যৌন গোলযোগে যেন কুপোকাত ট্রাম্প

১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌননিপীড়ন, যৌনহেনস্থার অভিযোগ করেছেন ২৫ জন নারী। যৌনসম্পর্কিত মামলা হয়েছে পাঁচটি। একটিতে তাঁর সাজা হয়েছে।

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 21 July 2023, 08:02 AM
Updated : 21 July 2023, 08:02 AM

ডোনাল্ড ট্রাম্পের যৌন বিভ্রাট যেন `শেষ হয়ে হইল না শেষ'। রয়টারের প্রতিবেদন মোতাবেক, ১৯ জুলাই ২০২৩ সালে ফেডারেল বিচারপতি লুইস ক্যাপলান ৫৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রায়ে যৌন-কেলেঙ্কারির অপরাধে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ট্রাম্পের আপিল নাকচ করে দিয়েছেন। অপরপক্ষে বাদী ই. জিন ক্যারোলের কৌসুলিরা আরও একটি মানহানির মামলা করেছিলেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। 

প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ২০১৯ সালের ২৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা পত্রিকা 'দ্য হিল'-এ হোয়াইট হাউজ থেকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কটূক্তি করেছিলেন  ই. জিন ক্যারোল কে নিয়ে। ট্রাম্পের বর্ণনায়, যৌন কাজে ট্রাম্পের মানদণ্ড উত্তীর্ণ হওয়ার মত আবেদন মিস ক্যারোলের নেই। এই মামলাটি এতদিন আটকে ছিল। আটকে রাখায় ব্যবহার করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতির অনাক্রম্যতা (Presidential Immunity)। যেহেতু ওই সময় ট্রাম্প ছিলেন প্রেসিডেন্ট। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১১ জুলাই খবর অনুযায়ী, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট রাষ্ট্রপতির অনাক্রম্যতা অকেজো করে দিয়েছে। কারণ হল ক্যারোলের সম্পর্কে মানহানিকর কটূক্তি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের কার্যপ্রণালীর অন্তর্ভুক্ত নয়। এটা ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ব্যাপার। অতএব এই মানহানির মামলাটিতে প্রাণ সঞ্চার হল। 

যুক্তরাষ্ট্র মামলাবাজির অভয়ারণ্য। সেখানে সিপাহসালার ডোনাল্ড ট্রাম্প যৌন বিষয়ক মামলা-মকদ্দমায় মনে হচ্ছে কুপোকাত। ১৯৮০ সাল থেকে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয় পর্যন্ত তিন যুগে ট্রাম্প ও তাঁর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এবং স্টেট আদালতে চার হাজারেরও বেশি মামলায় জড়িত হয়েছে। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষে তিনি আসামি ও বাদী হলেন আরও কয়েক ডজন মামলা-মকদ্দমায়। এ পর্যন্ত তিনি একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। 

দিনটি ছিল ৯ মে ২০২৩ সাল। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট অথবা সাবেক প্রেসিডেন্ট যিনি যৌন-কেলেঙ্কারির অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হলেন। বিচার কাজ শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালত ইউ এস ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউ ইয়র্ক। জুরির সংখ্যা ছিল নয় জন। ছয় জন পুরুষ আর তিন জন নারী। এই দেওয়ানি মামলায় জুরিরা বাদী ই.জিন ক্যারোলকে যৌনহেনস্থার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ৫০ লাখ ডলার জরিমানা করেছেন। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমানিত হয়নি। কিন্তু যৌননিপীড়ন ও মানহানির অভিযোগে ট্রাম্পকে সাজা দেয়া হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কৌসুলিরা ঊর্ধ্বতন আদালতে আপিল দায়ের করেছেন। রয়টারের প্রতিবেদন মোতাবেক, ১৯ জুলাই ২০২৩ সালে ফেডারেল বিচারপতি লুইস ক্যাপলান রায়ে ট্রাম্পের আপিল নাকচ করে দিয়েছেন।

মামলার অভিযোগ অনুযায়ী ১৯৯৫ অথবা ১৯৯৬ সালে ম্যানহাটনের বিলাসবহুল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বার্গডর্ফ গুডম্যানের ড্রেসিং রুমে ডোনাল্ড ট্রাম্প ধর্ষণ করেছিলেন ই. জিন ক্যারোলকে। ট্রাম্প মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজি গ্রুপ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ট্রুথ সোশ্যাল নামে পরিচিত একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর এই মামলাটিকে ‘প্রতারণা’ ও ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের ভাষায় মামলাটি পুরোপুরি প্রতারণামূলক। মামলাটি পরে পরিবর্তিত হয় দুটো অংশে। ধর্ষণের সঙ্গে যোগ হয় মানহানি—যার ভিত্তি ছিল ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্পের দীর্ঘ বিবৃতি।

২০১৯ সালের ২১ জুন ই. জিন ক্যারোল নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে যৌনহেনস্থার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দায়ী করেন। একই বছর ই. জিন ক্যারোল তাঁর প্রকাশিত বই What Do We Need Men For?: A Modest Proposal-এ যৌনহেনস্থার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন এবং আদালতে তিনি সেই বিবরণ তুলে ধরেছেন। বর্ণনা অনুযায়ী ক্যারোল বার্গডর্ফ গুডম্যানে কেনাকাটা শেষ করে বের হওয়ার পথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা হয়। আগে থেকেই তাদের পরিচয় ছিল। এক মহিলার জন্য উপহার বাছাই করার জন্য ক্যারোলের সাহায্য চেয়েছিলেন ট্রাম্প। ক্যারোলের পরামর্শ ছিল হাতব্যাগ অথবা হ্যাট। ক্যারোলের ভাষ্যমতে ট্রাম্প তাঁকে মহিলাদের অন্তর্বাস বিভাগে নিয়ে যান। নীল রঙের বডিস্যুট [মানে এক ধরনের আঁটসাঁট পোশাক] ক্যারোলের শরীরে খাটে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার প্রস্তাব দেন। অতএব, দুজনে মিলে সাজঘরে প্রবেশ করেন। মুহূর্তেই ট্রাম্প সাজঘরের দরজা বন্ধ করে দিলে দিশেহারা ক্যারোল ট্রাম্পকে পালটা ধাক্কা দেন। কিন্তু ট্রাম্প তাকে সজোরে দেয়ালে চেপে ধরেন। ক্যারোলের উরু ও পা-ঢাকা আঁটসাঁট পোশাকটি নিচে নামিয়ে ফেলেন। তারপর তাঁর যৌনাঙ্গে ট্রাম্প আঙুল ঢুকিয়ে দেন। আদালতে ক্যারোল আবেগময় কন্ঠে বলেছিলেন, ‘ওটা ছিল ভীষণ বেদনাদায়ক।’ এরপর ট্রাম্প তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন বলে আদালতে এজাহার দিয়েছিলেন ক্যারোল। সর্বমোট সময় ছিল তিন মিনিট। বার্গডর্ফ গুডম্যানের সাজঘরের আশেপাশে তখন কেউ ছিল না। এই যৌন-নিপীড়নের পর ক্যারোল দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। তাঁর বান্ধবী লিসা বার্নব্যাককে টেফিফোনে এই যৌন-নিপীড়নের দুঃখজনক ঘটনাটি বলেছিলেন ক্যারোল এবং পরে এবিসির সঞ্চালক ক্যারল মার্টিনকে এই ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন। 

এই মামলাটি দায়েরের ব্যাপারে ‘মিটু’ আন্দোলনটি প্রেরণা যুগিয়েছে। কর্মস্থলে যৌন-নিপীড়ন ও হয়রানির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনটি তারানা বার্ক শুরু করেন ২০০৬ সালে। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক হার্ভে ওয়াইনস্টাইনের বিরুদ্ধে যৌন-নির্যাতনের কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকে। এর ফলে ‘মিটু’ আন্দোলনটি সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা লাভ করে। আন্দোলনটির মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ক্যারোলের মতো নির্যাতিত নারীদের ‘মিটু’ আন্দোলনটি সাহস দিয়েছিল । অনেক বছর ধরে তিনি নীরবে সহ্য করেছেন বেদনা এবং অপমান। ২০১৯ সালে তাঁর বই What Do We Need Men For?: A Modest Proposal-এ ট্রাম্পের যৌন হেনস্থার বিবরণ ছাপানোর পর নভেম্বরে ক্যারোল ম্যানহেটানের নিউ ইয়র্কের স্টেট আদালতে মানহানির মামলা দায়ের করেন। কিন্তু সমস্যা হল—ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি বিবিধ কূটচাল ও আপিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাটিকে স্থগিত করে রাখেন।

ক্যারোলের সামনে আরও একটি বাঁধা ছিল—স্ট্যাটিউট অব লিমিটেশন অথবা সীমাবদ্ধতা সংক্রান্ত সংবিধি। এই সংবিধি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে হয়। তা না হলে অভিযোগের আইনগত কার্যকারিতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সময়সীমা আবার বিভিন্ন স্টেট ও ফেডারেল আদালতে ভিন্ন রকম। 

হঠাৎ ক্যারোলের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। নিউ ইয়র্ক স্টেটের আইনসভার সর্বসম্মত ভোটে ২০২২ সালের মে মাসে পাশ হল নতুন আইন ‘অ্যাডাল্ট সারভাইভারস অ্যাক্ট’। যৌন-হয়রানির ক্ষেত্রে সময়ের সীমাবদ্ধতা দূর হল এই আইনের মাধ্যমে। ২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর হতে ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত নির্যাতিতদের মামলা করার এক বছর সময় বাড়িয়ে দেয়া হল। নতুন আইনের এই সুযোগটা ক্যারোল লুফে নিলেন। 

‘অ্যাডাল্ট সারভাইভারস অ্যাক্ট’ আইনটি পাশ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ক্যারোল ২৪ নভেম্বর ২০২২ সালে তাঁর দ্বিতীয় মানহানির মামলা দায়ের করলেন। মামলার ভিত্তি হল—ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর ট্রাম্পের এক দীর্ঘ প্রতিবেদন, যেখানে ট্রাম্প প্রথম মামলাটিকে ‘প্রতারণা’ ও ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেন। ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল আদালত ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫০ লাখ ডলার জরিমানা করে। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু যৌননিপীড়ন ও মানহানির অভিযোগে ট্রাম্পকে সাজা দেয়া হয়েছে। 

এই মামলাটিতে প্রদর্শিত বস্তু বা আলামত হিসেবে আদালত গ্রহণ করেছিল অ্যাকসেস হলিউড টেপ নামে বহুল আলোচিত ভিডিও। ২০১৬ সালে ফাঁস হয়েছিল অ্যাকসেস হলিউড টেপ। ২০২৩ সালের ১০ মে বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী অ্যাকসেস হলিউড টেপ নামে পরিচিত এবং ২০১৬ সালে ফাঁস হওয়া অডিওতে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন যে, নারীরা তারকাদের যে-কোনো কিছু করতে দেয়, এমনকি তাদের যৌনাঙ্গ ধরার মতো কাজও। ক্যারোলের আইনজীবী বলেন, তিনি তার সঙ্গে সেটিই করেছিলেন। রেকর্ড করা ভিডিও জবানবন্দিতে ট্রাম্প এক পর্যায়ে ক্যারোলকে তার প্রাক্তন স্ত্রী মার্লা ম্যাপলসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। 

ট্রাম্পের ধর্ষণ [অভিযুক্ত] ও তারপর অপবাদমূলক প্রচারণা ক্যারোলের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে বলে তিনি বিচারক ও জুরিদের জানিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে আর কারও সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্ক স্থাপনে তাঁর অক্ষমতার কথা তিনি আদালতকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। 

মার্কিন মুলুকে ক্ষমতার উর্ধতন দুর্গে ট্রাম্পের মতো যৌন-কেলেঙ্কারির কাহিনি নতুন নয়। গত কয়েক দশকে অনেকেই জেনেছে সংবাদমাধ্যমে চাউর হয়ে যাওয়া বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিউনস্কিসহ অন্যান্য রসাত্মক রোমাঞ্চকর কাহিনি। বিল ক্লিনটনের কপালে ঘটেছিল দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট। মনিকার সঙ্গে প্রণয়ঘটিত ব্যাপার ছিল ঘটনার মূলে। মজার বিষয় হল—এই ইমপিচমেন্টের কারণ যৌনসম্পর্ক নয়। যৌনসম্পর্ক চেপে যাওয়ার জন্য মিথ্যা বলাই ছিল অপরাধ। মার্কিন সিনেটে মোটামুটি দলীয় ভোটের ব্যবধানে বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্টের গদি হারাননি।

কলোরাডো থেকে নির্বাচিত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর গ্যারি হার্ট ছিলেন ১৯৮৮ সালের প্রেসিডেন্টে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী। তিনি ছিলেন বিবাহিত। কিন্তু তিনি ধরা পড়েন ডনা রাইস নামে এক অল্পবয়সী নারীর সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসম্পর্কে। নির্বাচন থেকে তাঁকে সরে আসতে হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের জনমত ছিল বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন। টাইম ম্যাগাজিনের মতামত যাচাই ভোটে দুই তৃতীয়াংশ মার্কিন নাগরিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের যৌনজীবনের কাহিনি পত্রিকার মাধ্যমে ঘাটাঘাটির বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিল। এ বিষয়ে তৎকালীন নিউ ইয়র্কের গভর্নর মেরিও কোমোর মন্তব্য ছিল লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেকের আলমারিতে রয়েছে নরকঙ্কাল।’ 

যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রক্ষমতার উর্ধতন পদে অধিষ্ঠিতদের যৌন-কেলেঙ্কারির ঘটনা এ দেশের জন্মলঘ্ন থেকে শুরু হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচয়িতা এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম টমাস জেফারসনের সঙ্গে গোপন এবং বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক ছিল তার ক্রীতদাসী স্যালি হেমিংসের সঙ্গে। সংবাদপত্র এটা রটিয়ে দিয়েছিল। তখন সেটা বদনাম হলেও বিংশ শতাব্দীতে ডিএনএ পরীক্ষায় এই সম্পর্কটি প্রমাণিত হয়েছে। 

বদনাম ছিল জন এফ ক্যানেডির সঙ্গে মেরেলিন মনরোর, জেনারেল ডোয়াইট আইজেন হাওয়ারের সঙ্গে তাঁর গাড়িচালক ক্যাপটেইন কে সামার্সবির সম্পর্ক নিয়ে। সবচেয়ে মজাদার ঘটনা ছিল ২৯তম প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিংকে নিয়ে। তাঁর যৌনক্ষুধার ব্যাপারে হার্ডিং প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন। একবার সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ভাগ্যিস তিনি মেয়ে হয়ে জন্মাননি—মেয়ে হয়ে জন্মালে তাকে বারবার গর্ভধারণ করতে হতো। ওয়ারেন হার্ডিং যখন হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা, তখন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পত্নী ক্যারি ফিলিপসের সঙ্গে নিয়মিত যৌনপ্রমোদে নিমগ্ন হতেন। এটা গোপন রাখার জন্য ক্যারি ফিলিপসকে অর্থ দিতে হতো। প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিংয়ের যৌনলালসার খরচ রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটিকে বহন করতে হতো। বর্তমানেও রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি বিলিওনিয়ার ট্রাম্পের মামলাগুলোর অনেকটারই খরচ বহন করে চলছে। কী অদ্ভূত দে জ্য ভূঁ! 

যৌন-কেলেঙ্কারি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের একচেটিয়া ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের স্বৈরশাসকসহ অন্য দেশগুলোতেও রয়েছে এই কেলেঙ্কারির নগ্ন প্রকোপ। ভুরি ভুরি উদহারণ রয়েছে। বলে শেষ করা যাবে না। তবে বিলেতের একটি বহুল আলোচিত কাহিনি উল্লেখ না করার লোভ সামলাতে পারছি না! যার সঙ্গে কিছুটা জড়িত ছিলেন আমার সাবেক দেশ ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ দলীয় প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলানের যুদ্ধ মন্রী জন প্রোফুমোর সঙ্গে পরিচয় ঘটে ১৯ বছর বয়স্ক মডেল ক্রিস্টিন কিলারের। স্থানটি ছিল ভাইকাউন্ট অ্যাসটরের ক্লাইভডেন প্রাসাদ। বিবাহিত প্রোফুমো ক্রিস্টিন কিলারের সঙ্গে অবৈধ যৌনসম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক মাস যেতে-না-যেতেই নিরাপত্তা সার্ভিস তাঁকে সাবধান করে দেয় যে, ক্রিস্টিন কিলারের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক রয়েছে লন্ডনে সোভিয়ট ন্যাভাল অ্যাটাশে ইভগেনি ইভেনভের সঙ্গে। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে বৃটিশ পার্লামেন্টে এই ব্যাপারটি প্রকাশ করেন লেবার দলীয় এমপি জর্জ উইগ। এর ফলে জন প্রোফুমোকে তাঁর যুদ্ধ মন্রীসহ এমপির পদ হারাতে হয়। ১৯৬৪ সালের পার্লামেন্টারি নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলের পরাজয়ের এটাই ছিল অন্যতম কারণ। 

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা কিভাবে হলেন? এক বহুল প্রচারিত ছবিতে দেখা গেল—বিকিনি পরিহিত ক্রিস্টিন কিলারের অর্ধনগ্ন দেহ আইয়ুব খানের ঘাড়ে ঝুলে আছে। বিকিনি পরিহিত আরও কয়েকটি তরুণী আইয়ুব খানের অর্ধনগ্ন দেহের খুব কাছে বসে আছে উল্লসিত ভঙ্গিতে। স্থানটি ছিল ভাইকাউন্ট অ্যাসটরের ক্লাইভডেন প্রাসাদের সুইমিং পুল। 

তথ্য-উপাত্ত বলছে, ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌননিপীড়ন, যৌনহেনস্থার অভিযোগ করেছেন ২৫ জন নারী। যৌনসম্পর্কিত মামলা হয়েছে পাঁচটি। একটিতে তাঁর সাজা হয়েছে পাঁচ মিলিয়ন ডলার। লেখিকা জিন ক্যারোল ছিলেন সাজাপ্রাপ্ত মামলাটির বাদী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যাপারে মনে পড়ে একটি লোক প্রবাদ—‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ।’