শীতের দাপট ও রাজনৈতিক উদাসীনতা

শীতে মানুষ কষ্ট পাবে আর কেউ কেউ শহরে বসে লেপ-কম্বল-জ্যাকেট-সোয়েটার মুড়ে শীত উপভোগ করব, সেটা চরম অমানবিক। চরম শীতে দেশের যেসব জেলার মানুষ কাঁপছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ও কম্বলের ব্যবস্থা করা এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 16 Jan 2024, 02:48 PM
Updated : 16 Jan 2024, 02:48 PM

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে এবার দেরিতে শীতের আগমন ঘটলেও পৌষের মাঝামাঝি জেঁকে বসেছে হাড় কাঁপানো শীত। শীতের দাপটে বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ। প্রকৃতির নিয়ম মেনে আমাদের দেশে ফি বছর শীত আসে, আবার চলেও যায়, কিন্তু শীতকালে আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ যেন শেষই হয় না। প্রতিবছর কমবেশি একই চিত্র দেখা যায়। এবারও এরই মধ্যে শীতের তীব্রতা কোনো কোনো অঞ্চলে প্রকট হয়ে উঠেছে।

উত্তর জনপদে সূর্যের দেখা মিলছে না। দিন-রাত অবিরাম কুয়াশায় ঢেকে থাকছে পুরো এলাকা। কুয়াশার সঙ্গে মাঝে মধ্যে বইছে শুষ্ক শীতল বাতাস। প্রচণ্ড ঠান্ডায় মাঠ-ঘাট হয়ে পড়েছে জনশূন্য। হাট-বাজারে দোকান খোলা থাকলেও মিলছে না তেমন ক্রেতার দেখা। ফলে বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মূলধন খরচ করেই সংসার চালাতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রচণ্ড শীতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। কৃষিশ্রমিকরা সকাল সকাল মাঠে নামতে না পারায় তাদের আয়ও কমেছে। ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।

এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে ছিন্নমূল, অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা। হতদরিদ্র, প্রতিবন্ধী ও বস্তি এলাকার শীতার্ত মানুষের মাঝে সরকারি-বেসরকারিভাবে শীতবস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানের ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের। এ বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে দরিদ্রদের মাঝে যে ধরনের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে তা অপ্রতুল। একই সঙ্গে ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ শীতজনিত নানা রোগ দেখা দিয়েছে। বেশি সমস্যায় বয়স্ক ও শিশুরা। হাসপাতালগুলোয় এসব রোগীর সংখ্যাই বেশি।

আমাদের এই বৈষম্যকবলিত সমাজে অবশ্য এক শ্রেণির মানুষ আবার শীতের জন্য বছর ধরে অপেক্ষা করে। বিশেষ করে শহরের নাগরিকরা শীতকালকে খুব ভালোবাসে। তাদের কাছে শীতকাল পরম কাঙ্ক্ষিত। অল্প কয়েকদিনের জন্য শীতকালটা আসে। আর এই কয়েকটা দিন রং-বেরঙের সোয়েটার-জ্যাকেট পরা, কম্বল-লেপের তলায় উষ্ণতা উপভোগ। এর বাইরে তো সারাবছর গরম আর ঘাম! এই শ্রেণির কাছে শীত মানেই বনভোজন, বিয়েশাদী, ভ্রমণ আর পিঠাপুলির উৎসব। শীত মানেই আনন্দ, ফূর্তি ও পার্টি। শীতের সন্ধ্যায় হাই-পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন, টেনিস ও ভলিবল খেলা। পোড়া-মাংসের সঙ্গে ‘উত্তাপ-সঞ্চারী’ পানীয়তে বুঁদ হয়ে থাকা!

তবে শীতের অন্য রূপও আছে, যা আমাদের মধ্যবিত্ত চোখে অনেক সময় ধরা দেয় না। এই শীতে শহরের বা গ্রামের নিঃস্ব মানুষ যারা, একবেলা খাবারের ঠিক নেই যাদের, তারা কীভাবে শীতবস্ত্র পরিধান করবে এ সময়ে? তারা রাত কাটায় পথে-প্রান্তরে, তাদের শিশুদের নিজেদের বুকের ভেতর নিয়ে শীতের রাত পাড়ি দেয়। বৃদ্ধরা ধুঁকে ধুঁকে পাঞ্জা লড়ে নির্মম প্রকৃতির সঙ্গে। আফসোস হয়, যখন দেখি নিজেদের ভোগ-বিলাসিতায় একদল মানুষ লাখ লাখ টাকা খরচ করছে, সেখানে সমাজের আরেকদল মানুষ নিজেদের মৌলিক অধিকারটুকু পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র নীরব। রাজনৈতিক দলগুলোও নিশ্চুপ।

এ বছর শীত এসেছে যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে। এমনিতেই মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ দিশেহারা। সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। খেটে খাওয়া মানুষেরা জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে শীতের তীব্রতা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। শীতের সময় ঘর থেকে বের হওয়া খুবই কষ্টদায়ক। কিন্তু তার মধ্যেও সংসার চালাতে ও পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য কাজের সন্ধানে তাদের বের হতে হচ্ছে। এটা যে কী কষ্টের, তা বলে বোঝানো যাবে না!

রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছুটা কমলেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে। বিশেষত নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করে কিনা, তা নিয়ে একটা আশঙ্কা এখনও রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে গরিব মানুষগুলোর কী হবে? ক্ষুধা নিবারণই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে শীতবস্ত্র জোগাড় হবে কীভাবে?

এ কথা ঠিক যে, আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে কিন্তু এখনো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অতিদরিদ্র মানুষ উন্নয়নের মূলস্রোতের বাইরে রয়ে গেছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোটা যে এ মুহূর্তে প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এখনো পর্যন্ত শীতার্ত মানুষগুলোকে নিয়ে কারও মধ্যেই তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা রুটিনমাফিক কিছু কম্বল বিতরণের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন। অন্য সময় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কিছু তৎপরতা দেখা যেত, এবার তাও দেখা যাচ্ছে না।

সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে রাজনীতিবিদদের উদাসীনতা। আমাদের দেশে পাড়া-মহল্লার রাজনীতিবিদ ও তাদের অনুসারীরা পর্যন্ত কারণে-অকারণে এলাকাবাসী ও জনগণকে শুভেচ্ছা জানাতে রং-বেরঙের পোস্টার-ব্যানার ছেপে টাকার শ্রাদ্ধ করেন। কিন্তু শীতার্ত মানুষের জন্য একটু বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। নিজেদের টাকায় কিছু তো দেনই না, উল্টো সরকারি বরাদ্দ থেকে কীভাবে কিছু মেরে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করেন আন্তরিকভাবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের আখের গোছাতে যতটা আন্তরিক, মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘবের বেলায় ততটাই উদাসীন। আর বিরোধীদল তো আরেক কাঠি সরেস। পশ্চিমা দেশগুলো কবে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে সেই আশায় বসে থাকা আর মাঝেমধ্যে মুখরোচক বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান ছাড়া তাদের যেন কোনো কিছুই করার নেই!

আমাদের দেশটি এক আজব দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই যেন সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের বাইরে অন্য দলগুলোর তেমন কোনো অস্তিত্ব দেখা যায় না। এখানে নেতা মানেই যেন প্রভু আর সাধারণ মানুষ কেবল সেবাদাস, ভৃত্য! প্রভুদের জীবনে শীত স্পর্শ করে না, স্পর্শ করে রাজনীতি। এই রাজনীতিকে পুঁজি করে তারা সবকিছু বাগিয়ে নেন। ভোগ-লালসা, সুখ-সচ্ছলতা, আনন্দ-উৎসব সবকিছু। কিন্তু এই রাজনীতি ‘জনতারূপী ভৃত্য’দের স্পর্শ করে না। তাদের জীবনে শুধু শীত, কেবলই শীতের প্রকোপ। শীতের কষাঘাতে তাদের জীবন জর্জর। তাদের জীবনে গরম কাপড় বা উত্তাপের প্রস্তাব নেই। শীতে ‘বেড়াতে যাওয়া’ নেই, শীতের পিঠা-পায়েস নেই, নেই কোনো পিকনিক! কোটরাবদ্ধ ব্যাঙের মতো গুটিসুটি মেরে কোনোমতে দাঁতে দাঁত চেপে তাদের বেঁচে থাকা! সামান্য কিছু উপার্জনের ধান্দায় অহর্নিশ ঘুরে বেড়ানো! কিন্তু সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই!

বর্তমানে শ্রমজীবী ও স্বল্পআয়ের মানুষগুলো ভয়ানক কষ্টে আছে। অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। শীতে মানুষ কষ্ট পাবে আর কেউ কেউ শহরে বসে লেপ-কম্বল-জ্যাকেট-সোয়েটার মুড়ে শীত উপভোগ করব, সেটা চরম অমানবিক। চরম শীতে দেশের যেসব জেলার মানুষ কাঁপছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ও কম্বলের ব্যবস্থা করা এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ও সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমি, আপনি, আমরা সবাই যদি সচেতন ও উদ্যোগী হই, তবেই সম্ভব শীতের এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা। মানুষের বিপদের সময় তার পাশে থেকে সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা করাই মানুষের মূল ব্রত হওয়া উচিত। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একটি প্রাণ বাঁচে, একজন মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে, একটি শিশু উষ্ণতা পায়, তাতেই হয়তো জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

আরেকটি কথা, ‘সব ঠিকমতো চলছে, কোথাও কোনো সমস্যা নেই, কেউ শীতে কষ্ট পাচ্ছে না’ এই মনোভাব থেকে ক্ষমতাসীনদের বের হয়ে আসতে হবে। মাঠপর্যায়ের প্রকৃত অবস্থা জেনে তা ঊর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করতে হবে। সব মানুষ যেন শীতবস্ত্র পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল ‘কর্তাভজা কীর্তন’ গাইলে মানুষের কষ্ট লাঘব হবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের একটি পুরনো কৌতুক মনে করিয়ে দিতে চাই।

রাজা: শেয়ালগুলো ডাকছে কেন?

মন্ত্রী: শীতের রাত তো তাই।

রাজা: তাহলে ওদের রাজকোষ থেকে কম্বল দেওয়া হোক।

মন্ত্রী: জি হুজুর, আগামীকালই দেব।

পরের রাতে শেয়ালগুলো যথারীতি আবার ডাকা শুরু করে। এবার রাজা মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, মন্ত্রী! শিয়ালগুলোর ডাক থামেনি কেন?

মন্ত্রী: কম্বল পেয়ে ওরা হুজুরের শোকর-গুজার করছে।

তার পরের রাতে রাজা আবারও মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, মন্ত্রী, ওরা কত দিন শোকর-গুজারি ডাক ডাকবে?

মন্ত্রী: যত দিন ওরা আপনার দেওয়া কম্বল ব্যবহার করবে!