ থাকার কথা, তারাই যদি ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে প্রয়োজন পড়লে আরও একটি একাত্তর ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই, দরকার সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত, নির্লোভ, নির্মোহ, প্রচারবিমুখ কিন্তু শতভাগ ন্যায়নিষ্ঠ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। তাহলেই হয়তো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতো আবারও আমরা দেখতে পাবো ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ বুদ্ধিজীবী।