সরদার স্যারের জন্মদিনে

৮৯ বছরের যাপিত জীবনে তিনি ‘জীবন’ নিয়ে ভেবেছেন যতটা, মৃত্যু নিয়ে ভেবেছেন অনেক কম। শেষ বয়সে এসেও তাঁর প্রিয় উক্তি ছিল: ‘জীবন জয়ী হবে।’ জীবনকেই তিনি মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 1 May 2023, 06:48 AM
Updated : 1 May 2023, 06:48 AM

ছোটোখাটো একজন মানুষ। চোয়াল ভাঙা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কোটরাগত চোখ। আস্তে আস্তে ভেবে কথা বলেন। বলেন যত, বিরতি দেন তার চেয়ে বেশি। আপাদমস্তক একজন ভাবুক কিসিমের মানুষ। যেন একটি সুউচ্চ ন্যাড়া পর্বত। যার অন্তর জ্ঞান সম্পদে ঋদ্ধ।

হ্যাঁ, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শিক্ষক সরদার ফজলুল করিমের কথা মনে হলে এই উপমাটিই সামনে আসে। সরদার স্যার যেভাবে আমাদের ক্লাসে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পড়াতেন, তা অতুলনীয়। তেত্রিশ বছর পার হয়ে এসে এখনও মনে হয় সরদার স্যারের ক্লাসে বসে আছি। কী অবলীলায় তিনি আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিতেন! সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো। স্যার এমনভাবে তাদের চিন্তা-ভাবনা-তত্ত্ব-দর্শনের কথা বলতেন যেন, ওইসব চিন্তাবিদ সকলে স্যারের পরিবারের সদস্য। স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করেই তারা ওসব কথা বলেছেন বা লিখেছেন। থেমে থেমে ভেবে ভেবে নিচুস্বরে কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ় উচ্চারণে স্যার কথা বলতেন। নিজেই হারিয়ে যেতেন ওইসব মহান চিন্তাবিদের চিন্তার দিগন্তে। আমরা তারুণ্যের বেপরোয়া অস্থিরতা নিয়েও মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্যারের কথা শুনতাম। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি কতদিন। অথচ সরদার স্যারের ক্লাসের ওই কথাগুলো এখনো স্মৃতির পর্দায় অমলিন।

স্যারের প্রতিটি কথা ছিল লিখে রাখবার মতো। ভাবনার খোরাক। তিনি আমাদের সবসময় বলতেন, ভাব, চিন্তা কর, অনুসন্ধান কর। খোঁজ। কোনো প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দিতেন না। তাঁর সব কথা ছিল দার্শনিকতা বা চিন্তার ছাপযুক্ত। বলতেন সবই, কিন্তু গতানুগতিকভাবে নয়, একটু ঘুরিয়ে, দৃষ্টান্তসহ।

সরদার স্যার বলতেন, মনে রেখ, চিন্তা ছাড়া কোনোকিছু চিন্তা করার কথা চিন্তাও করা যায় না। কাজেই তোমরা প্রশ্ন কর, উত্তর খোঁজ, চিন্তা কর। এই যে আমি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো পড়াই— ওনারা কী বলেছেন? ওনারা প্রশ্ন করেছেন, প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আর এ জন্য চিন্তা করেছেন। তোমরাও ভাব, চিন্তা কর।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শোনা সরদার স্যারের কথাগুলো আজও কানের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়! সরদার স্যার ছিলেন আমার কাছে একেবারেই ভিন্নরকম একজন মানুষ। জাগতিক কোনো লোভ-মোহ নেই। ভাবনা-চিন্তা ও জ্ঞান সাধনা ছাড়া যার অন্য কোনোকিছুতে তেমন কোনো আকর্ষণ দেখিনি।

একবার দুর্নীতিবিষয়ক একটা লেখার প্রয়োজনে সরদার স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ার কারণে এবং স্যারের সরাসরি ছাত্র হওয়ার কারণে একটা জোর নিয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু স্যার খুব একটা পাত্তা দেননি। তিনি আমার উদ্দেশ্য জানার পর বললেন, ‘‘যার যেটা করার কথা, সেটাই ন্যায়। আর সেটা না করাটাই হচ্ছে অন্যায়। অন্যায়ই হচ্ছে দুর্নীতি। যেমন তুমি একজন ছাত্র। তোমার কাজ হচ্ছে ভালোভাবে লেখাপড়া করা। এখন তোমার ক্লাসে-সেমিনারে বা লাইব্রেরিতে থাকার কথা। কিন্তু তুমি তা না করে আমার কাছে এসেছ। আমার পড়ায় তুমি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছ। এটাও অন্যায়। তার মানে তুমিও দুর্নীতি করছ।’’

এরপর আমি আর স্যারকে ঘাঁটাতে সাহস পাইনি। সরদার স্যার সবসময়ই সরাসরি কথা বলতেন। আমরা যখন সিলেবাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম তিনি বলতেন, ‘‘পুরো বই-ই সিলেবাস। আমি যা পড়িয়েছি, আর যা পড়াইনি, সবই তোমার সিলেবাস। যেকোনো বিষয়ে যেকোনো প্রশ্ন আসতে পারে। তোমরা সিলেবাস খোঁজ, সম্ভাব্য কি প্রশ্ন হতে পারে, সেগুলো খুঁজে বের কর। উত্তরগুলোও অনুসন্ধান কর।’’

সরদার স্যারের কথাবার্তার ধরনই ছিল এ রকম। তিনি সবার মধ্যে প্রশ্ন করার, নিজে নিজে প্রশ্নের উত্তর বের করার, সবার মধ্যে এক ধরনের অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টির তাগিদ দিতেন। সবার মধ্যে জানা-বোঝার একটা বোধ সৃষ্টির চেষ্টা করতেন। সরাসরি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতেন না। কোনো প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে উল্টো প্রশ্ন করতেন, ‘‘তোমার কী মনে হয়? তোমার উত্তরটা আমি জানতে চাই। আজকে না হলেও এক সময় এসে আমাকে তোমার ভাবনাটা বলে যেও।’’

তিনি সারাক্ষণ একটা জ্ঞানের জগতে, আত্মমগ্ন ভাবনার জগতে বিচরণ করতেন। কথা বলতেন খুব আস্তে আস্তে, ছোট ছোট বাক্যে, অল্প কিছু শব্দে। তিনি কিছু শব্দের ওপর খুব জোর দিতেন।

একদিন ক্লাসে এসে স্যার খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেন। তারপর শুরু করলেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ দিয়ে। বললেন: ‘‘আজ সকালে আমার মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছে, তোমার সন্তান হয়ে আমি জীবনে কী পেয়েছি? তুমি আমাকে কী দিয়েছ? উত্তরে আমি বলেছি, আমি তোমাকে জীবন দিয়েছি!’’ এরপর তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘‘বাবা-মা সন্তানকে জীবন দান করেন। এর চেয়ে বড় জিনিস আর কী হতে পারে?’’

বলতে দ্বিধা নেই, ওইসময় স্যারের কথাগুলো আমাদের খুব একটা ভালো লাগত না। কেমন খাপছাড়া, ভারী ভারী দার্শনিক কথাবার্তা। তখন আমরা আসলে স্যারের কাছে এমন কিছু চাইতাম, যাতে আমাদের পরীক্ষায় কাজে লাগে। যেন খুব সহজে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেতে পারি! যুগ যুগ ধরে শিক্ষকদের কাছে ছাত্রছাত্রীরা যা চায়, আমরাও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না!

কিন্তু জীবনের এই পর্বে এসে ভাবি, সত্যি, স্যারের কথাগুলো কত দামি, কত মূল্যবান ছিল! স্যারের বেশিরভাগ কথাই ছিল উদ্ধৃতি হওয়ার মতো। এখন আক্ষেপ হয়, যদি স্যারের কথাগুলো রেকর্ড করে রাখতে পারতাম!

সাংবাদিকতা জীবনে স্যারের সাক্ষাৎকারের জন্য বিভিন্ন সময় শ্যামলী ও রাজাবাজারের বাসায় গেছি। স্যার সাক্ষাৎকার দিতে চাইতেন না। বলতেন, আমি নিজেকে কোনো ‘কোটেট পারসন’ মনে করি না। সাক্ষাৎকার চাইলে তুমি কোনো বুদ্ধিজীবীর কাছে যাও।

আমি জিজ্ঞেস করেছি, স্যার কোন বুদ্ধিজীবীর কাছে যাব? তিনি বলেছেন, ‘‘কেন দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন! তুমি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের কাছে যাও, খান সারওয়ার মুর্শিদ সাহেবের কাছে যাও!’’ স্যার সবসময় বলতেন, ‘‘তোমরা আমার কাছে আলাপ করতে এসো, গল্প করতে এসো। কিন্তু সাক্ষাৎকারের জন্য এসো না! আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। তোমাদের মতো আমার মনেও অনেক প্রশ্ন আছে। আমিও তোমাদের মতো প্রশ্নের জবাব খুঁজি।’’

‘আমি জানি যে আমি কিছু জানি না, কিন্তু এরা জানে না যে এরা কিছু জানে না’- গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের এই দৃষ্টিভঙ্গির ঘনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। তিনি প্রায়ই এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করতেন। তিনি নিজে যে কিছু জানেন না, এই কথাটি জোর দিয়ে বলতেন!

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি স্যারের ছিল অগাধ আস্থা। একদিন আলোচনা প্রসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর দুর্বলতা ও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথা বলায় স্যার বলেছিলেন, ‘‘সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এগুলো হয়তো ইউটোপিয়া। তবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম এবং আকাঙ্ক্ষা তাই সমাজতন্ত্র। গণতন্ত্রও তাই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বা অর্জনের জন্য যে আকাঙ্ক্ষা বা লড়াই তাই গণতন্ত্র। প্রকৃত গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র হয়তো ডুমুরের ফুল।’’

সরদার স্যার যাপিত জীবন নিয়ে সব সময়ই ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। পিতামাতাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছেন। বরিশালের আঁটিপাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী সরদার স্যার সর্বদাই নিঃসংকোচে বলতেন, “আমার দরিদ্র পিতা-মাতার দান করা জীবন নিয়ে এই পথটা হেঁটে এসেছি।”

৮৯ বছরের যাপিত জীবনে তিনি ‘জীবন’ নিয়ে ভেবেছেন যতটা, মৃত্যু নিয়ে ভেবেছেন অনেক কম। শেষ বয়সে এসেও তাঁর প্রিয় উক্তি ছিল: ‘জীবন জয়ী হবে।’ জীবনকেই তিনি মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “মানুষের মৃত্যুদিন হচ্ছে তাঁর সত্যিকারের জন্মদিন। মৃত্যুর পর যেকোনো ব্যক্তির পুরো পোর্ট্রেটটা আমাদের সামনে আসে। যেভাবেই মারা যান না কেন একজন ব্যক্তি, অসুখে-বিসুখে কিংবা কোনো আন্দোলন বা কোনো যুদ্ধে। মারা যাওয়ার পর জন্ম থেকে শুরু হওয়া সার্কিটটা তখন সম্পন্ন হয়। কাজেই আমরা যে জন্মদিবস পালন করি কেউ পঞ্চাশে, কেউ চল্লিশে বা ষাটে—এটা খুব একটা যথার্থ নয়। তখনো পর্যন্ত পুরো পোর্ট্রেটটা আমাদের সামনে নেই। আমার নিজেরও সার্কিটটা পূর্ণ হয়নি এখনো। এখনো কমপ্লিট হয়নি, তবে এখন এ বয়সে আমি পেছনের দিকে একবার তাকাতে পারি। লুক-ব্যাক। স্মৃতি আমার বেশ ভালোই আছে যদিও ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মনে নেই। বর্তমান বাংলাদেশের জিজ্ঞাসু যে প্রজন্ম, তাকে আমি কী দিতে পারি? আমি বড় পণ্ডিত নই, বড় প্রফেসরও নই, বড় গবেষক নই। তাঁরা বড় বড় সব প্রবন্ধ লেখেন জীবনের গতি, জীবনের ধারা, পরিবর্তন, পরিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে। এসব আমি তেমন কিছুই জানি না। এমন আমি, কী দিতে পারি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে? আমি দিতে পারি আমার জীবনটাকে।”

জীবনের শেষের দিকে এসে সরদার স্যার কিছুটা নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠেন। এ সময় যার সঙ্গেই দেখা হতো কিংবা যারাই তাঁর বাসায় যেতেন, তাদের সঙ্গে অনেক কথা বলতেন। নানা ব্যস্ততার ফাঁকে আমিও কয়েকদিন গিয়েছি। স্যারের কাছে সবসময়ই শুনেছি আকাশ ভাইয়ের (এমএম আকাশ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) নাম। পরিবারের সদস্যদের বাইরে আকাশ ভাই ছিলেন সম্ভবত সরদার স্যারের সবচেয়ে প্রিয়জন। এ ছাড়া আমার বন্ধু গোপাল সাহা (দর্শন বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি কলেজের শিক্ষক), শাহীন রহমান (কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও সাপ্তাহিক একতার নির্বাহী সম্পাদক), মশিউল আলম (সাংবাদিক, দৈনিক প্রথম আলো), শান্তনু মজুমদার (শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) সরদার স্যারের বিশেষ স্নেহধন্য ছিলেন। আলাপচারিতা ও লেখায়ও স্যার এদের নাম বলতেন।

সরদার স্যার সবসময় জীবনের জয়গান গেয়েছেন। লিখেছেন, ‘জীবন জয়ী হবে।’ মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছেন, “আমার মেয়ে ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই যত চেষ্টাই করুক না কেন মৃত্যু আমাকে নিতে আসবেই। মৃত্যুকে আমি পরোয়া করি না। মৃত্যু আমার কাছে জন্মের মতোই স্বাভাবিক!’’

সরদার স্যার ছিলেন একজন জ্ঞানসাধক। ছিলেন একজন প্রকৃত শিক্ষক তথা মানুষ গড়ার কারিগর। আজ শিক্ষার এই ভারসাম্যহীন সময়ে তাঁর মতো শিক্ষকের বড়ই প্রয়োজন। আমি ভাগ্যবান যে, সরদার স্যারের মতো একজন অলোকধন্য শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি।

আজ থেকে ৯৮ বছর আগে, ১৯২৫ সালের ১ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই মহান শিক্ষক, দার্শনিক, লেখক সরদার ফজলুল করিম।

সরদার স্যারের জন্মদিনে অনিঃশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি।