নববর্ষে দেশের জন্য প্রার্থনা

এর মধ্যেই ২০২২ সালের সূর্য অস্তাচলে চলে গেল। বর্ষশুরুর প্রহরে আমাদের যেন প্রার্থনা করার সময়। প্রার্থনা, এমন একটি দেশের, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির…।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 31 Dec 2022, 05:31 PM
Updated : 31 Dec 2022, 05:31 PM

করোনাভাইরাস মহামারীকে পেছনে ফেলে আমরা যখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিলাম, তখন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে হাল-ভাঙা, পাল-ছেঁড়া পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেইন সংঘাত বিশ্বকে মূল্যস্ফীতি ও মন্দার সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তার পাশাপাশি আছে প্রকৃতি-পরিবেশের দুর্বার অবক্ষয়। মিশরে জলবায়ুবিষয়ক বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন এ ব্যাপারে পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। মহামারীর দুর্বার আঘাতও বিশ্বনেতাদের হুঁশ ফেরাতে পারেনি, ক্ষুদ্র এবং স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের নির্দেশেই তাদের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতি পথ চলছে। যা আসলে সর্বনাশের পথ।

আমাদের অর্থনীতি ভয়াবহ অবক্ষয়ের মুখে। কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে। সুচিন্তিত কোনো আর্থিক পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। আপাতত বিরোধীদল মোকাবিলা আর বাগাড়ম্বর ছাড়া তাদের চিন্তায় আর কিছু আছে বলে মনে হয় না।

জ্বালানির চাহিদা কীভাবে মেটানো হবে, আয় বাড়ানোর পথ কী, পাচার ও চুরি কীভাবে ঠোকানো হবে, কীভাবে কর্মসংস্থান বাড়বে– এসব ব্যাপারে কোনো সুচিন্তিত উদ্যোগ ও দিকনির্দেশনা নেই। এদিকে রোহিঙ্গা-সমস্যা ক্রমশই সঙ্কটে রূপ নিচ্ছে, যে সঙ্কটের মোকাবিলায় কঠোরতা এবং বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজনীয় সমন্বয় এ পর্যন্ত দেখা যায়নি।

অন্য দিকে বাড়ছে রাজনৈতিক সংঘাত। বিরোধী দলের সঙ্গে বৈরীতা ও দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার পরিবর্তে গণতন্ত্র ক্রমশ পরিণত হচ্ছে সংখ্যাগুরুবাদের লীলাভূমিতে। এই বিপদকে প্রতিহত করতে প্রয়োজন উদার গণতান্ত্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলির সম্মিলিত প্রতিরোধ, সকল স্তরে যথার্থ গণতন্ত্রের অনুশীলন। কিন্তু সেই প্রয়োজন পূরণের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। সকলের সম্মিলিত অবিমৃষ্যকারী ভূমিকায় দেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতি যে ভয়াবহ রকমের পূতিগন্ধময় পঙ্কস্তূপে নিমজ্জিত হয়েছে, সেই পাঁক ঘাঁটতে ঘাঁটতেই একটা করে বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগামী বছর উত্তরণের পথ খুঁজে পাবে কি? কে খুঁজবে সেই পথ?

এর মধ্যেই ০২২ সালের সূর্য অস্তাচলে চলে গেল। বর্ষশুরুর প্রহরে আমাদের যেন প্রার্থনা করার সময়। প্রার্থনা, এমন একটি দেশের, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির…।

সেই দেশ, যেখানে সংসদ হয়ে উঠবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যেখানে সব কিছু নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হবে। যেখানে কর্তাভজাকীর্তনের বাইরে গিয়ে সংসদ সদস্যরা কথা বলবেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে আইন ও নীতি প্রণয়ন করবেন। যেখানে প্রতিপক্ষের প্রতি বিদ্বেষ নয়, দু-পক্ষ সহিষ্ণু হয়ে পারস্পারিক বাক্য ও মত বিনিময়ে ব্যপৃত হবে, কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ হবে। যেখানে মন্ত্রিসভার কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি শাসক দলের বাঁ হাতের খেলার মতো লঘুতায় পর্যবসিত হবে না।

সেই দেশ, যেখানে বিচারবিভাগ সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণে সচেষ্ট হবে- মুষ্টিবদ্ধের ক্ষেত্রে নয়; সবার ক্ষেত্রেই। যেখানে সবার মানবাধিকার রক্ষিত হবে, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের দীর্ঘদিন জেল পচতে হবে না বা তাদের জামিনের পথ অবরুদ্ধ করা হবে না রাজনৈতিক মতাদর্শের বৈপরীত্যের জন্য।

সেই দেশ, যেখানে নির্বাচন কমিশন এক নিরপক্ষ আম্পায়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, ক্ষমতাসীন দলের হয়ে পুতুল হিসাবে চালিত না হয়ে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের সুবিধা-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ঘনঘন দলবদল করবেন না। যেখানে ‘দোষী সাব‌্যস্ত না-হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ’- আইনশাস্ত্রের এই সাধারণ নীতি কেউ বদলে ফেলতে পারবে না।

সেই দেশ, যেখানে অর্থনীতি সংক্রান্ত কার্যকর আলোচনায় তাৎক্ষণিক মতামতের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে যুক্তিনিষ্ঠ তথ্য। যেখানে সবাই শ্রান্ত ও নৈরাশ্যবাদী নয়; আবার ‘গোল্লায় যাক দুনিয়া’ বলে নিশ্চিন্তে গড্ডল-প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়াতেও নয় বিশ্বাসী। চাকরির বাজার খারাপ এবং সার্বিক উন্নতিও শম্বুক গতিতে এগোচ্ছে– এই সহজ সত্য অস্বীকার না করে মেনে নেওয়া হবে যেখানে। যেখানে ‘গ্লোবাল হাংগার ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশের অধগমন আমাদের ততটাই দুশ্চিন্তায় ফেলবে, যতটা আনন্দ ও তৃপ্তি দেবে লক্ষাধিক মানুষের দারিদ্রসীমার নিচের অভিশপ্ত গণ্ডি কাটিয়ে বেরিয়ে আসার খবর।

সেই দেশ, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল রাস্তা আটকে মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে না। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখার চেষ্টা করবে, রাজকোষকে দেউলিয়া বানানোর মিশন থেকে সরে আসবে। যেখানে সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক দলগুলির ভোটপ্রার্থনার হাতিয়ার হবে তাদের শাসনপদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা, কোনোরকম কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করে ভোটে জেতার অন্য়ায় প্রয়াস থাকবে না।

সেই দেশ, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মহার্ঘ‌ বিষয়কে ঘরোয়া সেমিনার কিংবা আন্তর্জাতিক মঞ্চের মুখাপেক্ষী করে বসিয়ে রাখা হবে না, তা হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলির অন্যতম। যেখানে পরিষ্কার বাতাসে প্রশ্বাস নেওয়া ও বিশুদ্ধ জলপান করার অধিকারকে ‘মৌলিক’ অধিকার হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হবে।

সেই দেশ, যেখানে পুঁজিপতি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর মোটা অঙ্কের ঋণ পাবার সুবিধা থাকবে না। বা যেখানে সুদের কিস্তি শোধ না করতে পারার জন্য গরিব হতদরিদ্র চাষির শেষ সম্বলটি কেড়ে নেওয়া হবে না। যেখানে নামীদামি শিল্পক্ষেত্র থেকে কোনো অংশে কম সুযোগ-সুবিধা পাবে না অখ্যাত, অপরিচিত মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পক্ষেত্রসমূহ। যেখানে অর্থাভাবে, চাঁদাবাজ কিংবা আয়কর বিভাগের ভয়ে ব্যবসা চালু করতে ভয় পাবে না সাধারণ মধ্যবিত্ত; ধনী ব্যবসায়ী নাগরিকত্ব বদলে বিদেশে কেন পাড়ি দিল, এটা নিয়ে ভাবতে হবে না তাদের।

সেই দেশ, যেখানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ-প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে হবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ঘুষ-দুর্নীতির কারণে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীর ভাগ্যাকাশ অনিশ্চয়তার চাদরে ঢাকা পড়বে না অনির্দিষ্টকালের জন্য।

সেই দেশ, যেখানে ধর্মীয় বিভাজন থাকবে না। যেখানে ভালোবাসাকে ‘দাগী আসামি’-র কাঠগোড়ায় তোলা হবে না অসাংবিধানিক ভিত্তিহীন আইনের মাধ্যমে।

সেই দেশ, যেখানে পোশাক দেখে মানুষকে বিচার করা হবে না। সেই দেশ যেখানে অবিমিশ্র ধর্মান্ধতার বশে একজন অমুসলিমকে ট্রল বা আক্রমণ করা পরিত্যাজ্য হবে। যেখানে স্বঘোষিত সাংস্কৃতিক কেষ্টবিষ্টুরা সহস্রাব্দ-প্রাচীন এক সভ্যতার একমেবাদ্বিতীয়ম অভিভাবক হয়ে উঠতে পারবে না। যেখানে নিজেদের লোকদের ক্রীড়া-সিনেমা-সংস্কৃতিতে প্রোমোট করতে পারবে না; পারবে না সরকারকে তোশামোদ না করা কোনো ব্যক্তিকে ব্ল্যাক লিস্টেড করে দিতে। যেখানে ‘আমরা-ওরা’-এ দ্বিখণ্ডিত সমাজে ‘ওদের’ পাশাপাশি বসবাস ও সহিষ্ণুতা দেশের আদর্শ বৈচিত্রের স্মারক হয়ে উঠবে।

সেই দেশ, যেখানে হেট স্পিচ ও কুৎসা ছড়ানোর জন‌্য ‘ফ্রি ফর অল’ করে দেওয়া হবে না সোশ‌্যাল মিডিয়া। যেখানে ফ্যাক্ট চেকারদের এই মর্মে গ্রেফতার করা হবে না যে, তাদের পরিবেশিত যুক্তি উত্তর-সত্য যুগের শাসকের কাছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেখানে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পুষ্ট ও সুরক্ষিত করপোরেট ধনকুবেররা বলপূর্বক মিডিয়া কোম্পানি অধিগ্রহণ করে বাকস্বাধীনতার পক্ষে ঠুনকো বুলি ছড়াবেন না। যেখানে টিভি শোতে অংশগ্রহণকারীরা দলবাজির পরিবর্তে দর্শককে ঋদ্ধ করবে প্রকৃত জ্ঞানের দ্বারা, কান ঝালাপালা করা চিৎকার দিয়ে নয়।

সেই দেশ, যা একদিন ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে কোয়ালিফাই হবে। যার টিমকে কোনো বিদেশি মেসির মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকতে হবে না, নিজের টিমের মণিমানিক্য যারা দেশের মাটিতেই সৃজন করবে। যেখানে দেশের নারী ফুটবল-ক্রিকেটও পুরুষ ফুটবল-ক্রিকেটর মতো সমান গুরুত্ব ও স্বীকৃতি পাবে যেকোনো জয়ের পর।

সেই দেশ, যেখানে দেশের সকল নাগরিক জাতি-ধর্ম-জেলা-লিঙ্গ-উপার্জন ভেদে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার অনুভূতিতে গর্বিত হতে পারবে।

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাব না আমরা?

সবাইকে হ্যাপি নিউ ইয়ার!