মোনায়েম সরকারের জীবনে আলস্যের কোনো অবকাশ ছিল না। বিয়ে করেননি, পরিবার বলতে যা বোঝায় তা তাঁর নেই; সংগঠনই তাঁর পরিবার– মস্ত বড় পরিবার বৈকি! জীবন ও রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে তাঁর বেলায়।
Published : 30 Mar 2023, 10:47 AM
মোনায়েম সরকারের বয়স বাড়ছে, যেমন সবারই বাড়ে। দেখতে দেখতে আটাত্তরে পৌঁছে গেলেন। (জন্ম: ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ) কিন্তু বার্ধক্যের কোনো ছাপ তাঁর ভেতর দেখি না– না তাঁর চিন্তায়, না তাঁর কর্মে।
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় একটি সংগঠন গড়া উপলক্ষ্যে। সেটির নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান বাংলা প্রচলন সমিতি’। ১৯৬৪ সালের কথা, মোনায়েম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র। উদ্যোগটির কেন্দ্রে ছিলেন আমাদের অনেকের সুহৃদ ড. মাহফুজুল হক। তাঁর ছিল অদম্য উৎসাহ ও অফুরন্ত কর্মস্পৃহা। আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে ফিরেছেন, অনেক কাজ করবেন এমন তাঁর স্বপ্ন। মাহফুজুল হক রাজনীতির ছাত্র ছিলেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেবেন এমন আগ্রহও এক সময়ে লালন করতেন; কিন্তু সুযোগ ছিল না। সময়টা আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের। পূর্ববঙ্গ ফুঁসে উঠছে। বিক্ষোভের প্রকাশ নানাভাবে ঘটছে। মাহফুজুল হকের উৎসাহে গঠিত আমাদের বাংলা-প্রচলন সমিতিও ছিল ওই বিক্ষোভেরই একটি অংশ।
সমিতির কাজ এগুচ্ছিল মূলত কয়েকজন ছাত্রের উদ্দীপনায়। মোনায়েম সরকার ছিলেন এদের অগ্রগণ্য। এক সময়ে তাঁকে সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভারও গ্রহণ করতে হয়েছিল। আমরা ‘মাতৃভাষা’ নামে একটি সংকলন এবং ‘বাংলা বলুন, বাংলা লিখুন, অন্যকে বাংলা বলতে সহায়তা করুন, অন্যতর রাষ্ট্রভাষা বাংলার পূর্ণমর্যাদা দিন, শহীদের রক্তদান সার্থক করে তুলুন’– এই বক্তব্য সংবলিত সুন্দর একটি পোস্টার প্রকাশ ও প্রচার করেছিলাম। সমিতির উদ্যোগে একটি আলোচনা সভার অনুষ্ঠান হয়। বড় মাপের একটা কাজ ছিল বাংলা বইয়ের প্রদর্শনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। কর্মসূচির সবকটিতেই মোনায়েম সরকারের সাংগঠনিক শক্তি বিশেষভাবে কার্যকর ছিল।
অনেক পরে তাঁর সাংগঠনিক শক্তির সঙ্গে আরেকবার পরিচিত হই। দেখলাম নেতৃত্বদানের ও সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার সেই একই প্রসন্ন কিন্তু দৃঢ় দক্ষতা। সেটি দেখতে পেলাম কবি শামসুর রাহমানের ওপর মৌলবাদী জঙ্গিদের আক্রমণের প্রতিবাদের কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আয়োজিত সংস্কৃতিসেবীদের এক সভায়। স্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির একটি মিলনায়তনে। সভা পরিচালনায় ছিলেন মোনায়েম সরকার। অনেকেই অনেক কথা বলছেন, যেমন বলার কথা; কিন্তু দেখলাম মোনায়েম দক্ষতার সঙ্গে আলোচনাকে নিয়ে আসছেন কর্মসূচি ও দায়িত্ব বণ্টনের প্রয়োজনীয় জায়গাটাতে। সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সফল ও বড় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল শহীদ মিনারে।
তাঁর লেখার সঙ্গে আমি পরিচিত। পত্রিকায় পড়েছি, বইতেও পড়ার সুযোগ হয়েছে। ‘নতুন দিগন্ত’ নামে আমরা একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করি। এই পত্রিকায় মোনায়েমের আত্মজীবনীমূলক একটি রচনা আমরা ধারাবাহিকভাবে ছেপেছি; নাম ছিল ‘একজন রাজনৈতিক কর্মীর প্রতিচ্ছবি’। রচনাটির সঙ্গে একটি দ্বিতীয়াংশ যুক্ত হয়ে ‘আত্মজৈবনিক’ নাম দিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালের বইমেলায়।
এই প্রকাশনাটির গুরুত্ব দুই দিক থেকে। প্রথমত, এতে সমাজের একটি ছবি আছে। দ্বিতীয়ত, এতে রয়েছে দেশের চলমান রাজনীতির জানা-অজানা নানা খবর ও তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ। মোনায়েম সরকারের স্মৃতিশক্তি প্রখর ও অভ্রান্ত। বহু ঘটনাকে তিনি ছেঁকে তুলেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই মন্তব্য না-করেও নীরব বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন। এমন অনেক অজানা ঘটনাকে তিনি স্মরণে রেখেছেন, যেগুলো সমাজ ও রাজনীতিকে বোঝার জন্য সহায়ক হয়। তাঁর কাহিনীতে ব্যক্তি অবশ্যই আছেন; কিন্তু ব্যক্তি যে প্রধান হয়ে উঠেছেন তা নয়, এবং যে ব্যক্তিটি উপস্থিত রয়েছেন তাঁর ব্যক্তিত্বটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সব ঘটনারই তিনি সতর্ক দর্শক, কোথাও কোথাও আবার অনুঘটক।
বোঝা যায় যে, তিনি বিদ্যমান সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে বুঝেছেন। বাস্তবতার নির্মমতা ও তাঁর ভেতরকার অন্যায়, বিশেষ করে ধনবৈষম্য তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এটা বুঝেছেন এবং আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছেন যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাটাই যথেষ্ট নয়; মানুষের মুক্তি আনতে হলে যে পুঁজিবাদী কাঠামোর ভেতরে দুঃসহ ওই বাস্তবতাটা টিকে আছে ও শক্তি সঞ্চয় করছে, তাকে পাল্টানো চাই। ওই বোধের তাড়নাতেই তিনি সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। ইচ্ছা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন, এবং সে ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ অবশ্যই করার কথা ছিল; কিন্তু রাজনীতিই ছিল তাঁর নেশা। পেশা যদি বলতে হয় তবে সেটাও ওই রাজনীতিই। তবে সে-রাজনীতি ক্ষমতা লাভের নয়। মন্ত্রী নয়, এমনকি সংসদ সদস্যও নয়, রাজনীতির কর্মীই রয়ে গেলেন সারাটা জীবন।
তাঁর আস্থা ছিল মার্কসবাদে। এই ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণাটি যেমন বাইরের প্রভাব ও পর্যবেক্ষণ থেকে এসেছে, তেমনি আনুকূল্য ছিল পরিবারের ভেতরও। তাঁর বড় দুই ভাইকে আমি জানি; দুজনেই ছিলেন মার্কসবাদী। এরা হলেন আবদুল মান্নান ও ড. আবদুল মালেক। আবদুল মান্নান সরকারি চাকরি করতেন। এখন তিনি আমাদের মধ্যে নেই; কিন্তু সব সময়েই ছিলেন বাম রাজনীতির সমর্থক। ড. আবদুল মালেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন; এখন থাকেন বিদেশে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভুলরূপে বস্তুবাদী; কেবল সমাজ ও রাষ্ট্রকে যে তা নয়, বিজ্ঞানের জগৎকেও তিনি দেখেন দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাঁর দু’ভাই ছিলেন প্রধানত তাত্ত্বিক; মোনায়েম সরকার যেমন তত্ত্ব বুঝেছেন তেমনি বাস্তব জগতে তত্ত্বের প্রয়োগের জন্য ক্ষেত্র খুঁজেছেন। এ কারণেই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সার্বক্ষণিকভাবে যোগদানটা তাঁর জন্য ছিল অনিবার্য। বহু বিপদ-আপদ-দুর্যোগ-সঙ্কট সত্ত্বেও সেখান থেকে তিনি সরে আসেননি।
থাকার কথা ছিল সমাজতান্ত্রিক ধারাতেই, সেখানেই ছিলেন, পরে যুক্ত হয়েছেন জাতীয়তাবাদী ধারায়। এর কারণ সমাজতান্ত্রিক ধারাটি মূলধারায় পরিণত হতে পারেনি। বাংলাদেশে প্রবহমান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি বড় দুর্বলতা ছিল এই যে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীনে প্রধান দ্বন্দ্বটি যে ছিল পাঞ্জাবি শাসকদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মানুষের, সেটিকে জানা সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রীরা তাকে প্রাধান্য দিতে পারেননি। সমাজতন্ত্রীদের ভেতর মতপার্থক্যও ছিল, যে জন্য তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে বেগবান করতে ব্যর্থ হলেন। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বলতা টের পেয়ে মোনায়েম সরকার শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী ধারায় যোগ দেন। অনেকেই তা করেছেন। বড় দল দুটির এটিতে বা সেটিতে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ বড় পদ পেয়েছেন, অনেকেই কোনো না কোনোভাবে ভাগ পেয়েছেন ক্ষমতার।
মোনায়েম সরকারের রাজনীতি কিন্তু একেবারেই ভিন্ন ধরনের। সেটি সব সময়েই ছিল সমাজ পরিবর্তনের। ক্ষমতার লিপ্সা তাকে কখনোই তাড়া করেনি। তিনি সাংগঠনিক কাজ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন অনেক সময়ে। লিখেছেন। যোগ দিয়েছেন সম্মেলনে। পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর জীবনে আলস্যের কোনো অবকাশ ছিল না। বিয়ে করেননি, পরিবার বলতে যা বোঝায় তা তাঁর নেই; সংগঠনই তাঁর পরিবার– মস্ত বড় পরিবার বৈকি! জীবন ও রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে তাঁর বেলায়।
যে ব্যবস্থাকে তিনি বদলাতে চান সেটি কতটা যে শক্তিশালী, কেমন যে নিষ্ঠুর তা তাঁর অজানা নেই। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। অবিচল রয়েছেন। তাঁকে আমি সমাজ পরিবর্তনের সৈনিক হিসেবেই দেখি এবং খুব ভালো লাগে লক্ষ করতে যে তিনি তাঁর অঙ্গীকার থেকে সরে আসেননি এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিক কাজে কখনো বিরতি দেননি।
তাঁর জন্মদিনে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইল।