একদিন গোলাম আযম– প্রথম পর্ব

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকা সত্ত্বেও আইন উপেক্ষা করে গোলাম আযমকে আমির হিসেবে ঘোষণা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়।

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 24 Dec 2022, 02:28 PM
Updated : 24 Dec 2022, 02:28 PM

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গোলাম আযমকে তিনবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তবে তৃতীয় বা শেষবার দেখার অভিজ্ঞতাই হচ্ছে এ লেখার মূল উপজীব্য। সেটা হয়েছিল তার নিজের বাসাতেই।

প্রথমবার গোলাম আযমকে দেখি জামায়াত আয়োজিত এক জনসভায়। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সময়টা ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি হবে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাবার পর খুব সম্ভবত এটাই ছিল ঢাকাতে তার প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশ।

এর কিছুদিন পূর্বে ২২ জুন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্টের আপিল বিভাগের ৪ জন বিচারপতির সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সর্বসম্মতিক্রম রায়ের মাধ্যমে গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিক হন। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে যে চারজন বিচারপতি ছিলেন তারা হলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান, এ টি এম আফজাল, মুস্তাফা কামাল এবং লতিফুর রহমান।

১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রিয় কমিটির সভায় যোগদান করবার জন্য গোলাম আযম লাহোর যান। গোলাম আযমের লাহোর থাকাকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ ডিসেম্বর ভারতের কয়েকটি প্রধান শহরে একযোগে বিমান হামলা চালিয়ে বসেন। এর ফলে মুক্তিবাহিনীর সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

লাহোরে বসে আযম এটা বুঝতে পারেন যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের ফলে ঢাকার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ অবস্থায় তিনি তার নেতাকর্মীদের বিপদের মুখে রেখে নিজে পাকিস্তানে নিরাপদে থাকবার সিদ্ধান্ত নেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল আইন পাশ হয় এবং গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দালালদের নাম প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে গোলাম আযমের নাম ছিল ১১ নম্বরে।

দালালদের বিচার করবার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সে ট্রাইব্যুনালে যারা হাজিরা দিতে ব্যর্থ হয়, তাদের ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আদেশের ৩ ধারা অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৪২ জনের নাগরিকত্ব বাতিল হয়।

বাতিল হওয়া এ তালিকায় গোলাম আযম ছাড়াও ছিলেন খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম মেয়াদের ডেপটি স্পিকার হুমায়ুন খান পন্নী, চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আব্দুর রহীম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং পাকিস্তান রাজনীতির গবেষক গোলাম ওয়াহেদ চৌধুরীসহ অন্যান্যরা।

১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই অসুস্থ মাকে দেখবার কথা বলে পাকিস্তানি পাসপোর্টে ৩ মাসের ভিসা নিয়ে গোলাম আযম বাংলাদেশে আসেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর ওই বছর তিনি দু-বার মেয়াদ নবায়ন করেন। কিন্তু এরপরও তার ভিসার মেয়াদ নবায়ন বা তাকে নাগরিকত্ব প্রদান না করা হলেও তিনি অবৈধভাবে বাংলাদেশে থেকে যান।

জেনারেল জিয়া এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসক এরশাদ কেউ-ই এজন্য তাকে গ্রেফতার বা কারণ দর্শানোর নোটিশ দেননি। উল্লেখ্য, আরেক পলাতক জামায়াত নেতা মাওলানা আব্দুর রহীমকে জিয়া সরকার নাগরিকত্ব প্রদান করলেও গোলাম আযমের বিষয়টা ঝুলিয়ে রাখা হয়।

দেশ স্বাধীন হবার প্রাক্কালে মাওলানা রহীম পালিয়ে নেপাল চলে যান। জিয়ার শাসনামলে তিনি দেশে ফিরে আসলে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তিনি দেশে এসে বুঝতে পারেন যে, ১৯৭১ সালে জামায়াত যে ভূমিকা পালন করেছে, তাতে জামায়াতের ব্যানারে রাজনীতি করা সম্ভব হবে না।

রহীম তার এ উপলব্ধির কথা জামায়াত নেতৃত্বকে জানালে তাদের সাথে তার মতবিরোধ হয়। ফলে তিনি জামায়াত থেকে বের হয়ে যেয়ে ১৯৭৬ সালে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনিসহ ছয়জন তার দল থেকে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন।

প্রবল গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়া নির্বাচনে জয়ী হয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই ১৯৭১-এর ভূমিকার কারণে বিতর্কিত আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। ঠিক এ সময়েই মাওবাদী তরুণ কমিউনিস্ট, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শাফী ইমাম রুমীর মাতা জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে অভূতপূর্ব গণজাগরণ ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে রুমীর ভূমিকা নিয়ে ১৯৮৬ সালে জাহানরা ইমাম প্রকাশ করেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’। বইটি পাঠক সমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। বইটিতে শুধু ঢাকার একটি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতাই ফুটে উঠেনি, এতে ৭১ সালে ঢাকার অবস্থা কেমন ছিল তারও একটি নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে রুমীসহ তার পরিবারের ভূমিকা এবং যুদ্ধে তার শহীদ হবার বিষয়টি সে সময় অনকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

ক্ষমতায় এসেই একাত্তরের ঘাতক, দালালদের বিচারের দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে পড়ে বিএনপি। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকা সত্ত্বেও আইন উপেক্ষা করে গোলাম আযমকে আমির হিসেবে ঘোষণা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। গোলাম আযমকে গ্রেফতারের দাবিতে নির্মূল কমিটি সোচ্চার হয়।

প্রবল গণদাবির মুখে জিয়া এবং এরশাদ সরকার যে কাজটি করেনি বা করতে চায়নি খালেদা জিয়া সরকার সেটি করে। ১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ তারা গোলাম আযমকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে পাকিস্তান আমলে তিনি তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

বিএনপি কর্তৃক গোলাম আযমের গ্রেপ্তারে অনেকে অবাক হন। কেউ কেউ এরকমও ভাবতে শুরু করেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে এসে বেসামরিক ব্যক্তিত্ব খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কি তার রাজনৈতিক গতিধারা পরিবর্তনের কথা ভাবছে। কিন্তু খুব দ্রুতই বিএনপি স্পষ্ট করে দেয় যে, তারা তাদের অনুসৃত নীতি থেকে ভিন্নপথে যাচ্ছে না। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণ-আদালত অনুষ্ঠিত হবার পরপরই সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অজামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে।

গোলাম আযমের নাগরিকত্বের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত না নিয়ে তা আদালতের ওপর ছেড়ে দেয়। সরকার পক্ষ অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হকের মাধ্যমে আযমের নাগরিকত্বের বিরোধিতা করে। হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ নাগরিকত্ব প্রশ্নে বিভাজিত রায় দিলে সেটি বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরীর একক বেঞ্চে নেওয়া হয়। তিনি নাগরিকত্বের পক্ষে রায় দিলে সরকার এর বিরোধিতা করে আপীল বিভাগে যায়। সেখানে চারজন বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে গোলাম আযমের নাগরিকত্বের পক্ষে রায় দেন।

রায়ের মধ্যে দিয়ে চারজন বিচারপতি শুধু যে নাগরিকত্ব প্রদান করলেন তা-ই নয়, এর মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে গোলাম আযমের জামায়াতের আমির পদে নিয়োগের বৈধতাও দান করেন। তার জন্য প্রকাশ্যে রাজনীতি করবার পথ উন্মুক্ত করেন।

এর পূর্বে জামায়াতের অলিখিত প্রধান হিসেবে গোলাম আযম জামায়াত এবং এর ছাত্র সংগঠন শিবিরের নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলেও সেটি করা হতো অত্যন্ত গোপনে। ওই সমস্ত কর্মসূচিতে শুধু নিবেদিত কর্মীদেরই রাখা হতো। বস্তুত এ রায়ের পর থেকেই গোলাম আযম প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হন। জামায়াত একে বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে বিবেচনা করে।

আপীল বিভাগের চারজন বিচারপতি স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতকে সবচেয়ে বড় বিজয়ের স্বাদ দেন। তাদের রায়ে সেদিন বিএনপির অনেকেসহ জাতির একটি বড় অংশ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। এর বিপরীতে জামায়াতে ছিল উৎসবের আমেজ। দেশের নানা অংশে তারা তখন গোলাম আযমকে নিয়ে প্রকাশ্যে তাদের বিজয় উদযাপন করছিল। ঢাকাতে সেদিন আমার দেখা জনসভাটিও ছিল এরকমই একটি উদযাপনের অংশ।

জনসভার মঞ্চটি করা হয়েছিল বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের গেটের সামনে। আমি মঞ্চের বিপরীত দিক থেকে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো একটি দলের বিশাল জনসভা। প্রথমে বুঝতে পারিনি যে এটি জামায়াতের সভা। আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে বুঝলাম এটি কাদের সভা।

আমি উৎসাহী হয়ে হেঁটে এসে একেবারে মঞ্চের পাশে দাঁড়ালাম। সেখানে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম বিশাল জনসভার বিষয়টি শুভঙ্করের ফাঁকি। জনসভার পরিধি বায়তুল মোকাররমের গেট থেকে সিপিবির অফিস পর্যন্ত হলেও আগত কর্মীরা কয়েক হাত দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন, যাতে দূর থেকে দেখলে একে বড় জনসভা মনে হয়। আশি এবং নব্বই দশকে জামায়াত এবং শিবির তাদের মিছিল এবং জনসভাগুলিকে বড় দেখাবার জন্য এ ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতো।

মঞ্চের পাশে এসে দেখলাম গোলাম আযম মঞ্চে বসে আছেন। মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ ধরনের কালো টুপি পরা। একটু পরে তিনি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেন। উল্লেখ্য, সেসময় গোলাম আযম, আব্বাস আলী খানসহ বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতৃত্বের বক্তৃতা করবার ধরন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতাদের চেয়ে ভিন্ন ছিল। এ দুটো দলের নেতাদের আবেগতাড়িত বক্তব্যের বিপরীতে জামায়াত নেতারা বক্তৃতা করতেন অনেকটা সেমিনারে বক্তব্য দেয়ার মতো, আবেগ বর্জিত হয়ে ধীরে সুস্থে।

গোলাম আযমকেও দেখলাম সেভাবেই বলছেন, খুব শান্তভাবে, আস্তে ধীরে, যেন কোনো সেমিনারে কথা বলছেন। বক্তব্য শেষ করে তিনি মোনাজাত ধরলেন। তার কর্মীরা তার সাথে হাত উঠালেও দ্বিধায় পড়ে গেলেন আশেপাশে যেসব পথচারী এবং হকার ছিলেন তাদের অনেকে। তাদের কেউ কেউ মোনাজাতে সামিল হলেও বড় অংশটি বিরত ছিলেন। একজন অতি বিতর্কিত ব্যক্তির পরিচালনায় রাজনৈতিক মোনাজাতে সামিল হওয়াটা ঠিক হবে কিনা, এই বিবেচনাবোধ হয়ত তাদেরকে মোনাজাতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল। (চলবে)