অকুস্থল গুরুত্বপূর্ণ না, বলা উচিত, ঘটনাচক্রে, ঘটনার জন্মদাতা সরকারি ছাত্র সংগঠনের একজন ছাত্রনেতা এবং অতীতেও তার পূর্বসূরিরা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, আর ক্ষমতা যতদিন নিরঙ্কুশ হবে, ততদিন সবসময়ই না ঘটালেও, মনস্তত্ত্বে ‘ধর্ষণব্যাধি’টা তাদের রয়েই যাবে!
Published : 07 Feb 2024, 02:18 PM
ঘটনা ১: আমি একজনকে চিনি, যার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ না থাকলেও তিনি ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের ধারক ও বাহক। ছাত্র জীবনে সরকারি ছাত্র সংগঠন করতেন। একজন নারী সহকর্মীর পিঠে একটা ট্যাটু দেখে তিনি তার পুরুষ সহকর্মীর কাছে অত্যন্ত অকথ্য এক মন্তব্য করেছিলেন। মন্তব্যটা স্বভাবতই ধর্ষকামীর! তার বিরুদ্ধে কিছু করা যায়নি৷ কেননা, তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠানের শক্তিমানদের অনুগত প্রমাণ করে ফেলেছেন ততদিনে এবং সেই শক্তির বলেই চলেছেন। শক্তিমানের পৃষ্ঠপোষকতার শক্তি কত ভয়ংকর, ভাবা যায়!
ঘটনা ২: আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। পড়ালেখার প্রায় শেষ দিকে। আমাকে এক সহপাঠী বলল, কী রে জাহাঙ্গীরনগরে পড়িস, তোর প্রেম-ট্রেম নিশ্চয়ই অনেকগুলো হয়েছে! আমি বললাম, কেন? জাহাঙ্গীরনগরে পড়লেই বুঝি অনেক প্রেম হয়! সে বলল, জঙ্গলেই তো মঙ্গল। আমি তার সঙ্গে আর কথা বাড়াইনি। সেই সহপাঠী পরে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে।
ঘটনা ৩: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের কী অবস্থা তা তো আপনারা জানেনই। এটা তাই ঠিক সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ঘটা ঘটনা নয়। ছেলেদের হলগুলোতে নবাগতদের বড়রা প্রশ্ন করে: ‘তোর ব্যাচে সবচেয়ে বড় বুক কার?’ নবাগতদের অধিকাংশ স্বভাবতই লজ্জা পায়। যে যত বেশি লজ্জা পায়, তাকে তত বেশি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। নবাগত চুপচাপ থাকলে তার জন্য বেনিফিট অব ডাউট হলো: ‘পরের দিন বুক মাইপা আইসা রাইতের বেলা এত নন্বর রুমে দেখা করবি। নাইলে খবর আছে কইলাম!’ এবং ফি-বছর এ চর্চা চলতেই থাকে।
পাঠক মনোরঞ্জনের জন্য সবচেয়ে খারাপ খবর এই যে, এসব ঘটনা শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে এমন না, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্রই ঘটে। ফলে এসব ঘটনার কোনো ‘একক শাখা’ নেই!
২.
আজকে আবারও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ধর্ষণের ঘটনা ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। ছাত্রলীগ যতটা না, জাহাঙ্গীরনগর ততটাই বেশি। ছাত্রলীগ এখন চাইলেই বলতে পারে, অভিযুক্ত মুস্তাফিজ সহি ছাত্রলীগার না, বহিরাগত অনুচর৷ অতীতে এমনটা বলেছে বৈকি! কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সুযোগ নেই। এই ছাত্র লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগরে সে ঢুকেছিল মেধাবী ছাত্র হিসেবে, বের হলো ধর্ষক ছাত্রনেতা হিসেবে! একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এ যে কত বড় লজ্জার! জাহাঙ্গীরনগরের জন্য মুশকিল হলো, যা কিছু হারায় গিন্নির কাছে ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ সাব্যস্ত হয়ে যায় কিংবা হয়ে ওঠে ‘নন্দ ঘোষ’! অথচ, ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু জাহাঙ্গীরনগর হলেও, ঘটক যে ছাত্রলীগের নেতা এবং এসব যে সারাদেশেই তারা ঘটায়, সেটা বলার মতো কাণ্ডজ্ঞান সমালোচকদের বিন্দুমাত্র আছে বলে মনে হয় না!
ইতোমধ্যেই ছাত্রলীগ ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করারও চিন্তাভাবনা করছে বলে মিডিয়া মারফত জানা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক্সপ্রেস গতিতে সিন্ডিকেট ডেকে অভিযুক্ত ছাত্র ও তার কয়েকজন সহযোগীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বহিষ্কার’ ও তাদের ‘সনদ স্থগিত’ করেছে। এছাড়াও, প্রশাসন আরও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো— বহিরাগত ও পোষ্যদের পাঁচদিনের মধ্যে আবাসিক হল ত্যাগ করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বহিরাগত ও পোষ্যরা বহাল তবিয়তে আছে এবং তাদের ব্যাপারে এর আগে তারা কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারেননি। নিজেদের বানানো নিষ্ঠুর ফাঁদে কী কলঙ্কজনকভাবেই না পা দিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!
আরও বিস্ময়ের হলো, পোষ্যদের অনেকেই সরকারি ছাত্র সংগঠনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদের ক্ষমতাবলে হলের সিট দখল ও সিট বাণিজ্যের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। জাবি প্রশাসনের বোধোদয় কোনোদিন হয়নি এ ব্যাপারে এবং ঘটনা কিছুদিন পর নিস্তেজ হয়ে গেলে আবারও তারা সেই একই বোধবুদ্ধিহীন মায়ার খেলা দেখেই হলের সিট বণ্টনের দায়িত্ব সরকারি ছাত্র সংগঠনের ওপরে ন্যস্ত করে চুপচাপ পা দুলিয়ে বসে থাকবে। অথচ, বিস্ময়করতম ঘটনা হলো, আবাসিক ভবনগুলোর আসন সংকটের ঘোষণা দিয়ে এই প্রশাসনই একটা নবাগত ব্যাচকে ভর্তি হওয়ার পর প্রায় একটা বছর অনলাইনে ক্লাস করিয়েছে এবং এই কৃতকর্মের জন্য তাদের ন্যূনতম কোনো লজ্জাবোধ বা আফসোসবোধ আছে বলে কোথাও শোনা যায়নি। বাধ্য হয়ে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলনে নেমেছে এবং তাদের চাপে পড়ে সেই প্রায় দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে যাওয়া ব্যাচটিকে প্রশাসন হলে ওঠার ‘আমন্ত্রণ’ জানিয়ে অশেষ সওয়াব হাসিল করেছে। কী করুণার সাগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!
৩.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যারাই প্রশাসনিক ‘ক্ষমতা’য় আসে, তারা অদ্ভুত মেনিফেস্টেশনে চলেন। এর আগে ছাত্র আন্দোলনের মুখে যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত অন্তত দুজন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকুরিচ্যুত না করে তাদের শুধু পদাবনতি দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করা হয়েছিল। আরেকজনের আবির্ভাব হয়েছে যার বিরুদ্ধে ছাত্রীকে শিক্ষক বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে যৌন নিপীড়ন করার অভিযোগ সয়লাব হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুই করেনি। তো এই যৌন নিপীড়ক ‘শিক্ষক’দের মধ্যে পূর্বতন দুজনই কলা ও মানবিক অনুষদের। ভাবা যায়, লিবারেল আর্টস পড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদের রুচির অবক্ষয় কতটা হয়েছে! বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই দুই শিক্ষকের একজনের বিভাগেরই শিক্ষার্থী আজকের এই ‘টক অব দ্য নেশন রেপিস্ট’! অবশ্য সেই ‘শিক্ষক’ যতটা না শিক্ষক, তার চেয়েও বেশি সমাদৃত পাণ্ডা হিসেবে, ভূমিদস্যু হিসেবে। আফসোস হলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এমন অঢেল অযোগ্য শিক্ষক দিয়ে সয়লাব হয়ে গেছে এবং এদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও নিয়োগকর্তা বিভিন্ন সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এভাবেই একটা সম্ভাবনাময় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় মৃত বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ, এর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এমন এক রোমান্টিক আবহে এই বিশ্ববিদ্যালয় ও তার ক্যাম্পাস নিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েন যেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্তর্হিত সবকিছুই খুবই আসমানী শান্তিতে চলছে। এবং এই রোমান্টিক নস্টালজিয়ার বদৌলতে সাম্প্রতিক ঘটনায় তারা এতটাই লজ্জিত ও বিব্রতবোধ করছেন যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেইসবুক) এ বার্তায় ভেসে যাচ্ছে: কর্মক্ষেত্রে মুখ দেখাতে পারছি না!
অথচ হলগুলোতে গণরুম সংস্কৃতি কাদের তৈরি, কারা অলিখিত টর্চারসেল তৈরি করেছে, র্যাগিং নামক মধ্যযুগীয় বর্বরতা কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে, কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের নামে প্রকৃতিবিনাশী সব প্রকল্পের ঢেকুর গেলে, কারা শিক্ষার্থীদের জীবনকে বিপদাপন্ন করে তোলেন রাজনৈতিক ও একাডেমিকভাবে, কারা শিক্ষক নিয়োগের নামে ভোটার নিয়োগ দেয়— তার সবকিছুই স্বচ্ছজলের মতো পরিষ্কার হলেও, আবেগসর্বস্ব ও আহ্লাদিত সিংহভাগ প্রাক্তন কদাপি আঙুল তোলেন না, এমনকি ন্যূনতম নিজেদের চিন্তা প্রয়োগ করে স্বচিন্তাকে ডিকনস্ট্রাক্ট/বিনির্মাণ করেন না। এমনকি র্যাগিংয়ের বিরোধিতাকারীদেরও ক্যাম্পাসের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকারক মনে করেন অনেকেই। আর অধিকাংশ প্রাক্তনই শুধু ‘কে কোন সরকারি দপ্তরে কাজ করেন’ কিংবা ‘কাকে ধরলে নিজের কাজ ক্রমভঙ্গ করে আগে সিদ্ধ করা যাবে’— এ নিয়েই জাবর কাটতে থাকেন। এখন সেই তারাই স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে মুখ দেখাতে পারছেন না বলে যেভাবে হায় হায় করছেন, তাতে এই মাজাভাঙা প্রাক্তনদের বিদ্যা-বুদ্ধির প্রতি নিন্দা না জানিয়ে পারা যাচ্ছে না।
৪.
আমি জানি, এমন অপ্রিয় সত্য কথা গিলতে অনেকেরই কষ্ট হবে। কিন্তু, সত্য হলো, আপনারা কথাবার্তা না বলতে বলতে এমনসব কর্মকাণ্ডের পরোক্ষ প্রশ্রয়দাতা হয়ে উঠেছেন। আপনাদের এই সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রথম টোটকা হলো, ভাসুরের নাম না নেওয়ার অপকৌশল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ কথা প্রযোজ্য জাহাঙ্গীরনগরের বাইরের যারা তাদের ক্ষেত্রেও। আপনারা জাহাঙ্গীরনগরের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু যে রাজনৈতিক সিস্টেম বা ক্ষমতাকাঠামো জাহাঙ্গীরনগরকে গ্রাস করেছে, সেই কাঠামোর ওস্তাদদের নাম না জপে আপনার মুক্তি নাই। যে ভাসুরকে ঈশ্বরতুল্য জ্ঞান করে পূজা শুরু করেছেন, তাকে মাথায় তুলতে থাকলে অবস্থা সর্বত্র এমনই হবে। বারবার কারা এই ঘটনা ঘটায় এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোথায় ঘটায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ না।
রাজনৈতিক শক্তি যেখানে সকল ক্ষমতার উৎস, সেখানে আপনি একদিকে সেই ক্ষমতাবানের পূজা করবেন আর আশা করবেন সবকিছু সুন্দর ও চমৎকার হয়ে যাবে, এই ভাবনাটা আরও বড় অন্যায়! ক্ষমতাসীন পার্টি, তার ছাত্র সংগঠন, দলদাস প্রশাসন— যুগের পর যুগ, সবসময় এরা প্রত্যেকটি ঘটনার পিলার স্টেকহোল্ডার। অন্যায়কারীকে শাস্তি দিলেও এদের চরিত্র বদলাবে না। ফলে, যখন সংকট আসে, তখন শুধু সংকটের পলেস্তারা খসে পড়ার দিকে না তাকিয়ে, কারা সেই দেয়ালটা ওঠানোর পর পলেস্তারা লাগিয়েছিল তাদের দিকে আঙুল তোলাটা জরুরি। এটা করতে না পারলে সংকট যাবে-আসবে, কিন্তু আপনার দুশ্চিন্তার পারদ কখনই নিম্নগামী হবে না।
৫.
এমন একটা ঘটনায়, কিংবা অতীতের আরও আরও এমন ঘটনায় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি সমস্ত মান-ইজ্জত ধুলায় মিশে যায়, তো এটাও মনে রাখা দরকার যে, একটা পক্ষ ছিল বা আছে, যারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার। আপনার আশেপাশে থাকা তাদের নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই গৌরববোধ করতে পারেন। ভাবতে পারেন, ঘোরতর অন্যায়ই শুধু জাহাঙ্গীরনগর না, ইনসাফ কায়েম করাও জাহাঙ্গীরনগর।
এই ইনসাফ ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের শিক্ষার্থীরা, যাদের কল্যাণে ‘ধর্ষণ’ শব্দটা সামাজিক এক ট্যাবুর ঘেরাটোপ ভেদ করে এখন জনসমাজের নিয়মিত উচ্চারণযোগ্য এক শব্দে পরিণত হয়েছে। সেই সময়ের শিক্ষার্থীদের সিংহহৃদয় আপসহীন মনোভাবের কারণেই বাংলাদেশ জেনেছিল ‘ধর্ষণ’কে ধর্ষণই বলতে হবে এবং আন্দোলনের মাধ্যমেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ইদানিংকালের ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের বিরোধিতা করলে আবেগসর্বস্ব কমিউনিটির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নিয়ে আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু, সেই ১৯৯৮-৯৯ সালে শিক্ষার্থীরা মনে করেছিলেন, এই বিরোধিতাই পারে ক্যাম্পাসের ভাবমূর্তি উন্নততর করতে। তাই পরবর্তী সময়, শুধু জাহাঙ্গীনগর না, সমগ্র বাংলাদেশের ইতিহাসেই সেই আন্দোলন মাইলফলক হয়ে আছে। সেই আন্দোলনেরই ফল মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের আদেশ জারি করা। সেদিন চুপ করে থাকলে পরবর্তী আরও আরও এমন ঘটনায় চুপ করে থাকার প্রবণতা তৈরি হতো। কিন্তু তা হয়নি। ছাত্রলীগের প্রবল প্রতাপ ও প্রশাসনিক ঐশীশক্তিকে উপেক্ষা করে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা সেদিন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন ছাত্রলীগের কুখ্যাত 'কিলার' ও 'রেপিস্ট' গ্রুপকে ক্যাম্পাস থেকে বিতারিত করে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে পূর্ণশক্তি দিয়ে পাশে ছিলেন প্রগতিশীল শিক্ষকরা, বাহবা তাদেরও প্রাপ্য।
১৯৯৮-১৯৯৯ সালের পর জাহাঙ্গীরনগরে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আন্দোলন ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ঘটা জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন। সেই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ ছাত্রদলের গ্রুপিংবাজি, যার শিকার জুবায়েরের মতো অনেকেই হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমবর্ষে। আর চার বছর পর সেই রাজনীতিরই রেশ ধরে জুবায়েরকে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগ নামধারী ‘ভিসিলীগে’র সন্ত্রাসীরা। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের আশেপাশে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ছিল কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে প্রথম রাজনৈতিক ছাত্র হত্যাকাণ্ডের বিচার। বিচার করতে বাধ্য করেছিল দুর্বার এক ছাত্র আন্দোলন। রাষ্ট্রীয় আইনে রায় এখনও কার্যকর হয়নি সেই হত্যাকাণ্ডের, এটাই সবচেয়ে হতাশাজনক কথা।
সাম্প্রতিককালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় দুটি ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, জাহাঙ্গীরনগর ঘটনাকে মোকাবেলা করে, চেপে যায় না। বাংলাদেশের সব জায়গাতেই ক্ষমতাকাঠামোর শক্তিমান লাঠিয়ালরা খুন, ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়, কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়তো তথাকথিত 'ভাবমূর্তি'র কথা চিন্তা করে চেপে যায় কিংবা ক্ষমতাবানরা ঘটনা ধামাচাপা দেয়। জাহাঙ্গীরনগর বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকাঠামোর বাইরের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ না, এমনকি বৈশ্বিক বিচারেও একই কথা খাটে। জাহাঙ্গীরনগরেও তাই বিশ্ব-রাষ্ট্র-সমাজের সমস্ত কলুষ লেগে আছে। কিন্তু, একটা বিশ্ববিদ্যালয় চৈতন্যগত জায়গা থেকে রাষ্ট্র-সমাজের অপরাপর জায়গাগুলো থেকে অনন্য হবে, এটা প্রত্যাশিত হলেও, সেই আদর্শিক জায়গায় আমরা যেতে পারিনি পুরো রাষ্ট্রব্যাপী। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই চেতনাগত জায়গা থেকেই জাহাঙ্গীরনগর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে। জাহাঙ্গীরনগরে কবরের মতো নীরবতা নেই। ফলে, এই প্রতিরোধপ্রত্যয়ী জাহাঙ্গীরনগর, যার কারণে আপনি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কুলকিনারা করতে পারেন, তাকে বাহবা দিন, তাকে নিয়ে গৌরববোধ করুন।
আর অবশ্যই, যারা ঘটনা ঘটায়, সম্পর্কসূত্রে যারা আপনার ভাসুর, তাদের নাম বলতে শিখুন। যে উদাহরণগুলো শুধু জাহাঙ্গীরনগর থেকেই দেয়া হলো এ লেখায়, একটু মাথা খাটালেই বুঝবেন, ঘটনাগুলোর কর্তা হলো কতিপয় শিক্ষক এবং সরকারি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা। নিজেকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিমান, অগণতান্ত্রিক, বেপরোয়া, দখলদার, নিপীড়ক, অত্যাচারী, ঔপনিবেশিক, হ্যাডমওয়ালা, দাসের প্রভু, পৌরুষেয় মনে করা ব্যক্তিরাই খুন ও ধর্ষণ করে। আপনার বুঝতে হবে, যারা এসব ঘটায় তারা সংখ্যায় সামান্য কিন্তু ক্ষমতায় অসামান্য। এই অসীম ও অসামান্য ক্ষমতাবানদের প্রতি প্রশ্ন তৈরি করাটা জরুরি। প্রশ্নহীন দ্বন্দ্ব ছাড়া যে সুন্দর-সুকুমার সমাজ আপনি দেখতে চান (আদৌ চান কি?), তা সম্ভব নয়।
৬.
লেখাটা শুরু করেছিলাম কয়েকটা ঘটনা দিয়ে। এগুলো হলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে যাওয়া পৌরুষচিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যাও বটে। আমাদের জন্য অশনি সংকেত হলো, রাষ্ট্র ও সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত অঞ্চলে এসব দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কারও দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক কারণে, কারও দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয় কারণে এমন। তার মানে শিক্ষা আপনাকে সেই আলোকিত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না, যা সকলের প্রতি সহানুভূতি-সমানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করাবে। এখন গলদ বের করতে হলে, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষাব্যবস্থা সবকিছুরই কান ধরে টান দিতে হবে। তাতেই কেবল মাথাটা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। যে তিনটি ঘটনা শুরুতে বলেছি, তার প্রতিটিই ঘটিয়েছে পুরুষ। এমন পুরুষ আমাদের চারপাশে বিরাজমান। এমন পুরুষ মনস্তত্ত্বে সম্ভাবনাময় ধর্ষকামী হবে এবং ধর্ষক হয়ে উঠবে, এ আর আশ্চর্য কী! আজকে আমরা সেই পুরুষত্বই মঞ্চস্থ হতে দেখলাম। ঘটনাচক্রে, অকুস্থলের নাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়! না, অকুস্থল গুরুত্বপূর্ণ না, বলা উচিত, ঘটনাচক্রে, ঘটনার জন্মদাতা একজন ছাত্রনেতা, সরকারি ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতা এবং অতীতেও তার পূর্বসূরিরা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, আর ক্ষমতা যতদিন নিরুঙ্কুশ হবে, ততদিন সবসময়ই না ঘটালেও, মনস্তত্ত্বে ‘ধর্ষণব্যধি’টা তাদের রয়েই যাবে!