‘নিজে সৎ ও বিশ্বস্ত ছিলেন বলে অন্যের সততা ও বিশ্বস্ততায় আস্থা রাখতেন।’
Published : 28 Nov 2023, 06:05 PM
সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক ঘটনা নিজের ডায়েরিতে লিখে গেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। বিশেষ করে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিয়ে কমিটির সদস্যরা কী ধরনের বিতর্ক করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন, সেটি জানা যায় তাঁর ডায়েরি পড়ে।
সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি কতটা ‘সিরিয়াস’ ছিলেন, সে বিষয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, “অনেক সময়ে যে ধ্যান ধারণা, মত বা পন্থা জনপ্রিয় ছিল, তার বিরুদ্ধেও মোহাম্মদ খালেদ সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছেন। তবে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে নিয়েছেন। নিজের মত প্রকাশ করে বিবেককে শান্ত করেছেন। কিন্তু জিদ করে সেই মত ধরে বসে থাকেননি। অন্যরা যখন তার মত গ্রহণ করেননি, তখন বৃথা তা নিয়ে আর তর্ক করেননি। নিজে সৎ ও বিশ্বস্ত ছিলেন বলে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ অন্যের সততা ও বিশ্বস্ততায় আস্থা রাখতেন।” (মোহাম্মদ খালেদ, রাশেদ রউফ, বাংলা একাডেমি/২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৫)।
একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক খালেদ বলেছেন, “বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করার কথা বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই বলতেন। আমরা পৃথক একটা সংবিধান করব। সে জন্য আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা প্রতিশ্রুতিও ছিল। ড. কামাল হোসেন মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। মার্চে যেদিন ইয়াহিয়া খান সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করে নিয়েছিলেন সেদিন হোটেল পূর্বাণীতে যে বৈঠকটি হয়েছিল, সে বৈঠকের মধ্যেই সংবিধান নিয়ে গোপন একটা আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে এই নিয়ে আর কথা হয়নি। সবাই তখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু আসলেন। আসার পর বঙ্গবন্ধু তাড়াতাড়ি করে এই দায়িত্ব দিয়ে বললেন এবং বোধ হয় খুব মিনিমাম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর একটা উল্লেখযোগ্য সংবিধান রচিত হয়—বাংলাদেশের সংবিধান।” তবে পরবর্তীতে সংবিধানে যেসব কাটছাঁট হয়েছে, তা নিয়েও আক্ষেপ করেন মোহাম্মদ খালেদ। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৪)।
জন্ম, শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা
মোহাম্মদ খালেদের পৈতৃক আবাসভূমি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে। কিন্তু তাঁর জন্ম ভারতের বিহার প্রদেশের রাজধানী পাটনায়, ১৯২২ সালের ৬ জুলাই। বাবা আবদুল হাদী চৌধুরী তখন বিহার সরকারের অধীনে পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের রেজিস্ট্রার। সস্ত্রীক বসবাস করতেন পাটনায়।
অনেকের মতো তাঁরও শৈশব ছিল বর্ণিল। বড় বাংলোতে থাকতেন। সামনে বড় আঙিনা। আঙিনাজুড়ে ফুল ও ফলের বাগান। সেখানে খেলতেন বন্ধুদের সঙ্গে। কাছেই রেলস্টেশন। প্রায়ই চলে যেতেন সেখানে। একসময় তাঁরা পাটনার সেই বড় বাংলো ছেড়ে স্থায়ীভাবে সপরিবারে চলে আসেন গ্রামে রাউজানের সুলতানপুরে।
মোহাম্মদ খালেদের প্রথম পাঠ তাঁর পরিবারে। মা-বাবার কাছে। তারপর যখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়, তখন তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় পাটনার একটি স্কুলে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বাবা সপরিবারে চলে আসেন চট্টগ্রামে। ভর্তি করা হয় রাউজান আর. আর. এ. সি স্কুলে। স্কুলটির পুরো নাম রামগতি-রামধন আবদুল বারী চৌধুরী ইনস্টিটিউশন।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহ ও উপস্থিতির কারণে তিনি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় তিনি নাট্যাভিনয় ও আবৃত্তিতে বিশেষ পারদর্শিতা দেখান। খেলাধুলার আয়োজনেও তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯৪০ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৪২ সালে আই.এ পাস করেন। ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন । এজন্য ওই বছর ঢাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকায় তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছিল। তাই চট্টগ্রামে ফিরে বাবাকে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জানান যে তিনি ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান। বাবা ছেলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর জন্য মাসিক ৭৫ টাকা বরাদ্দ করেন। একসময় আলিগড়ের উদ্দেশে রওনা হন। তখন চলছিল ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। তিনি যখন আলিগড়ে পৌঁছালেন ততদিনে সেখানে ভর্তি শেষ হয়ে গেছে। ফলে আর ভর্তি হতে পারেননি। সময় নষ্ট না করে ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন সেখানকার ছাত্র।
ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় মোহাম্মদ খালেদের বাবা মারা যান। চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে পুনরায় ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আবার কলকাতায়। সেখানে গিয়ে এম.এ পড়ার উদ্যোগ নেন। যদিও বাবার মৃত্যুর কারণে সংসারে আর্থিক সংকট দেখা দিলে ছাত্র অবস্থাতেই খালেদকে নানারকম কাজ করতে হয়।
ইচ্ছে ছিল অর্থনীতিতে এম.এ পড়বেন। সেজন্য ভর্তি হতে গিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন প্রফেসর বেনীমাধব বড়ুয়া তাঁকে জানান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আজিজুল হক মুসলিম ছাত্রদের জন্য সেখানে ইসলামের ইতিহাস নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ খুলেছেন। প্রফেসর বেনীমাধবের পরামর্শে মোহাম্মদ খালেদ ভর্তি হন ইসলামের ইতিহাসে। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম.এ পাস করেন। ওই সময় তাঁর পড়ালেখায় সহায়তা করতেন মামা (পরবর্তীকালে শ্বশুর) ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক—মূলত যাঁর কারণেই মোহাম্মদ খালেদ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন
১৯৪৭ সালে এম.এ পাস করার পর মোহাম্মদ খালেদ চট্টগ্রাম শহরের মোমিন রোডে ‘ফ্রেন্ডস স্টোর’ নামে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালু করেন। এর পাশাপাশি বাঁশ ও বেতের ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করেন। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য না পাওয়ায় খুঁজতে থাকেন নতুন ব্যবসা, নতুন কর্মক্ষেত্র। নেমে পড়েন ক্লিয়ারিং-ফরওয়ার্ডিং ব্যবসায়। খাতুনগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এম খালেদ’ নামে একটি ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্সি। কিন্তু সেখানেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। শিক্ষকতা শুরু করেন নাজিরহাট কলেজে। রাউজান স্কুল ও জাহানপুর স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন।
মোহাম্মদ খালেদ গ্রিনলেজ ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট বিভাগে অফিসার হিসেবেও যোগদান করেছিলেন। এর মধ্যে আসে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে তিনি নির্বাচনি প্রচারে নেমে যান। নির্বাচনের ৪ মাস পর অফিসে গিয়ে জানতে পারেন কর্তৃপক্ষ তাঁকে লন্ডনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করেছিল। কিন্তু অনুপস্থিতির কারণে তিনি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরপর মোহাম্মদ খালেদ আবারও শিক্ষকতায় ফিরে যান এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
রাজনৈতিক জীবন
চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় মোহাম্মদ খালেদ প্রতিষ্ঠা করেন রাউজান ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশন। এ অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তখনও রাউজানে বিদ্যুৎ যায়নি। দারোগা বাড়ির বিস্তৃত উঠোনে সন্ধ্যায় গ্যাস লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করা হতো।
তখন থেকে ভারতের মুসলিম ছাত্র-জনতা টেকনাফ থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত একটি স্লোগান নিয়ে সংগ্রামে নামে। সেটি হলো ‘ভারত বিভাগ চাই’। মোহাম্মদ খালেদ এ আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। পরবর্তীকালে তিনি যখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বি.এ শ্রেণিতে পড়ার জন্য ভর্তি হন, তখন পরিচয় ঘটে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। এরপরে তৎকালীন অবিভক্ত ভারত ও অবিভক্ত বাংলার মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনের সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মুসলিম লীগের নির্বাচনি প্রচারের জন্য এক বছর পড়ালেখা স্থগিত রাখেন।
১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। সঙ্গে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মোহাম্মদ খালেদ যোগ দেন সেই দলে। ১৯৪৯ সালে থেকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ প্রায় সকল আন্দোলনে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তবে তাঁর আওয়ামী লীগে আসার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক অবদান ছিল। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।
অধ্যাপক খালেদ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধীরে ধীরে অনিবার্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি চট্টগ্রাম-৫ (জাতীয় পরিষদ ১৫৮) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯০০। মোহাম্মদ খালেদ পেয়েছেন ৬৩ হাজার ৪৩৩ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৫৭.৪৫ শতাংশ। ওই নির্বাচনে তিনি পরাজিত করেন পাকিস্তান জাতীয় স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে; তিনি মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা।
মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য চট্টগ্রামে যে পাঁচ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়, মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এই কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান ও এম. এ. মান্নান।
জেলা ও নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত হলেও একমাত্র অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন ওই কমিটিতে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত সদস্য। প্রথম পর্যায়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এ স্টিয়ারিং কমিটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়। তৎকালীন রেস্ট হাউস, জুপিটার হাউসে কমিটির বৈঠকে মূল সমন্বয়কারী হিসেবেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন মোহাম্মদ খালেদ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এম আর সিদ্দিকীর বাসায় যে বৈঠক করেন, সেখানেও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক খালেদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে তিনি দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি মুজিবনগর সরকারের তথ্য দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের উপদেষ্টা ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও ছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের শত আর্থিক কষ্টের মাঝেও অন্যদের কষ্টে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের সেনাবহিনী আত্মসমর্পণ করলে পরদিন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ শিরোনাম দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আজাদী’ প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ওই বছরের পয়লা এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। এই স্মারকটি গ্রহণ করে তাঁর পরিবার।
গণপরিষদে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের অধিকাংশই ছিলেন আইনের ছাত্র। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদা ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। তবে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত দুটি বিবেচনায় তাঁকে এই কমিটিতে যুক্ত করেছিলেন। প্রথমত কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় মোহাম্মদ খালেদকে তিনি দেখেছেন। তাঁর প্রতিভা তিনি হয়তো তখনই টের পেয়েছেন। এরপরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা তৈরি হয়। ভাষা আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। এই বাইরে একজন সৎ ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবে মোহাম্মদ খালেদের মাটিলগ্নতা, দেশপ্রেম এবং আইনের ছাত্র না হলেও দেশ ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান হয়তো বঙ্গবন্ধু বিবেচনায় নিয়েছেন। মোহাম্মদ খালেদ অবশ্য মনে করতেন যে, তিনি এই বিশাল কাজের যোগ্য ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু বলেছেন তাই এই কমিটিতে কাজ করেছেন। এজন্য তিনি গর্ব অনুভব করতেন।
একটি সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ খালেদ জানান, সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারটি পুরোপুরি ড. কামাল হোসেন নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি সংবিধানের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করতেন। পরে সেটির ওপর কমিটির সদস্যরা আলোচনা করতেন, মতামত দিতেন। বঙ্গবন্ধুও মতামত দিয়েছেন। তারপর তা সংবিধানের ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছে। মোহাম্মদ খালেদ মনে করেন, এই সংবিধান পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং এতে জনমত প্রতিফলিত হয়েছে। বলা চলে প্রশংসা করার মতোই হয়েছিল এই সংবিধান। (প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, সাখাওয়াত হোসেন মজনু-মর্জিনা আখতার, পৃষ্ঠা ৭৫)।
সংবিধান প্রণয়নের দিনগুলি: মোহাম্মদ খালেদের ডায়রি
সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক ঘটনা নিজের ডায়েরিতে লিখে গেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিলের ডায়েরিতে লিখেছেন: “খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির বৈঠক সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হল। ড. কামাল হোসেন উদ্বোধনী বক্তৃতা পড়লেন। কাজের সুবিধার জন্যে তারই তৈরি শাসনতন্ত্রের কপি পেলাম। বৈঠকে বিচারপতি মুনিম, আইন বিশেষজ্ঞ কদলপুরের জনাব এম. এ. কুদ্দুস ছিলেন। ঠিক হল জনসাধারণের মতামত চেয়ে পত্রিকায় দেওয়া হবে। কাল বিকেল ৫টা থেকে পরিচ্ছেদ অনুযায়ী আলোচনা শুরু হবে।”
পরদিন ১৮ এপ্রিলের ডায়েরিতে লিখেছেন, “বিকেল ৫টা থেকে খসড়া সংবিধান কমিটির বৈঠক শুরু হল। ১৮ (Preamble) প্রস্তাবনা থেকে আলোচনা শুরু হল। ইংরেজিটা নিয়ে প্রথম ব্যারিস্টার বাদল রশীদ পড়লেন। প্রথম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় লাইনে historic struggle-এ armed শব্দটি struggle-এর আগে যোগ দেওয়ার জন্য Sk. Abdur Rahman বললেন। Prof. N. Islam Chowdhury ও রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র শব্দ যোগ করতে বললেন। শেষতক armed বা সশস্ত্র শব্দটি struggle-এর আগে যোগ করতে সাব্যস্ত হল। ৩য় লাইনে attained-এর উপযুক্ততা সম্পর্কে Khondakar Moshtaque সাহেব প্রশ্ন তুললে সে হলে achieved শব্দ বসাতে সম্মত হল।”
সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিয়ে কমিটির সদস্যরা কী ধরনের বিতর্ক করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন, সেটিও জানা যাচ্ছে এদিনের ডায়েরিতে।
তিনি লিখেছেন: “মোশতাক সাহেব প্রশ্ন করলেন Democracy বললে Secularism বলার প্রয়োজন আছে কি না? তিনি বললেন Democracy itself, an institution. তাছাড়া Secularism বলে কোনো শব্দও অভিধানে নাই... Democracy মানে Secularism.
এ সময় তাজউদ্দিন সাহেব তাঁর স্বভাববশত (মুদ্রাদোষ?) হাতকে মুষ্টি করে মুখের কাছে নিয়ে (কথা বলার সময় তিনি তাই করেন, মনে হয় তাদের মুঠোটাকে যেন মাইক্রোফোন) হাসছিলেন। লক্ষণীয় দুজনের বিভেদ সব সময় ধরা পড়ে। একে অপরকে সূক্ষ্মভাবে মার দিতে সচেষ্ট।
সিরাজুল হক বললেন, We have heard Islamic Democracy. Basic Democracy. To avoid doubt and by way of abundant clarification and caution the word secularism should be included.
বিতর্কের ঝড় উঠল Democracy Process নিয়ে। এ বিতর্ক দীর্ঘস্থায়ী হল। আমিরুল ইসলাম বললেন: Socialism cannot be achieved by legislation Assemble can only guarantee. We are cheating the people. তাজউদ্দিন আর আমিরুল ইসলাম মনে হল যেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে Socialism আনতে চান। বিপ্লবের পথকে খোলা রাখতেই তারা আগ্রহী।
নুরুল ইসলাম মঞ্জুর বললেন, Socialism-এর সুনিশ্চিত কোনো সংজ্ঞা নেই। দেশে দেশে এর পার্থক্য রয়েছে। বিপ্লবকে পরিহার করে গণতান্ত্রিক পন্থায় আমাদের দেশের উপযোগী সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায়। আবু সাইয়িদ বললেন: সামন্তবাদের বিরুদ্ধে ধনতন্ত্রকে তার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রকে যেমন মুক্তির পথ হিসেবে বিপ্লব হিসেবে গ্রহণ করা হয় তখনই দেখা যায় সমাজতান্ত্রিক দেশও আবার ব্যক্তিগত মালিকানার পথ ধরেছে। তাই সমাজতন্ত্রই চরম লক্ষ্য হতে পারে না। তিনি শব্দ দুটোর পক্ষে মত দেন।
আমিরুল ইসলামের এক মন্তব্যের উত্তরে ড. কামাল হোসেন বললেন: Connotation of democracy is vast. Street corner meeting, co-operation refuse করা সবই democracy Process বাদ দিয়ে ৪র্থ লাইনে freedom শব্দের আগে rule of law বসাতে বললেন।”
মোহাম্মদ খালেদ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন: ২৯ এপ্রিলের বৈঠকেও সমাজতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক চলে। এদিন এই ইস্যুতে মোহাম্মদ খালেদ নিজেও কথা বলেন। তাঁর মতে, যে সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসনতন্ত্রকে সামনে রেখে দাবি তুলেছেন, তাদের ভুললে চলবে না যে, সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে, এর প্রতিষ্ঠাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে তারা প্রথম থেকেই Cadre বা কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করে, ওইসব দেশ, সংবিধান রচনা করেছে। অথচ আমাদের এরূপ মানুষ ও কর্মীর অভাব।
৮ অক্টোবর ১৯৭২ সংবিধান কমিটির রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন মোহাম্মদ খালেদ। এদিনের ডায়েরিতে লিখেছেন: “সন্ধ্যা ৬টায় গণভবন আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা আলাপ হল। ছবি উঠল, টেলিভিশনে দেখান হল। বঙ্গবন্ধু বললেন: I am today the happiest man. মানুষের জীবনে আর কী চাই। দেশ স্বাধীন হল, স্বাধীন দেশের সংবিধানে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।”
বাহাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন
মোহাম্মদ খালেদ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। ওই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৩। মোহাম্মদ খালেদ পেয়েছেন ৩২ হাজার ২৪৩ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৪৭.৭০ শতাংশ।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা করলে তিনি বাকশাল সরকারের চট্টগ্রাম গভর্নর নির্বাচিত হন। তবে গভর্নর হিসেবে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে পারেননি। নমিনেশনের পর তাঁদের ঢাকায় নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মোহাম্মদ খালেদ বলেন, “কথা ছিল ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুকে ডি.লিট পুরস্কার গ্রদানের অনুষ্ঠানে আমরা সবাই একসাথে যাব। এর পর দিন যে যার জেলায় চলে যাব এবং গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু আমাদের সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়নি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে ফেললো। সুতরাং আমি প্রশাসনিক দায়িত্ব কিছুই পাইনি। কিন্তু তারপরও বলব যে, আমাকে গভর্নর করা হল, এই কথাটি যখন কোর্ট বিল্ডিং-এ এসে পৌঁছেছিল, তখন তাদের মধ্যে বলাবলি হয়েছিল যে, এই লোকটাকে বশে আনা যাবে না। সুতরাং আমাদের একটু সংযতভাবে চলতে হবে।” (বাংলা একাডেমি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৬)।
অগাস্ট ট্র্যাজেডি
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট, যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সেদিন ঢাকায় এমপি হোস্টেলে অবস্থান করছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তিনি জানতেন না যে এত বড় একটা নৃশংস ঘটনা ঘটে গেছে। বলেন “হোস্টেলে ছিলাম। খুব আর্লি মর্নিং ৫/৬ টার দিকে একটা টেলিফোন আসে আমার এক বন্ধুর। ফরেন অফিসে চাকরি করতেন। তিনি বললেন যে, আপনার রেডিও আছে? আমি বললাম, এক ব্যান্ডের একটা রেডিও আছে। তিনি বললেন, তাহলে ওটা খোলেন। শুনতে লাগলাম, মেজর ডালিমের ঘোষণা। আমি বললাম, এটা কী কথা? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এটাই কথা। আপনার বাইরের অবস্থা কী? আমি বললাম, বাইরের দরজা-জানালা খুলিনি। তিনি বললেন, খুলে দেখেন তো। আমি দেখলাম, একদল রক্ষীবাহিনী লাইন করে দাঁড়ানো আছে। কয়েকটা ট্যাংক টহল দিচ্ছে। তিনি বললেন, একটু কসাসলি থাকবেন। যদি রক্ষীবাহিনী সারেন্ডার না করে হয়তো গোলাগুলি হতে পারে। গোলাগুলির ক্রস ফায়ারিং-এ ক্ষতিও হতে পারে। আর কিছু জানি না। আপনারা ওখানে থাকেন, দেখা যাক। এরপর তিন দিন সেখানেই থাকতে হয়েছিল, বের হতে পারিনি। আটকা ছিলাম।” (বাংলা একাডেমি, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৬)।
তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বা তাঁরা কি এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে পেরেছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক খালেদ বলেন, “তখন সম্পূর্ণ পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে যায়। দল তখন নিষিদ্ধ করে দেয়। আমি একা, প্রথম সারির নেতারা মারা গেলেন। বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কে কি করতে পারতাম, সবাই চুপ করে বসে আছি, কিছুই করার ছিল না।”
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের ছেলে মোহাম্মদ জহির বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের কালরাতে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বাবা গভীর মনোবেদনা নিয়ে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁকে গুটিয়ে থাকতে দেননি। পঁচাত্তর পরবর্তী বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের দুর্দিনে নেতারা ছুটে আসতেন বাবার কাছে। বাবা তাঁদের কখনো হতাশ করেননি। তাঁদের সাহস দিয়েছেন, বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে দলকে সুসংগঠিত করে নেতাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন।”
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক
মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন ইসলামিয়া কলেজে শেখ মুজিবের জুনিয়র। পরবর্তীকালে তাঁরা রাজনৈতিক সহকর্মী। দেশের জন্য একসঙ্গে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পটপরিবর্তনের পরে অনেকে রং ও আদর্শ বদলালেও মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন নিজের আদর্শে অবিচল। আমৃত্যু আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন।
মোহাম্মদ খালেদ ১৯৭২ সালের ৭ অক্টোবরের ডায়েরিতে লিখেছেন: “৪ তারিখ চাটগাঁ রওনা হলাম শফিউর রহমানের গাড়িতে। ৭ তারিখ বিমানে ফিরলাম। বিকেলে খসড়া সংবিধান কমিটির সভায় উপস্থিত হলাম। রেস্ট হাউসে যখন ফিরে এলাম তখন মাথার যন্ত্রণায় অস্থির। রাত পৌনে ৯টার দিকে বেয়ারা ছুটে এসে বলল: স্যার, বঙ্গবন্ধু আপনার রুমে আসছেন। এ অপ্রত্যাশিত ঘটনার উত্তেজনায় আমার মাথা ব্যথা ছুটে গেল। শার্টটা গায়ে চড়িয়ে কামরা থেকে বের হতেই শুনলাম তোফায়েল আহমদ (বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সেক্রেটারি) চিৎকার করলেন: খালেদ ভাই কোথায়? বঙ্গবন্ধু এসেছেন। এগিয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন: কি প্রফেসর, খুব তো ঘুমাচ্ছ! বললাম: স্যার ঘুম কোথায়? মাথার যন্ত্রণায় অস্থির। তিনি কামরায় ঢুকলেন, পেছনের দরজা খুলে বাইরে দাঁড়ালেন, তারপর চলে গেলেন। তাঁর সঙ্গে যাচ্ছিলাম, বললেন যাও, রুম খোলা, কাল দেখা হবে। তিনি চলে গেলেন।”
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী ব্যক্তিত্ব। শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান লিখেছেন, “নিয়মানুবর্তিতা তাঁর জীবনের এক বিশেষ গুণ। যে কোনো সভা-সমিতিতে তিনি সময়মতো হাজির হতেন। তিনি মানুষকে বড় করে দেখতেন। তাঁর কাছে সবাই যেন বড়।” (চেতনার বাতিঘর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, স্মারক গ্রন্থ/২০২২, পৃষ্ঠা ৭২)।
সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়ার ভাষায়, “জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি তাঁর (মোহাম্মদ খালেদ) ছিল অগাধ মমত্ববোধ। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সকল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানে-অনুষ্ঠানে তিনি ছুটে গিয়েছেন, সকলের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। অকপটে বলেছেন সত্য-সুন্দর আর মানবিক মূল্যবোধের কথা। সত্য যতো কঠিন কিংবা অপ্রিয় হোক তিনি অকুতোভয়ে বলেছেন এবং লিখেছেন।” (চেতনার বাতিঘর, পৃষ্ঠা ১৮২)।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, “অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বয়সে আমার চেয়ে বেশ বড় ছিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে সম্বোধন করতেন ‘স্যার’ বলে। অনেক প্রতিবাদ করেছি, কোনো কাজ হয়নি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেছেন, আপনি স্যারই তো। অথবা কিছু না বলে কেবল হাসির ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন। মুখের ভাবেই বিনয়ের পরাকাষ্ঠা ছিল। এ থেকে মানুষটিকে বোঝা যায়। তিনি স্বভাবতই বিনয়ী ছিলেন। সে-বিনয় নিজের অহংবোধকে একেবারেই ধূলিসাৎ করে দেয়। অথচ জীবনে তিনি যে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, তা সামান্য নয়। সংগ্রাম করে জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন তিনি। পোশাকে-আশাকে সর্বদাই ছিলেন সাধারণের একজন, কম দামি সিগারেটই খেতেন, রিকশায় চড়তে কুণ্ঠিত হতেন না। বয়সে কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠায় যে-ছোটো, তাকেও রীতিমতো সম্মান দেখাতেন। আর এসব কিছুই ছিল তার আন্তরিক, এর মধ্যে কোনো লোকদেখানো ব্যাপার ছিল না।”(প্রাগুক্ত)
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ইচ্ছে করলেই বিত্তশালী হতে পারতেন। গাড়ি-বাড়ি-সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু সে মোহ তাঁর কখনোই ছিল না। বরং সারাজীবন অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন। আমৃত্যু তিনি ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়েছেন। রিকশায় করে অফিস করেছেন প্রতিদিন। শ্বেত-শুভ্র পোশাকে সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু লালন করতেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ। অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ দরদ, সম্মানবোধ। (চেতনার বাতিঘর, পৃষ্ঠা ৫৮)।
অধ্যাপক খালেদ চট্টগ্রামের অনেক সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। নিরলস প্রচেষ্টা ও অবদানের জন্য অনেক সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। চট্টগ্রাম হিলভিউ সোসাইটিতে প্রতিষ্ঠিত নগরীর অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠার স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ অডিটরিয়াম স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট এই মিলনায়তনের উদ্বোধন করা হয়।
সাংবাদিক মোহাম্মদ খালেদ
১৯৫৮ সালে আইউব খান সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করলে সারা দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক তখন নিজের মেয়ের জামাই মোহাম্মদ খালেদকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। উপরন্তু তিনি তখন বেকার। আব্দুল খালেক তখন ‘কোহিনুর’ ইলেকট্রিক প্রেস পরিচালনা এবং সেখান থেকে বই পুস্তক প্রকাশ করছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো মাসিক ‘কোহিনুর’। কিন্তু আব্দুল খালেকের একার পক্ষে সব দিক দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। মোহাম্মদ খালেদ তখন শ্বশুরের সঙ্গে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে কাজ শুরু করেন।
১৯৫০ সাল থেকে থেকে ‘কোহিনূর’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। আব্দুল খালেকের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল চট্টগ্রাম থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করবেন। কিন্তু সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না। ‘কোহিনূর’ প্রেসে মোহাম্মদ খালেদের কাজ দেখে তিনি বুঝতে পারেন, খালেদ এতদিন পর তাঁর নিজের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাজ পেয়েছেন। একদিন তাঁকে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে মোহাম্মদ খালেদ তাঁকে অভয় দেন। পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক আজাদী’। আর এই পত্রিকার মাধ্যমে ঘুরে যায় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবনের মোড়। পুরোপুরি যুক্ত হয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের মৃত্যুর পরে দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ১৯৬২ থেকে আমৃত্যু তিনি আজাদীর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন আদর্শবান সাংবাদিক। সাংবাদিকতার নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। পরমতসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সংবাদ-প্রতিবেদন আর সম্পাদকীয় মন্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার দুরূহ কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করেছেন। সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে তিনি যেমন সত্যনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেছেন, তেমনি সম্পাদকীয় নীতিতে দেশের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্কের নীতির সম্মানজনক সঙ্গতি রক্ষা করেছেন। সংবাদ প্রতিবেদনে যার যা প্রাপ্য কিংবা পাওয়া উচিত, তা তিনি অকৃপণভাবে দিয়ে গেছেন এবং এর পাশাপাশি সম্পাদকীয় মন্তব্যে বিষয় কিংবা ঘটনাবিশেষের মূল্যায়নপূর্বক নির্দেশনা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ২০১১ সালে ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা’ চালু করে।
পরিবার
১৯৪৯ সালে আপন মামাতো বোন আমেনা বেগমকে বিয়ে করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। এই দম্পতির দুই মেয়ে ও চার ছেলে। তারা হলেন: ১. আনিকা খানম শিরিন (জন্ম ১৯৫৪), ২. আতিয়া বেগম শামীম (জন্ম ১৯৫৬), ৩. মোহাম্মদ জমির (জন্ম ১৯৫৮), ৪. মোহাম্মদ জহির (জন্ম ১৯৬৭), ৫. মোহাম্মদ মুনির (জন্ম ১৯৭১), ৬. মোহাম্মদ জোবায়ের (জন্ম ১৯৭৩)। সন্তানদের কেউ রাজনীতিতে যুক্ত হননি।
চতুর্থ সন্তান মোহাম্মদ জহির বাবার দেখানো পথে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘স্লোগান’ পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবদ্দশায় ১৯৯১ সালে। প্রথমে এটি ছিল মাসিক। পরে সাপ্তাহিক হয়।
মৃত্যু ও দাফন
মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। তবে অসুস্থতার জন্য মনোবল দুর্বল হয়নি। তবে বড় ছেলে মোহাম্মদ জমিরের দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে তিনি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ২০০৩ সালের ২০ নভেম্বর মোহাম্মদ জমির ইন্তেকাল করেন। সন্তানের মৃত্যুতে তিনি আরও ভেঙে পড়েন। তিনিও এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান সন্তানের মৃত্যুর ঠিক এক মাসের মাথায় ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর। পরপর স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন আমেনা বেগম। তিনিও শোকে মুহ্যমান হয়ে ২০০৫ সালের ২৫ জুলাই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুলতানপুরে গ্রামের বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হয়।