নির্বাচনকে বৈধ করার জন্য নানা ধরনের তৎপরতা চলছে। হঠাৎ করেই নানান নতুন নতুন দল এবং সেই সব দলের জোট নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত কিছু দিন ধরে।
Published : 22 Nov 2023, 05:19 PM
নির্বাচন মানেই দেশের মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ দেখা দিত এক সময়। ইতিহাসের নানান পালা বদলে এখন নির্বাচনের ভিন্নমাত্রা দেখতে পাচ্ছি আমরা। নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে নিয়মরক্ষার।
বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে থেকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক মহোৎসব লক্ষ্য করা যেত। সত্তরের নির্বাচন ছিল মূলত গণ-আন্দোলনের একটি বড় ধাপ। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামনে রেখে নৌকা প্রতীক নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এ জনপদের মানুষ। যদিও ওই নির্বাচনের ফল মেনে নেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। অনিবার্য পরিণতিতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে এগারো বার। আর আগামী ৭ জানুয়ারি হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
এ নির্বাচন ঘিরে চলছে নানা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক ও সমীকরণ। চোখে পড়ছে নানাবিধ তৎপরতা। মূলত ক্ষমতাসীন দল ও তাদের জোটের মধ্যেই এই নির্বাচনী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বিগত কয়েক দিনে প্রায় তিন হাজার মনোনয়নপত্র বিক্রি করে পনের কোটির অধিক তহবিল সংগ্রহ করেছে।
প্রতিদিনই রাজধানীর রাস্তার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শোডাউন, মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, মিছিল দেখা যাচ্ছে। যদিও নির্বাচনী আচরণবিধির ক্ষেত্রে এটির ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে জানা যায়নি এখনো। অন্যদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মামলা, গ্রেপ্তারের পাশপাশি হরতাল-অবরোধ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড়। তারা ২৯ অক্টোবর থেকে মাঝেমধ্যে এক-আধ দিন বিরতি হরতাল আর অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে সারাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশব্যাপী হাজার হাজার নেতাকর্মীর পাশপাশি তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশই গ্রেপ্তার হয়েছেন। যারা বাইরে আছেন, তারাও রয়েছেন পলাতক অবস্থায়। বিভিন্ন কূটনৈতিক মহল থেকে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ ও প্রচেষ্টা চললেও তার কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় আরেকটি নির্বাচন হয়তো এদেশ আবার দেখতে যাচ্ছে। ছোট আর মেজদের নিয়ে ক্ষমতাসীন বড় দলটি সম্পন্ন করতে যাচ্ছে আরও একটি নির্বাচন!
এই পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, নির্বাচনকে বৈধ করার জন্য নানা ধরনের তৎপরতা চলছে। সরকারি দল এবং তাদের জোট ব্যতীত কোনো রাজনৈতিক দল এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়নি। সর্বশেষ বিএনপি জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির নির্বাচন করার ঘোষণায় একটু চমক আছে। এর বাইরে হঠাৎ করেই নানান নতুন নতুন দল এবং তাদের জোট নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত কিছু দিন ধরে। কিন্তু কেন?
খুব স্বাভাবিকভাবেই সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই তোড়জোড় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারও কারও মতে অনেকটা কিংস পার্টি আদলে কি ক্ষমতাসীনরা একটি নির্বাচনী বৈধতার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত দলটির নাম তৃণমূল বিএনপি। যারা এই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়েছে এবং ইতোমধ্যে তারা ঘোষণা দিয়েছে তারা ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেবে। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি থেকে পদত্যাগকারী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। এই দলের মহাসচিব হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার। কিন্তু আমরা জানি বাংলাদেশের সংবিধান ও নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী যে কোনো রাজনৈতিক দলই সেটা করতে পারে। একটি রাজনৈতিক দল যারা নিবন্ধন পেল মাত্র কিছুদিন আগে, তারা কীভাবে এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এমন ঘোষণা দিতে পারে? প্রশ্নটা জনমনে আসাটা কি খুবই অস্বাভাবিক? মোটেও না।
নির্বাচনকে সামনে রেখে আরেকটি আলোচিত দলের নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)। তারাও একই আদলে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে এবং এরই মধ্যে ৯০টি মনোনয়ন বিক্রিও করেছে বলে জানা গেছে। অথচ গত ১০ অগাস্ট নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়েছে দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই দুটি দলই ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি ২২০টি আসনে প্রার্থী দেয়ার পরিকল্পনা করেছে এবং ১৮৬টি ফরম বিক্রিও করেছে।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক। এর মধ্যে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪০। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৮। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে আছে ৫টি নিবন্ধিত দল। দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী এই দলটি ভোটে আসবে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না। জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃত্বাধীন ৫৮ দলের জোটে নিবন্ধিত দল আছে তিনটি। জোটের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় পার্টিকে মেজদলের কাতারে রাখা গেলেও বাকিরা ছোট দলেরও ছোট।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতৃত্বাধীন বাম জোটে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ছিল তিনটি। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলন ইতোমধ্যেই বামজোট থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ নামের আরেকটি জোট তৈরি করেছে। ওই জোটে থেকে গণঅধিকার পরিষদ বের হয়ে তৈরি করেছে আরেকটি রাজনৈতিক মোর্চা। এছাড়াও ছোট-বড় নানান দল ও তাদের নির্বাচনকালীন দৌড়ঝাপ দেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করাটা অত্যন্ত কঠিন।
আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোটে আছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের দুটি অংশ। আছে দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) একাংশ। সাম্যবাদী দলের আরেকটি অংশ বাম ঐক্য নামের আরেকটি জোটে রয়েছে। ন্যাপের আরও কয়েকটি অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরি হওয়ার পর এ জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারবিরোধী বড় দল বিএনপি সংলাপ করেছে। পরবর্তী সময়ে সরকারবিরোধী অবস্থানের ক্ষেত্রে সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করার পরিকল্পনা করছে বিএনপি।
সাত দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চে রয়েছে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।
দেশের রাজনীতিতে জোট গঠনের হিড়িকের মধ্যে ২০১৮ সালে ৭টি প্রগতিশীল বাম দলের সমন্বয়ে আরেকটি বাম জোট আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটের নামকরণ করা হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’। জোটের দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল), জাতীয় বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাংলাদেশের সোশ্যালিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমতা পার্টি ও বাংলাদেশের শ্রমিক পার্টি। জোটের সাতটি দলের কোনোটিই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নয়। গত পাঁচ বছরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দু-একটি মানববন্ধন ছাড়া এই জোটের আর কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।
এক দশক আগে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ কংগ্রেস নামের একটি রাজনৈতিক দল। শুরুর দিকে কিছু কর্মসূচি থাকলেও ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়ার পর রাজনীতির মাঠে তেমন কোনো সক্রিয়তা নেই দলটির। কালেভদ্রে কিছু ইস্যুতে ঢাকায় মানববন্ধন করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ দলের কার্যক্রম। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এমন কিছু দল সরব হতে শুরু করেছে। কোনো কোনো দল ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথা বলছে। যদিও বছরজুড়ে দলগুলোর তেমন কোনো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা দেখা যায় না। তারা দেশের জনগণের কোনো চাওয়া-পাওয়ার কথা বলে না, যদিও দলগুলো নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সবশেষ তথ্যমতে, দেশে এখন ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ দলই কাগজে আছে, কাজে নেই। কয়েকটি দল ইস্যু বা দিবসভিত্তিক কর্মসূচি দিলেও তা পালন করার মতো লোকবলই নেই তাদের। আবার ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কয়েকটি বিদেশের ইস্যু নিয়ে মাদ্রাসা বা মসজিদকেন্দ্রিক কিছু কর্মসূচি করলেও জাতীয় ইস্যুতে তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্র সংগঠনও অকার্যকর। ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মতো দলগুলোর গত কয়েক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে হলে তিনটি শর্ত রয়েছে। ১. আগের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকতে হবে, ২. আগের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অন্তত একটিতে আবেদনকারী দল যেসব আসনে নির্বাচন করেছে, সেসব আসনের মোট ভোটের পাঁচ ভাগ ভোট পেতে হবে এবং ৩. দলটির একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ও কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ (২১টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকতে হবে। নিবন্ধন পেতে হলে এই তিন শর্তের যে কোনো দুটি পূরণ করতে হবে।
মূলকথা হলো, এই যে বহুদলীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, তার একটি নির্দিষ্ট পথ রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক কৌশল ও নীতি রয়েছে আর রয়েছে কর্মসূচি। আমরা দেখতে পাই, ছোট হোক বা বড় রাজনৈতিক মতাদর্শিক দলগুলো সারাবছরই তাদের নীতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও দলগুলো সরব থাকে। কিন্তু শুধু নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই মাস আগে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধনপাওয়া এক বা একাধিক রাজনৈতিক দল এদেশের মানুষের জন্য ও রাজনীতির জন্য কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে এটা জনসাধারণের সামনে একটি সুস্পষ্ট প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, এই কিংস পার্টি আদলে নির্বাচন করার কৌশলটি বুমেরাং হতে পারে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য। এজন্যই এই মুহূর্তে দরকার ফলপ্রসূ আলোচনার ভিত্তিতে সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচন। যে নির্বাচনে এদেশের মানুষ তার পছন্দের প্রার্থী ও দলকে পছন্দ করে নিতে পারবে। আর ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। বাংলাদেশের ইতিহাসও সে কথাই বলে।