আমজনতার পরীক্ষিত বন্ধু পঙ্কজ ভট্টাচার্য

এক নিরীহ গাড়িচালকের পঙ্কজদার লোক হয়ে ওঠা, এইখানেই পঙ্কজ ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক বহুমাত্রিকতা। আমি প্রায়ই বলি যে কয়জন রাজনীতিবিদকে বলা যায় তাঁরাই বাংলাদেশ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য তাঁদের শীর্ষস্থানীয় একজন।

দীপায়ন খীসাদীপায়ন খীসা
Published : 25 April 2023, 10:30 AM
Updated : 25 April 2023, 10:30 AM

পঙ্কজ ভট্টাচার্য তাঁর প্রয়াণের আগ পর্যন্ত ঐক্য ন্যাপের সভাপতি ছিলেন। এটি তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। এই দেশের রাজনীতিতে আমজনতা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। ক্ষমতার বলয় থেকে, প্রচলিত সামজিক স্তর বিন্যাসের যে কাঠামো সেই অবস্থান থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা বঞ্চিত মানুষের আরেক নাম আমজনতা। পঙ্কজ ভট্টাচার্য সেই আমজনতারই বন্ধু, পরীক্ষিত বন্ধু।

এই যে লেখাটা লিখছি এমন সময়ে মুঠোফোনে শামীমের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কে এই শামীম? শামীমের একটা নোয়া গাড়ি আছে, তিনি এই গাড়ি চালিয়ে জীবন নির্বাহ করেন। প্রথমে শুধু চালকই ছিলেন, পরে গাড়িটির মালিক হয়ে যান। কিন্তু শামীমের আরেকটি পরিচয় আছে, সেটা হচ্ছে তিনি পঙ্কজ ভট্টচার্যের মানুষ। এক নিরীহ গাড়িচালকের পঙ্কজদার লোক হয়ে ওঠা, এইখানেই পঙ্কজ ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক বহুমাত্রিকতা। আমি প্রায়ই বলি যে কয়জন রাজনীতিবিদকে বলা যায় তাঁরাই বাংলাদেশ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য তাঁদের শীর্ষস্থানীয় একজন। ৫২ পরবর্তী গড়ে ওঠা ৬০ দশকের ছাত্র গণ-আন্দোলন, সেই ছাত্র গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র পত্তনের যে ঐতিহাসিক ধাপগুলো রয়েছে তার প্রতিটি ধাপেই পঙ্কজ ভট্টাচার্যের গৌরবোজ্জ্বল অনবদ্য ত্যাগী ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পঙ্কজ ভট্টাচার্য আমৃত্যু বিরামহীনভাবে দেশমাতৃকার জন্য নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন।

জুম পাহাড়ের একজন মানুষ, দেশের প্রান্তজনদের একজন হিসেবে পঙ্কজ ভট্টাচার্য স্বাভাবিকভাবে আমারও একজন হয়ে গিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের লাগোয়া জনপদ চট্টগ্রামের রাউজানে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের জন্ম। ওই সূত্রে পাহাড়ের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছাত্রজীবন থেকে। পাহাড়ের কিংবদন্তী বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সঙ্গে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক ছিল। ওই সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, লারমা আর তিনি জেলমেট এবং রুমমেট ছিলেন। একই জেলে একই কক্ষে তাঁরা অনেকদিন ছিলেন। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নতুন সংবিধান রচনার প্রাক্কালে মানবেন্দ্র লারমার সেই ঐতিহাসিক সংসদীয় বিতর্কের দিনগুলোর কোনো এক রাতে তৎকালীন ন্যাপ অফিসে দেশের পরিস্থিতি, লারমার ভাবনা এইসব সারারাত নানান আলাপের মধ্যে কাটনোর স্মৃতির কথা পঙ্কজ ভট্টাচার্য বহুবার আমাদের বলেছিলেন। আমরা তখন ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি নিচ্ছি।

৯০-এর দশকের কথা, ৯০ পরবর্তী সময়ের কথা, জুম পাহাড় তখনও কঠিন সেনাশাসনের বেড়াজালে। ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল সংগঠিত হয় লোগাং গণহত্যা। ওই সময় পঙ্কজ ভট্টাচার্যসহ দেশের বিভিন্ন পেশার নাগরিকবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল খাগড়াছড়ি অবস্থান করছিলেন। লোগাং গণহত্যার খবর পেয়েই খাগড়াছড়ি থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিল দলটি। এই ছুটে যাওয়াটাই পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বিশেষ গুণ। যখনই দেশের আদিবাসী জনগণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে, পঙ্কজ ভট্টাচার্য দলবল নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই জনপদে পোঁছে যেতেন। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির আগপর্যন্ত এভাবেই পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছুটে বেড়িয়েছেন পুরো বাংলাদেশ। এখানেই পঙ্কজ ভট্টাচার্য ব্যতিক্রম। পঙ্কজ ভট্টাচার্যের এই ছুটে বেড়ানোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আমিও সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। পঙ্কজদার সঙ্গে বিভিন্ন আক্রান্ত জনপদে দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে নানান জায়গায় চষে বেড়ানোর এক দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এইভাবে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে রাজনৈতিক সম্পর্ক অতিক্রম করে এই আমিও পঙ্কজদার একজন হয়ে উঠি। দাদার পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি পোঁছে যাই।

সময়টা মনে নেই। একবার দিনাজপুরের হিলির বন্দরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছিল। পঙ্কজদার নেতৃত্বে আমরা সেখানে গেলাম। দিনাজপুর পোঁছানোর পর দাদা বললেন, ভোরে তিনি এক জায়গায় যাবেন। আমি যেন তাঁর সঙ্গে থাকি। যথারীতি ভোরে উঠে রওনা দিলাম। সেখানে যাওয়ার পর একজন দরজা খুললেন, তিনি অবিকল পঙ্কজদার মতো দেখতে। পঙ্কজদা পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালেন, গৃহকর্তা তাঁরই অগ্রজ সহোদর। চাকরিসূত্রে এসে দিনাজপুরে স্থায়ী নিবাস গড়েছেন। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। কারণ পঙ্কজদার জন্ম চট্টগ্রামে, সেই পাকিস্তান আমলেই দাদার স্বজনরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর একজন অগ্রজ সহোদর দিনাজপুরে থাকেন। বস্তুত এই চমকটি দেওয়ার জন্যই দাদা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলেন সেটা গোপন করেছিলেন।

গাইবান্ধার বাগদা ফার্মের সাঁওতাল-বাঙালিদের ভূমি উদ্ধার আন্দোলন যখন খুবই প্রাথমিক রূপে ছিল। সেই আন্দোলনে সমর্থন করা নিয়ে অনেকেই দ্বিধান্বিত ছিলেন। তখন পঙ্কজ ভট্টাচার্য দৃঢ়তার সঙ্গে ওই আন্দোলনে নিঃশর্তভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আদিবাসী রাজনীতির সক্রিয়জন হিসেবে দেশের অনেক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়মিত একটা সম্পর্ক রাখতে হয় আমার। নানা বিষয়ে আলাপ করতে হয়। সমর্থন ও সহযোগিতা চাইতে হয়। অনেককে দেখেছি নানান অংক করেন। কিন্তু পঙ্কজ ভট্টাচার্যের অংক একটাই। সেটা হচ্ছে আদিবাসী জনগণের পাশে থাকা। তাদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়া মানুষ নিয়ে বিশেষ করে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য খুবই উৎকণ্ঠায় থাকতেন। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর হওয়ার পরও সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না। সরকারকে কীভাবে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করা যায় এটা ভাবতেন তিনি। চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা ভাবতেন। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি যখনই আলোচনা করতেন সকল আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং দেশের আদিবাসীদের দাবিদাওয়াগুলো যেন অগ্রাধিকার দেওয়া হয় সেই আলাপটার ওপর জোর দিতেন।

কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশে পোঁছাবার আগে পঙ্কজদার সহধর্মিনী নারীনেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দাদা রাখী বৌদিকে নিয়ে আসামের গৌহাটিতে চিকিৎসার জন্য যান। সেই গৌহাটিতে চিকিৎসারত অবস্থায় ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল রাখী দাশ পুরকায়স্থ প্রয়াত হন। পঙ্কজদা যখন খবরটি দিচ্ছিলেন, তখনই মাত্র একবার দাদার কণ্ঠে যে বেদনার সুর শুনতে পেয়েছিলাম সেই সুর এখনও আমার কানে বাজে। তারপর রাখী বৌদির মরদেহ যখন চিতায় দাদার সেই নিষ্পলক, মৌন তাকিয়ে থাকার ছবি আমাকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল। কোভিড মহামারী কিছুটা শিথিল হলে দাদা দেশে ফিরে আসেন। আবারও তাঁর সেই পরিচিত রাজনৈতিক জীবনে ফিরলেন। কিন্তু কোভিড বিধির কারণে দেশ চষে বেড়ানোর কাজটা দাদার বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু আমরা যারা সেই কাজটি চলমান রেখেছিলাম দাদা তাদের নিয়মিত খবরাখবর নিতেন। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের শাল্লা যখন আক্রান্ত হলো, দাদা খুবই সক্রিয়তার সঙ্গে আমাদেরকে নানান জায়গায় যোগাযোগ করিয়ে দিলেন যেন আমাদের যাওয়া-আসাতে তেমন সমস্যা না হয়। এইভাবেই পঙ্কজদা নানান শারীরিক জটিলতার মধ্যেও সক্রিয় থেকেছেন।

উত্তরবঙ্গের আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন রংপুরের হাসপাতালে কঠিন সময় অতিক্রান্ত করছেন। রবীনদাকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য সাহসের দরকার। আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। সিদ্ধান্তে যেতে পাছিলাম না। ওই দুঃসময়ে পঙ্কজদা দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছিলেন দ্রুত যেন রবীন্দ্রনাথ সরেনকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং তিনিই এই দায়িত্ব নিচ্ছেন। এই হচ্ছেন পঙ্কজদা। শেষ দিকে এসে অসুস্থতার কারণে পঙ্কজদাকে গৃহবন্দীর মতো জীবনযাপন করতে হয়েছে। ঘরে থেকেই ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন সাপোর্ট নিতে হতো। কিন্তু ওই সময়ও তিনি দারুণ সক্রিয় থেকেছেন। বাসায় বসেই নিয়মিত দৈনন্দিন রাজনৈতিক কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। বিভিন্নজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে নানান বিষয়ের খোঁজ খবর নিতেন। সহযোদ্ধাদের পরামর্শ দিতেন।

পঙ্কজদার জীবনের শেষ ৩টি কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটা হচ্ছে একুশে বইমেলায় প্রকশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার সেই সব দিন’ এবং অরেকটি হচ্ছে তাঁর জীবনসঙ্গী রাখী দাশ পুরকায়স্থ স্মরণে প্রকশিত স্মারকগ্রন্থ। অন্য কাজটি ছিল জুম পাহাড়ের জনগণের জন্য। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন নামে গড়া ওঠা সংগঠনটির কর্মসূচি বাস্তবায়নে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং সামগ্রিকভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন জোগাতে অন্যদের অনুপ্রাণিত করা। এই কাজটির সঙ্গে পঙ্কজ ভট্টাচার্য হাসাপাতালে ভর্তি হওয়ার আগপর্যন্ত নিবিড়ভাবে সক্রিয় ছিলেন।

পঙ্কজ ভট্টাচর্যের মহাপ্রয়াণে দেশের নিপীড়ত জাতিসমূহ একজন শেষ ভরসার পরম বন্ধুকেই হারাল। একইসঙ্গে শামীমদের মতো আমজনতা তাদের পরীক্ষিত বন্ধুটির অভাব অনুভব করবে প্রতিটি বিপদের অসহায় ক্ষণগুলোতে।

তারপরও বিদায়ী অভিবাদন। লাল সালাম কমরেড পঙ্কজ ভট্টাচার্য।