তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতি পেলেও প্রেম ও প্রকৃতি তাঁর কবিতা ও গানে প্রবলভাবেই উপস্থিত। বিদ্রোহীর মনেও যে প্রেম আছে, তারও যে প্রিয়ার খোঁপায় তারার ফুল গুঁজে দিতে সাধ জাগে তা-তো নজরুলের রচনা পাঠেই জানা যায়।
Published : 25 May 2023, 12:13 PM
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমাদের মাতামতি কি শুধু জন্ম কিংবা মৃত্যু দিনে এসে সীমিত হয়ে পড়বে? কালজয়ী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির সৃষ্টিকর্ম নিয়ে যেভাবে আলোচনা হওয়া উচিত, যেভাবে চর্চা হওয়া উচিত তা কি সত্যি আমাদের দেশে হচ্ছে? আমরা সাহিত্যকে বেধে ফেলছি সংকীর্ণ চিন্তার জালে। নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েই আমরা ধরে নিয়েছি আমাদের আর কিছু করণীয় নেই। কেউ বলতে পারেন, তা কেন, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলে নজরুলকে নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। কেউ তো কাউকে বাধা দিচ্ছে না।
আচ্ছা, বেহুদা কথায় সময় নষ্ট না করে দেখা যাক, কাজী নজরুল আসলে কেমন ছিলেন? কী ছিল তার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এটা হয়তো সবারই জানা যে ১১ জ্যৈষ্ঠ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। বাংলা ১৩০৬ সনের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়ায় তাঁর জন্ম। নজরুলের বাবা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। নজরুলও একেবারে ছোটবেলায়ই মসজিদে মোয়াজ্জিনের কাজ করেছেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে ১৯০৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর নজরুলের পরিবার চরম অভাব-অনটনে পড়লে তাঁর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়, মাত্র ১০ বছর বয়সেই তাঁকে জীবিকার জন্য কাজে নামতে হয়। তাঁর ছোটবেলার ডাক নাম দুখু মিয়া। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছু করতে হয়েছে তাঁকে। লেটোর দলে কাজ করেছেন, রুটির কারখানায় কাজ করেছেন, সৈনিকের জীবনও বেছে নিয়েছিলেন। ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪৯তম বাঙালি রেজিমেন্টে হাবিলদার পদে চাকরি করেছেন। ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথাও অন্য কোনো খানে’ এই অস্থিরতা, চঞ্চলতাই যেন ছিল নজরুল জীবনের বৈশিষ্ট্য। কবি হিসেবে বেশি খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সম্পাদক ছাড়াও রাজনীতিতেও জড়িয়েছিলেন।
তিনি সৃষ্টিশীল ছিলেন ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। ওই বছরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসা ও চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয় জুড়ে ছিল কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ আগ্রহ ও চেষ্টায় নজরুলকে ঢাকায় এনে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে আসার পর কবির চিকিৎসা, যত্নআত্তির অভাব না হলেও তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। তাঁর মৃত্যু হয়েছে ঢাকায় বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র (২৯ অগাস্ট, ১০৭৬)।
মসজিদের পাশে তাকে কবর দেওয়ার কথা তাঁর একটি কবিতায় আছে। তাই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়েছে। এ থেকে কারও মনে হতে পারে যে নজরুল বুঝি খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন অথবা তার সাহিত্যের মূল উপজীব্য বুঝি ছিল ইসলাম ধর্ম।
না, নজরুল মোটেও ধর্মীয় কবি ছিলেন না। এটা সত্য যে তিনি হামদ, নাত, গজলসহ ইসলামী সঙ্গীত রচনা করেছেন, তার লেখায় আরবি-ফারসি শব্দও প্রচুর ব্যবহার করেছেন। আবার তিনি শ্যামা সঙ্গীত, ভজন, কীর্তনও লিখেছেন। হিন্দুদের দেব-দেবী তার লেখায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার একজন মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চায় তাঁর আগ্রহ দেখা যায়নি। ধর্মবিশ্বাস দিয়ে নয়, তিনি মানুষকে দেখতেন মানুষ হিসেবে। তিনি লিখেছেন: নদীর পাশ দিয়ে চলতে যখন দেখি একটি লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন ভাবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান, একজন মানুষ ডুবছে এইটেই– সবচেয়ে বড়ো, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে – মন বলে আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি।
ধর্মাচরণ নিয়ে তাকে বিদ্রুপ-গঞ্জনা কম সহ্য করতে হয়নি। আক্ষেপ করে তিনি বলেছেন: ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যাণ্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছাড়ার বাঁধন কাটতে বেগ পেতে হবে না। কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি,আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি। বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে ধূলোবালি, এতো ধোঁয়া, এতো কোলাহল উঠছে যে ওর মাঝে সামান্য দীপবর্তিকা নিয়ে পথ খুঁজতে গেলে আমার বাতিও নিভবে, আমিও মরবো।
নজরুল বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর। কিন্তু এরমধ্যে ৩৫ বছর ছিলেন জীবন্মৃত। তিনি তার কবিতায় বলেছিলেন: তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবো না, সারাদিনমান কোলাহল করি কারো ধ্যান ভাঙিবো না। - নিশ্চল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িবো একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।
১৯৪২ সাল থেকে ১৯৭৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেরকমই ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন মাত্র ২২ বছর। এই অল্প সময়ে তিনি কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস প্রবন্ধ কত কিছুই না লিখেছেন। অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নজরুলের জীবন ছিল একদিকে ছন্নছাড়া, অন্যদিকে ধূমকেতুর মতো।
'বিদ্রোহী' কবিতা লিখে তিনি প্রথম বাঙালি পাঠক মহলে আলোড়ন তৈরি করেন। তিনি এই কবিতায় নিজেকে তুলে ধরেই যেন লিখেছেন:
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির
গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা
বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার
কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর
প্রথম প্রকাশ কুমারীর!...
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ,
ভুমে রণিবে না, বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
এই কবিতায় তিনি যেমন ভৃগু ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছেন, তেমনি খোদার আসন আরশ ছেদিয়া ওঠার কথাও বলেছেন।
তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতি পেলেও প্রেম ও প্রকৃতি তাঁর কবিতা ও গানে প্রবলভাবেই উপস্থিত। বিদ্রোহীর মনেও যে প্রেম আছে, তারও যে প্রিয়ার খোঁপায় তারার ফুল গুঁজে দিতে সাধ জাগে তা-তো নজরুলের রচনা পাঠেই জানা যায়। নজরুলের কাছে দ্রোহ আর প্রেম অভিন্ন ছিল। তিনি বলেছেন: মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হতে রণতূর্য। কবির মনোভূমি ছিল প্রেমময়। তাঁর উদ্দাম জীবনে প্রেম এসেছে একাধিকবার। অনেক নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি তাদের প্রেম নিবেদনে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন কবি। প্রমিলা দেবীর সঙ্গে জুটি বাঁধলেও তিনি নার্গিস ও ফজিলাতুন্নেছার প্রেমে যে মশগুল হয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে।
নজরুলকে সাম্য ও মানবতার কবি বলা হয়। কারণ তার কলম থেকেই বেরিয়েছে: গাহি সাম্যের গান / যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।
অন্যায়, অসাম্যের বিরুদ্ধে, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধ তার কলম ছিল ক্ষুরধার।
তিনি লিখেছেন: মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান / নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি / সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
তার কলম থেকেই বেরিয়েছে: মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান /মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে / যেন রবি শশী দোলে / এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।
আবার সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সমান সোচ্চার। লিখেছেন: দেখিনু সেদিন রেলে / কুলি বলে এক বাবুসাব তারে টেনে দিল নিচে ফেলে / চোখ ফেটে এলো জল / এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
নজরুলের সময়ে তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ কিছু কম হয়নি। তাকে তুচ্ছ করার জন্য 'বালক প্রতিভা' বলা হয়েছে। অর্থাৎ তার পরিণতি আসেনি। কিন্তু যারা এসব করেছে তারা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে, নজরুল আছেন উজ্জ্বল দেদীপ্যমান। নজরুল বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন ও অকাতর স্নেহ পেয়েছেন।
১৯৪১ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি বলেছিলেন: ‘যদি আর বাঁশি না বাজে - আমি কবি বলে বলছি না - আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি - আমায় ক্ষমা করবেন - আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’
নজরুলের একটি গানের একটি পংক্তি:
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।
নজরুলকে সাম্প্রদায়িক কবি বানানোর একটি অপচেষ্টা বহুদিন ধরেই চলছে। পাকিস্তানি গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী সেটা করেছে, এখন বাংলাদেশেও একটি মহল তৎপর সেই ধারায়। এটা অন্যায়। খণ্ডিত নজরুল চর্চা নয়, অখণ্ড নজরুলই বাঙালির সেরা সম্পদ।
জন্মদিনে কবিকে বিনম্র শ্রদ্ধা।