উত্তরে মরুর হাওয়া

মরুর মতো শুষ্ক লু হাওয়ায় ফাটছে ঠোঁট, চামড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাতের বেলা আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভোরের দিকে অনেকটা শীত শীত মনে হয়।

সাঈদ ইবরাহীম রিফাতসাঈদ ইবরাহীম রিফাত
Published : 28 April 2023, 08:28 AM
Updated : 28 April 2023, 08:28 AM

দেশের উত্তরবঙ্গের একটি শহরে আমার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনার প্রয়োজনে যদিওবা এখন থাকি রাজধানীর উপকণ্ঠে। তবু ছুটিছাটায় বাড়ি ফিরে যাই, গরমের ছুটি তার মধ্যে অন্যতম। এবার অবশ্য গরমের ছুটির সঙ্গে যোগ হয়েছিল রমজান মাস, কাজেই বেশ লম্বা একটা ছুটি পেয়েছিলাম।

নিজ শহরে ফিরে এসে দেখলাম, মরুভূমির তপ্ত হাওয়া বইছে! চারদিকে কাঠফাঁটা রোদ, নেই এতটুকু বৃষ্টি। পদ্মা নদীর চর একদম তীর ঘেঁষে চলে এসেছে, নদী যেন খাল হয়ে গেছে! বাতাস  থাকলেও তা মরুময় উষ্ণতা নিয়ে আসছে। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত শহরবাসীর। রমজানের সময়, দিনের বেলায় ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ছিলেন রোজা। তীব্র দাবদাহে প্রচণ্ড পিপাসাকে উপেক্ষা করে মাঠেঘাটে বাজারে দৈনন্দিন কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কোনোমতে দিনের সময়টুকু পার করতে পারলে যেন বাঁচি। এই গরমেও খেয়াল করলাম, শরীরে ঘাম যেভাবে হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। বরং শীতকালের মতো ঠোঁট ফেটে যাচ্ছে। এই অবস্থা মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের ২০ তারিখ এই সময় পর্যন্ত। এই লেখা যখন লিখছি তখনও দু-একবার ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির দেখা মিলেছে, তবে তা খুব বেশি নয়। দাবদাহ যায়নি। আবহাওয়া অফিস বলছে, দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বাদে (সিলেট, বান্দরবান) সারাদেশে দাবদাহ অব্যাহত থাকবে আরও কয়েক দিন। ক্রমাগত দাবদাহে যখন ওষ্ঠাগত প্রাণ, ভাবতে নিশ্চয়ই মনে চায়, এবার এতো গরম কেন!

নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর বাংলাদেশে এমন দাবদাহ নতুন কিছু নয়। ভৌগোলিক কারণে এই অঞ্চলের আবহাওয়ার আর্দ্রতা তুলনামূলকভাবে বেশি। গরমে যা আরো বেড়ে যায়। এ কারণে এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশি থাকে। সুদীর্ঘকালের জলবায়ুর ইতিহাস তাই বলে। বাংলাদেশের উত্তরের উঁচুভূমি বরাবরই আবহাওয়া বন্ধুর। শীতের সময় তীব্র শীত, গরমের সময় তীব্র গরম। এমনটিই  বরেন্দ্রভূমির আবহাওয়ার ধরন, অনেক আগে থেকেই। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও খুব নতুন এমন কিন্তু নয়। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী শহরে একবার ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছুঁয়েছিল। তারপরও এবার কি একটু বেশিই গরম না?

সত্যিটা হলো, তাপমাত্রা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে। দেশের জলবায়ু পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এখন কার্যত ঋতু হয়ে গেছে দুটি, শীত আর গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মের তাপমাত্রার ধারাবাহিকতা অতীতের যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে। আগের সেই আর্দ্রতার কারণে ভ্যাপসা গরম অনুভূত হওয়ার যে ব্যাপারটি এখন তেমন নেই। বরং এবারই দেখা গেল বাতাসের আর্দ্রতা গরমের সময়ও বেশ কম। সাধারণত অন্যান্য সময় আপেক্ষিক আর্দ্রতার হার থাকে ৬৬ শতাংশ, যা এবার ৪৪ শতাংশে নেমেছে। আর্দ্রতা কম থাকলে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, তাপ সরাসরি গায়ে লাগে।

২০১৪ সালের পর এবারই প্রথম উত্তরবঙ্গের পাবনায় দেশের তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ছুঁয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ছিল, যা প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু রাজশাহীতেই দাবদাহ চলছে ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে। কারণ মূলত লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও দাবদাহ চলেছিল বেশ কদিন। রাজশাহীতে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল টানা তিন দিন। অতি তীব্র দাবদাহে এখানকার জনজীবন এক প্রকার স্থবির হয়ে যেতে বসেছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির কারণে নলকূপের গভীরতাও নেমে যেতে শুরু করেছে। পাশাপাশ, মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আছে লোডশেডিং। প্রায়শই দেখা যাচ্ছে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাসা বাড়ির আইপিএস। বিদ্যুতের দেখা পাওয়া যেন পূর্ণিমার চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো।

সাধারণত দাবদাহ দেশে বিরাজমান থাকে ৪ থেকে ৮ দিন। তবে এবার ১৪ দিনেরও বেশি সময় ধরে থাকায় তা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে এ দেশের আবহাওয়াবিদদের। পাশাপাশি, এবারের দাবদাহের একটি বড় পরিবর্তন আছে। আগে দেখা যেত, আর্দ্রতা বেশি হওয়ার কারণে গরম বেশি অনুভূত হতো, ঘাম হতো। অথচ এবার আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, আর্দ্রতা বেশ কম। যে কারণে গরম অনুভূত হলেও ঘামছে না মানুষ। মরুর মতো শুষ্ক লু হাওয়ায় ফাঁটছে ঠোঁট, চামড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাতের বেলা আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভোরের দিকে অনেকটা শীত শীত মনে হয়। কিন্তু দিনের শুরু হতে না হতেই তাপমাত্রার এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তন কেন?

২০ এপ্রিলের পর দাবদাহ কিছুটা কমে আসলেও এখনও সে অর্থে স্তিমিত হয়নি। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, তাপের তীব্রতা এখনও সহনশীল পর্যায়ে আসতে কিছুটা সময় লাগবে। এ সময়ে ঝড় ও মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। অবশ্য এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বালু ঝড় এবং শিলাবৃষ্টির খবর পাওয়া গিয়েছে। তবে বৃষ্টির পরিমাণ মোটেও যথেষ্ট ছিল না।

এভাবে তাপমাত্রা বাড়ার কারণটা খুবই সঙ্গত, দেশে বনভূমির পরিমাণ বিগত যেকোনো সময়ের থেকে বর্তমানে অনেক দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে। দেশ এক প্রকার মরুকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শিল্পায়ন বাড়ছে, বাড়ছে নগরায়ন। এর সঙ্গে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। বর্তমানে ১৬ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে বনভূমি। এদিকে বৃক্ষনিধন হলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুটো চারা রোপন যে করতে হবে, এমন ধ্যানধারণাকে 'থোড়াই কেয়ার' করছে শিল্পপাড়ার উন্নত মানুষেরা। মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দেশে। যার পরিণামস্বরূপ এমন আর্দ্রতাহীন শুষ্ক হাওয়া বইছে দেশজুড়ে।

আশঙ্কার ব্যাপারটি হচ্ছে, বাংলাদেশের জলবায়ুর ধরনটি একটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের নিয়ামক যে মূলত মানবসৃষ্ট কারণ, এটি শুধু আমার ভাষ্যই নয়। বিজ্ঞানীরাও একই কথা বলছেন। এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত যে আবহাওয়ার স্বরূপ, তার ধারণায় পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় অশনিসংকেত। কারণ এর ফলে পরিবর্তন ঘটবে এখানের মাটি ও ফসলের। যার প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনযাত্রায়। দীর্ঘদিন থেকে যা হয়ে আসছে, তা হয়তো সম্ভব হবে না।

শিল্পায়ন পৃথিবীকে আধুনিক করেছে বটে, একই সঙ্গে রেখে যেতে চলেছে বন্ধুর আবহাওয়া। প্রকৃতি হয়ে উঠছে প্রতিশোধপরায়ণ। পৃথিবীজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি নতুন কোন বিষয় নয়। বরং বিজ্ঞানীরা বেশ আগেই জানিয়েছেন এমনটি হবে।

ক্রমাগত বৃক্ষনিধন পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রভাবকে মোকাবেলা করতে পারছে না। পরিবেশ হয়ে উঠছে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবার ফল হিসেবে প্রকৃতি তার রুদ্ররূপ দেখাতে শুরু করেছে। প্রথমে দাবদাহ, তারপর পালা শুরু হয়েছে কালবৈশাখীর। এর মধ্যে যতটুকু বৃষ্টি, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আজ থেকে দেড়শ বছরের আগের পৃথিবী এত উষ্ণ ছিল না। এই শতকে কেন এত তাপমাত্রা বাড়ছে? বিস্তীর্ণ জমি পরিণত হয়েছে উঁচু অট্টালিকায়, গ্রাম পরিণত হয়েছে নগরে। গ্রামের সেই স্নিগ্ধ, শীতল পরিবেশ এখন আর নেই। নগরায়নে প্রাপ্তি কী আমাদের? আমার মনে আছে, বছর দশেক আগে রাজশাহীতে এত বেশি উঁচু অট্টালিকা ছিল না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ফসলি জমির উপর দিয়ে হয়েছে বাইপাস রাস্তা। পুকুর ভরাট করে তোলা হয়েছে উঁচু উঁচু দালান। নষ্ট হয়েছে এখানকার স্বাভাবিক সবুজ পরিবেশ। নগরায়নে কাজের কাজ কি হয়েছে?  বরং শহর হারিয়েছে তার স্বাভাবিক স্বকীয়তা। হয়ে উঠেছে কৃত্রিম।

দেশের আয়তন কম, জনসংখ্যা বেশি। এই চাহিদাকে নিমিত্তে রেখে প্রয়োজনীয় বাসস্থান তৈরির তাগাদা থাকবেই। তবে মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছাড়া মানবসভ্যতা কিছুই নয়। অবাধে বন উজাড়, বৃক্ষ নিধন, প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হলে প্রকৃতিও ছেড়ে কথা বলবে না। শিল্পায়ন ও মানব সভ্যতার স্বেচ্ছাচারিতার যে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা প্রয়োজন এই দাবদাহ সেটাই যেন বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে।