বইমেলাকে ঘিরেই হোক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাংস্কৃতিক বলয়

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরির অংশ হিসেবে চলতি মার্চ মাস থেকে কিছু প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে বইমেলার স্থান নিয়ে নতুন করে জটিলতা ও আলোচনা তৈরি হয়েছে।

আমীন আল রশীদআমীন আল রশীদ
Published : 4 March 2024, 05:13 PM
Updated : 4 March 2024, 05:13 PM

অমর একুশে বইমেলা এ বছর হলো ৩১ দিনের। ‘লিপ ইয়ার’ বলে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনে হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এমনিতেই একদিন বেশি পাওয়া গেছে। আবার মার্চ মাসের প্রথম দুদিন শুক্র ও শনিবার তথা সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় প্রকাশকদের অনুরোধে বইমেলা আরও দুদিন বাড়ানো হয়।

মেলার শেষদিনে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাদের রেওয়াজ অনুযায়ী জানিয়েছে যে, এবার এই ৩১ দিনে বিক্রি হয়েছে ৬০ কোটি টাকার বই। যদিও বইমেলা চলাকালীন রাজধানীর পূর্বাচলে শেষ হয়েছে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এবার সেখানে বিক্রি হয়েছে প্রায় দেড়শো কোটি টাকার পণ্য, যা গতবারের চেয়ে ৫০ কোটি টাকা বেশি। সেইসঙ্গে গতবারের তুলনায় এবার রপ্তানি আদেশও বেশি পাওয়া গেছে। এবারের বাণিজ্যমেলায় প্রায় তিন কোটি ৫৬ লাখ ডলারের রপ্তানি আদেশ পাওয়া গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩৯২ কোটি টাকা। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।

বই একটি বাণিজ্যিক পণ্য হলেও বাণিজ্যমেলার সঙ্গে বইমেলার তুলনা করা সঙ্গত কি না সেটি বিরাট প্রশ্ন। কিন্তু এও ঠিক যে, মাসব্যাপী একটি বইমেলায় কী পরিমাণ বই বিক্রি হলো এবং কী পরিমাণ মানুষের আনাগোণা হলো— সেটি দিয়ে দেশের মানুষের পাঠাভ্যাস এবং বইপ্রেমের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা তো করাই যায়।

এ বছর অমর একুশে বইমেলায় এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয় বরং বইমেলার ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গেও বেমানান। তবে সেইসব ঘটনা ছাপিয়ে এবার যে আলোচনাটি লেখক-প্রকাশক ও পাঠকদের উদ্বিগ্ন করছে সেটি হলো, আগামী বছর বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হচ্ছে না। সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তরফে এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা হয়েছে।

যদি শেষমেষ তা-ই হয়, তাহলে বইমেলা কোথায় যাবে? একসময় যে রকম শুধু বাংলা একাডেমি চত্বরে হতো, সেখানেই হবে? কিন্তু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, তাতে বাংলা একাডেমির অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরে কি এই মেলাটি আয়োজন করা আদৌ সম্ভব হবে, নাকি একাডেমির সামনের রাস্তা যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃত— সেখানে হবে?

একসময় এভাবেই মেলার আয়োজন হতো। কিন্তু একাডেমি চত্বর এবং এর সামনের রাস্তায় আয়োজনের পরেও স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। তাছাড়া রাস্তার ওপরে স্টল বসানো হলে সেটি মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। এসব বিবেচনায় নিয়ে মেলাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয় এবং এরপর থেকেই বইমেলার আকার যথেষ্ট বেড়ে যায়। গত এক দশক ধরে এভাবেই চলে আসছে যে, মেলার মূল আয়োজন থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর বাংলা একাডেমির ভেতরে থাকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল এবং সেইসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের স্টল— যেখানে মূলত বই বিক্রি করা হয়।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বইমেলা সরিয়ে নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে এবং যদি তা-ই হয়, তাহলে আগামী বছরের বইমেলা কোথায় হবে? এই সিদ্ধান্ত কি শুধু ২০২৫ সালের জন্য নাকি আরও বেশি সময়ের জন্য? ভবিষ্যতে কি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা আর ফিরবে না? লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মনে এসব প্রশ্ন আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও এ নিয়ে মানুষের নানারকম মত, অভিমত ও প্রতিক্রিয়া আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় কেউ কেউ বইমেলার মতো এত বিশাল আয়োজনের ভার বইবার শক্তি বাংলা একাডেমির নেই দাবি করে এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ারও দাবি তুলেছেন। যদিও বাংলা ভাষার যে চেতনায় এই মেলাটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়াটা কতখানি সম্মানের— সেই তর্কও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

মনে রাখা দরকার, ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যে শহীদ মিনার গড়ে উঠেছে; যে মিনারকে বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত পবিত্র মনে করে, বিশ্বাস করে—বাংলা একাডেমিকেও এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সেরকম পবিত্র জ্ঞান করে। শহীদ মিনারকে যেমন বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন থেকে পৃথক করা যায় না, তেমনি বাংলা একাডেমি এবং এই একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত বইমেলাকেও। যে মেলার নামটিই ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ঋদ্ধ।

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৮৯ সাল থেকেই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ, প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও সাধারণ মানুষও গ্রন্থমেলার আয়তন-স্বল্পতার কারণে এর আয়োজনে পরিবর্তন আনার কথা বলতে শুরু করেন। বিশেষ করে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের শেষ বছর ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু এবং এর পরের বছর ১৯৯২ সালে বইমেলার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ অনেক গুণ বেড়ে যায়। মেলায় স্টল নিয়ে বই বিক্রির ব্যাপারে তরুণদের মধ্যেও আগ্রহ বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ তার ভাষায় ‘সৃজনশীল তরুণদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য মেলাকে একাডেমি চত্বরের বাইরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির সৃজনী প্রতিভার মেলা।... আমরা এটিকে শাহবাগের মোড় থেকে হাইকোর্টের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাবার কথা ভেবেছিলাম, অতটা পারিনি। কিন্তু অনেকখানি নিয়ে গিয়েছিলাম, এটার সমালোচনা হয়েছে। আমি এখনো মনে করি, প্রয়োজন হলে সমগ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেকখানি নিয়ে মেলাকে বিস্তৃত করা যায়।’ (জালাল ফিরোজ, অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস, বাংলা একাডেমি/২০২২, পৃ. ১১৬)।

এর অনেক বছর পরে ২০১৩ সালের গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাপরিচালকের এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তৃত প্রান্তরজুড়ে এই মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। অর্থাৎ নব্বই দশকে বইমেলাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত করার বিষয়টি অনেকের কাছে ‘ইউটোপিয়ান চিন্তা’ মনে হলেও বহু বছর পরে দেখা গেলো এটিই বাস্তব সত্য।

প্রশ্ন হলো সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বইমেলাকে কেন সরিয়ে নেয়ার আলোচনাটি উঠল?

গণমাধ্যমের খবর বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরির অংশ হিসেবে চলতি মার্চ মাস থেকে কিছু প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে বইমেলার স্থান নিয়ে নতুন করে জটিলতা ও আলোচনা তৈরি হয়েছে।

যদিও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বইমেলা সরিয়ে নেওয়ার এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন প্রকাশকরা। তারা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে, বইমেলা যদি এখান থেকে সরিয়ে পূর্বাচল বা অন্য কোথাও নেয়া হয়, তাহলে তারা সেই মেলায় অংশ নেবেন না।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘গণপূর্ত এবারও মেলার আগে জায়গাটি বরাদ্দ দিতে আপত্তি করেছিল। পরে বইমেলার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অনুমতি দিয়েছে। আগামী বছর অনুমতি দেবে না বলছে, পরে হয়ত দিতেও পারে। এটা এখনই বলা যাচ্ছে না।’

তবে কিছুটা আশার বাণী রয়েছে নবনিযুক্ত সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহারের কণ্ঠে। বলেছেন, ‘বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলা এখন ঐতিহ্য হয়ে গেছে। এই বইমেলা সরানোর বিষয়ে কথা উঠেছে। আমরা কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে বইমেলা এখানে রাখার ব্যবস্থা করব।’ তার ‍মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

ধর্ম ও দল-মত নির্বিশেষে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব এই অমর একুশে বইমেলা—যেখানে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে প্রাণের সম্মিলন ঘটে। বহু দল, আদর্শ, মত ও পথের মানুষকে একটি জায়গায় এসে জড়ো হওয়ার ‍সুযোগ পান। যেখানে একইসঙ্গে আছে জ্ঞান, চিন্তা, দর্শন, বিনোদন। শুধু বই কেনা কিংবা পাঠকের সঙ্গে লেখকের মিথস্ক্রিয়াই নয় বরং শুধু বন্ধু-পরিজনের সঙ্গে একটু সুন্দর সময় কাটানোর জন্যও লাখ লাখ মানুষ এখানে আসেন। যে কারণে এটিকে বলাই হয় প্রাণের মেলা। সেই প্রাণের মেলাটি প্রাণহীন হয়ে যাবে যদি এটিকে বাংলা একাডেমি ও সোহারাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। 

বাণিজ্যমেলা বা অন্য কোনো শিল্প পণ্যের মেলার মতো এই মেলায় হয়তো জাঁকজমক ভাব নেই। কিন্তু এখানে যে প্রাণ আছে, সেটি অন্য কোথাও নেই। অতএব বইমেলাকে কোনোভাবেই বাংলা একাডেমির থেকে যেমন আলাদা করা যাবে না, তেমনি কোনো ধরনের উন্নয়ন কাজের দোহাই দিয়ে এই মেলাকে সোহারওয়ার্দী উদ্যান থেকেও সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হবে না।

মনে রাখা দরকার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান শুধু একটি সাধারণ খোলা প্রান্তর নয়। এটি ইতিহাসের সাক্ষী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন এখানে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও এই জায়গায় আত্মসমর্পণ করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু এখানে এসেই তার আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে ১৯৯৬ সালে রাজধানীতে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল বেইলি রোড, শিল্পকলা একাডেমি, শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলা একাডেমি, শাহবাগ, হোটেল রূপসী বাংলা ও রমনা পার্ক এলাকা। এসব এলাকার ২৬টি স্থাপনাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল সাংস্কৃতিক বলয়ের আওতায় নিয়ে আসার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ, নিয়াজীর আত্মসমর্পণ, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের উত্থানপর্বের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। কিন্তু গত দুই দশকেরও বেশি সময়ে এই প্রকল্প পূর্ণতা পায়নি। তবে এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণটি বেশি করে আলোচনায় আসছে এখান থেকে বইমেলা সরিয়ে নেয়ার প্রশ্নে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার জন্য কী এমন কাজ হবে যে এখানে বইমেলা করা যাবে না? শোনা যায়, এ বলয়ের প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নাট্যমঞ্চ, অডিটরিয়াম ও আধুনিক রেস্তোরাঁ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তার মানে এখানে বেশ কিছু ভবন নির্মাণ করা হবে।

প্রশ্ন হলো, পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়েই কি উন্নয়নকাজ হবে যে এখানে বইমেলা করা যাবে না? যদি এখানে অবকাঠামো নির্মাণই মূল কথা হয়, তাহলে এই ধরনের উন্নয়নকাজেরও বিরোধিতা করা উচিত। কেননা এর নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। উদ্যান মানে খোলা প্রান্তর। এখানে দাঁড়ালেই মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাতই মার্চ। বঙ্গবন্ধুর তর্জনী। কানে ভেসে আসে সেই দৃপ্ত উচ্চারণ: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অতএব সুউচ্চ ভবন আর রেস্টুরেন্ট বানিয়ে এই উদ্যানকে হয়তো দৃষ্টিনন্দন করা যাবে, মানুষের বিনোদনের জন্য আরেকটা নতুন স্থান গড়ে তোলা যাবে, কিন্তু এই উদ্যানের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সেটি নস্যাৎ হবে কি না; উন্নয়নের করাতে এই ঐতিহাসিক প্রান্তরটি একটি বাণিজ্যিক, দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহৃত হবে কি না; এখানে প্রকল্পই শেষ কথা কি না—সেই প্রশ্নটিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

মনে রাখা দরকার, সংস্কৃতির প্রধান অনুষঙ্গ বই। অতএব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যদি সত্যিই একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তুলতে হয়, তাহলে সেটি হতে হবে বইমেলাকে ঘিরেই। অর্থাৎ উদ্যানের বৃক্ষরাজি অক্ষত রেখে, এর বিশালতা ক্ষুণ্ন না করে এখানে এমন একটি স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে বইমেলা আয়োজনই হবে মুখ্য। বছরের অন্য সময়ও যাতে এখানে বইমেলা বা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির অন্য কোনো আয়োজন করা যায়। সাংস্কৃতিক বলয়কেন্দ্র গড়ে তোলার নামে যাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি গাছও কাটা না পড়ে; অবকাঠামো উন্নয়নের নামে এখানে বড় বড় ভবন বানিয়ে যাতে এর বিশালতা ক্ষুণ্ন করা না হয়; যাতে এই উদ্যানের ঐতিহাসিক চরিত্র নষ্ট করা হয়, সেদিকে বিশেষভাবে ‍দৃষ্টি দিতে হবে। এখানে যেকোনো ধরনের উন্নয়নের নকশা করতে হবে বই, ভাষা এবং মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও চেতনায়। ঠিকাদার এবং দলীয় নেতাদের আর্থিক সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রকল্পভিত্তিক চিন্তা দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ হতে দেয়া যাবে না। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন। এটি স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্র ভাষা আন্দোলনে শহীদের রক্তের প্রশ্ন।

(ছবি কৃতজ্ঞতা: জালাল ফিরোজ, অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস, বাংলা একাডেমি/২০২২।)