মুদ্রাস্ফীতি শোষণের কার্যকর হাতিয়ার

সুদ খাওয়া পাপ মনে করে সঞ্চয়পত্র না কিনে টাকা ব্যাংকে ফেলে রাখছেন যারা, ধরা যাক ৫ বছর ধরে এক লাখ টাকা ব্যাংকে ফেলে রাখলেন, পঞ্চম বছরের শেষে দেখবেন ওই এক লাখ টাকা ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে ৫১ হাজারের সমান হয়ে গেছে।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 3 May 2023, 03:41 AM
Updated : 3 May 2023, 03:41 AM

প্রকাশ্যে স্বীকার করা হোক বা না হোক, পুঁজিবাদী সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য, কীভাবে, কোন ফিকিরে আপনার-আমার পকেটের টাকা ওরা এগারো জনের পকেটে নেওয়া যায়। অর্থনীতিবিদদের সাফাই হচ্ছে, এভাবে তাদের পকেটে মূলধন গঠিত হবে এবং ওই মূলধন পুনরায় বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। কর্মসংস্থান বাড়া মানে পণ্যের বিক্রি বাড়া এবং তার ফলে আখেরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমস্যা হচ্ছে, ওরা এগারো জনের পকেটস্থ টাকার খুব কমই বিনিয়োগ হয়, বেশিরভাগ বিদেশ পাচার হয়ে কানাডায় বেগমপাড়া, দুবাইতে মাইট্যা শেখপাড়া গড়ে ওঠে।

এই অপকর্মের খুবই কার্যকর এক অপ-হাতিয়ার মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি সমাজের বেশিরভাগ লোকের শ্রেফ ক্ষতিই করে। সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুদ্রাস্ফীতির ফলে সঞ্চয় হ্রাস পায় এবং বিনিয়োগ কমে যায়। ব্যষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে বহু কষ্টে সংসার চালাতে গিয়ে মানুষ খামোকা দুশ্চিন্তায় ভোগে, সমাজে অস্থিরতা বেড়ে যায়। এর ফলে বর্তমানে ও আখেরে কী কী ক্ষতি হয় ব্যক্তি ও সমাজের তা গবেষণার বিষয়।

কিনস সাহেব নিদান দিয়েছেন, বড়সড় কোনো যুদ্ধের পর সরকারকে যেকোনো ছুঁতায়, কোনো একটা অজুহাত বের করে ব্যয় বাড়াতে হবে, সে অবকাঠামো নির্মাণই হোক, কিংবা হোক অস্ত্রনির্মাণ। ব্যয় বাড়াতে হলে টাকা ছাপতে হবে। কতটা ব্যয় বাড়াতে হবে, কত টাকার বেশি ছাপা যাবে না? এই দুই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সরকারগুলো এই প্রশ্ন আদৌ করে কিনা সন্দেহ।

১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ এই পাঁচ বছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার উপরোক্ত কিনসীয় নিদান মেনে চলেনি। মার্কিন সরকার তার ব্যয় ৭৫% কমিয়ে এনেছিল এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়েছিল। এ ধরনের বাজেট-কর্তন ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ কিনসের হিসাবমতো বিপজ্জনক হবার কথা ছিল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এর ফলে মার্কিন অর্থনীতি সংকোচিত হওয়া দূরে থাকুক বরং ফুলেফেঁপে উঠেছিল।

১৯৪৪ সালের ব্রিটন উডস সম্মেলনে ডলারকে সারা পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের ‘সবেধন রিজার্ভমানি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছিল না, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা দিনকে দিন তার মূল্য হারাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণের যে দাম নির্ধারণ করেছিল, আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার, বাজারে স্বর্ণের মূল্য তার চেয়ে বাড়তে শুরু করল। ডলার থেকে শুরু করে সব মুদ্রারই দাম কমছিল, বেশি মুদ্রা ছাপানোর কারণে। মার্কিন সরকার সিদ্ধান্ত নিল, রিজার্ভে জমা থাকা কিছু স্বর্ণ তারা বাজারে বিক্রি করে দেবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছিলেন, এর ফলে বাজারে স্বর্ণের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে স্বর্ণের দাম কমে আসবে।

তাই করা হয়েছিল এবং কয়েক মাস পর্যন্ত স্বর্ণের দাম নিম্নমুখী ছিল বটে। ডলার শুধু নয়, ফ্রাঁ, মার্ক, ইয়েন সব মুদ্রারই দাম কিন্তু কমছিল। সুতরাং ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ইত্যাদি দেশও চাইল, তাদের রিজার্ভ স্বর্ণ বাজারে ছেড়ে দিতে। কিন্তু তাদের স্বর্ণ তো জমা রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ভল্টে। একাধিক দেশ ওই স্বর্ণ ফেরত চাইল। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি শার্ল দ্য গল ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সের গচ্ছিত স্বর্ণ ফেরত নিয়ে আসতে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠালেন নিউ ইয়র্কে। ফ্রান্সের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জার্মানিও তার স্বর্ণ ফেরত পেতে চাইল।

এর ফলে প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে স্বর্ণের রিজার্ভ কমে আসছিল এবং দ্বিতীয়ত, বাজারে স্বর্ণ বিক্রি করেও স্বর্ণের দাম কমানো যাচ্ছিল না। ১ আউন্স স্বর্ণের দাম ৩৫ ডলারের বেশি হওয়া মানেই ডলারের দাম কম– এ তথ্যে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। যাদের কাছে ডলার, ফ্রাঁ বা মার্ক ছিল, তারা কাগজের ডলারের ওপর বিশ্বাস রাখতে না পেরে স্বর্ণ কেনার দিকে ঝুঁকছিল। এর ফলে স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াতে স্বর্ণের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য হয়ে ডলারের দাম কমাতে হয়েছিল।

বর্তমানেও স্বর্ণের দাম উর্ধ্বমুখী। এবারও কি মার্কিন সরকার ডলারের দরপতন ঘটাবে?

এটা অনেকটা, ‘খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে বাজার থেকে বিতাড়িত করে’– অর্থনীতির যুগান্তরের সেই বিখ্যাত সূত্র। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে এই স্বতঃসিদ্ধের কথা আমরা জানি, কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এই প্রবণতার কথা বলেছিলেন, নিকট অতীতে বলেছিলেন থমাস গ্রেশাম (১৫১৯-১৫৭৯), অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে যা ‘গ্রেশামের সূত্র’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এটি মূলত মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতার প্রতিফলন। আপনি যদি নিশ্চিত জানেন যে কোনো মুদ্রা আসলেই খারাপ, অর্থাৎ মুদ্রাটি দ্রুত তার ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে কিংবা ধরা যাক, অনতিবিলম্বে এই মুদ্রা তার সব মূল্য হারাবে, তখন সেই মুদ্রা দিয়ে আপনি যা সামনে পাবেন, তাই কিনবেন, ডলার, স্বর্ণ ইত্যাদি পেলে তো ভালোই, না পেলে আপনি জমি কিনবেন, জমি না পেলে নারকেল কিংবা মিষ্টি কুমড়া হলেও কিনবেন, যতক্ষণ সুযোগ থাকবে।

‘সকলি গরল ভেল!’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের বাঁধ একদিন ভেঙে গেল। ১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন স্বর্ণমানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। এই তারিখ থেকে স্বর্ণ এবং ডলারের মধ্যে পরস্পর নির্ভরতার সর্বশেষ সূত্রটিও ছিন্ন হয়ে গেল। তখন থেকে, পণ্য ও পুঁজির বাণিজ্যিক ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে আইএমএফ ডলারের সঙ্গে দেশীয় মুদ্রা এবং দেশীয় মুদ্রাগুলোর পরস্পরের মধ্যে বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছে।

ফিয়াট মানির সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে মার্কিন রাজনীতিতে এবং বিশ্বের রাজনীতিতেও। গৃহায়ন, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কী পরিকল্পনা নিয়ে আসছেন, তার ওপর এক সময় নির্বাচনে হার-জিত নির্ভর করত। ১৯৭১ সালের মধ্য অগাস্টের পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা, সে ডেমোক্র্যাট হোক বা রিপাবলিকান, ফিয়াট মানির ব্ল্যাংক চেক পেয়ে গেছেন। তখন থেকে অর্থনীতির অমোঘ সব নিয়ম মানার কোনো দায় তাদের আর নেই। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কোনো ইতরবিশেষ থাকে বলে মনে হয় না।

১৯৭১ সাল থেকে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমলে সরকারি ব্যয় বছর বছর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। এই ব্যয় বৃদ্ধি সামাল দিতে ছাপানো হয়েছে যাচ্ছেতাই পরিমাণ ডলার এবং একই সঙ্গে কমেছে ডলারের দাম।

মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে যত মতপার্থক্যই থাক, দুটি ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতের পাক্কা মিল রয়েছে: ১. ডলারের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে এবং ২. ডলারের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস হলে সমস্যা নেই। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছাপিয়েছিল।

যেহেতু স্বর্ণ রিজার্ভ রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছামতো ডলার ছাপাতে পারে এই আশায় যে ডলার যেহেতু বাকি পৃথিবীর রিজার্ভ মানি, সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি (P x Q = P x V) কোনো না কোনোভাবে ডলারের মূল্যহ্রাস তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতিকে সামাল দেবে, ঈশ্বরের ইচ্ছায়, কারণ ডলারের ওপরে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে: ‘ইন গড উই ট্রাস্ট!’

প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতিকে সামাল দিচ্ছে কোনো ঈশ্বর নয়, তৃতীয় ও অনুন্নত বিশ্বের কোটি কোটি জনগণ। এর কারণ, তারাই সবচেয়ে গরিব। যারা যত বেশি গরিব, তারা পিরামিডের তত বেশি নিচে এবং স্বাভাবিকভাবে তাদেরওপরেই সব চাপ গিয়ে পড়ছে। তৃতীয় বিশ্ব দিনকে দিন গরিব হচ্ছে, কারণ তারা নিজেদের শ্রম চুরি হতে দিয়ে ডলারের মূল্য সমুন্নত রেখেছে।

এটা ঠিক যে উন্নত দেশগুলো তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম মুদ্রা বাজারে ছাড়ে। উন্নত দেশের মুদ্রার বাৎসরিক স্টক টু ফ্লো গড়ে ৫%, সর্বোচ্চ ১০% ভাগ। কোনো কোনো অনুন্নত/উন্নয়নশীল দেশের বাৎসরিক গড় স্টক টু ফ্লো অনেক ক্ষেত্রে দশকের ঘর পার হয়ে শতকের ঘরেও চলে যায়, যদিও তাদের অর্থনীতি উন্নত দেশের তুলনায় নিঃসন্দেহে সংকুচিত। অনুন্নত দেশের মুদ্রার দাম উন্নত দেশের তুলনায় কম হবার এটা একটা বড় কারণ।

মুদ্রাস্ফীতি অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের দুরারোগ্য রোগ বটে, কিন্তু আগে পরে এই রোগ থেকে উন্নত দেশও পুরোপুরি মুক্ত নয়। মুদ্রার পরিমাণ বছরে ৫% বৃদ্ধি হওয়া খুব বেশি মনে না হতে পারে, কিন্তু মুদ্রার পরিমাণ যদি এই হারেও বাড়তে থাকে, মাত্র কুড়ি বছরে কোনো দেশের মুদ্রার পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার কথা, যার মানে হচ্ছে, একই সময়ে ওই দেশের টাকার দামও অর্ধেক হয়ে যাবে। ঠিক এভাবেই স্বর্ণের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রৌপ্যমুদ্রা একদিন তার মুদ্রাত্ব হারিয়েছিল এবং এই মূল্যহীন রোপৗমুদ্রাকে দীর্ঘকাল মুদ্রা হিসেবে বহাল রেখে চীন ও হিন্দুস্থানকে জ্ঞাতসারে শোষণ করেছিল ব্রিটিশরাজ।

স্বর্ণমুদ্রামানের যুগে মুদ্রাস্ফীতির সমস্যার কথা কখনও শোনা যায়নি। চীনেও মুদ্রাস্ফীতি হয়েছিল, কাগজের মুদ্রার কারণে। আমাদের যুগে মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা গুরুতর শুরু হয়েছে ঠিক তখন থেকে যখন থেকে ফিয়াট মানির যুগ শুরু হয়েছে। পাথর, পুঁতি, লবণ, ঝিনুক ইত্যাদি যখন মুদ্রা ছিল, তখনও মানুষ শোষিত হতো, কিন্তু ওই শোষণ অনুভূত হতে কিছুটা হলেও সময়ের প্রয়োজন হতো। রাই পাথর বা ঝিনুক তার মূল্য হারাতে কয়েক বছর বা কয়েক দশক সময় লেগেছিল, কারণ রাই পাথর বা ঝিনুক সংগ্রহ করা কমবেশি কষ্টকর ছিল। কাগজের ফিয়াট মানি ছাপানো এবং নকল করা এতই সহজ যে রাতারাতি এই মুদ্রা মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে।

করোনাভাইরাস বা প্লেগের চেয়ে ভয়ঙ্করতর মহামারী এই মুদ্রাস্ফীতি, যার কারণে একটি জনপদের শত শত, এমনকি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা সম্পদ ও সঞ্চয় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এই রোগের প্রাথমিক স্তরে মানুষ তার বিলাসদ্রব্যগুলো হারিয়ে ফেলে, তারপর এক সময় জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য বস্তুগুলো সংগ্রহ করাও তাদের পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠতে থাকে। সম্পদ স্থানান্তরিত/ধ্বংস হওয়ার পর সংস্কৃতি ধ্বংস হতে দেরি হয় না। সম্পদ ও সংস্কৃতি-ধ্বংস সমান্তরালও হতে পারে। অভাব যখন দরজা দিয়ে ঢোকে, সংস্কৃতি তখন জানালা দিয়ে পালাতে পারে।

এমত পরিস্থিতিতে, নিজের মনে পুষে রাখা রাগ ঝাড়ার জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা একটি বলির পাঁঠা খুঁজতে থাকে। ১৯২০-এর দশকে জার্মানির ভাইমার গণপ্রজাতন্ত্রে ইহুদিরা, বাংলাদেশে নির্যাতিত হিন্দুরা কিংবা ভারতে মুসলমানেরা এই ধরনের বলির পাঁঠা বৈ নয়। ফ্রান্সে যখনই মুদ্রাস্ফীতি সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন মুসলমান/ আরব/অভিবাসী-বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে হিন্দু কিংবা ভারত-বিদ্বেষ এবং ভারতে মুসলিম বিদ্বেষের সঙ্গে এই দুই দেশের মুদ্রাস্ফীতির সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়। মুদ্রাস্ফীতি যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, সমাজও তখন বর্বরতার চরমে পৌঁছে যায়।

‘আমার এ চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়!’ সুবীর নন্দীর গাওয়া গান। বাংলাদেশে বাৎসরিক মুদ্রাস্ফীতির হার যদি হয় সরকারি হিসেব ৬%, তবে বাস্তবে সেটা ১০%-এর কাছাকাছি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে, বছরের প্রথমে সঞ্চয়পত্রে জমা রাখা ১ লক্ষ টাকা বছরের শেষে হয়ে যাবে ৯০,০০০ টাকা। দ্বিতীয় বছরের শেষে ৮১,০০০, তৃতীয় বছরের শেষে ৭১,০০০০, চতুর্থ বছরের শেষে ৬১,০০০ এবং পঞ্চম বছরের শেষে ৫১,০০০ টাকায় দাঁড়াবে। না, না, ভয় পাবেন না, কাগজে কলমে ৫ম বছরের শেষে মূল ১,০০,০০০ + ৫০,০০০ (সুদ) = ১,৫০,০০০ টাকার মতো আপনার পাওনা হবে আয়কর কাটার আগে। কিন্তু টাকার ক্রয়ক্ষমতার বিচারে আপনি প্রকৃতপক্ষে পাবেন ৫১,০০০ (আসল) + (ধরা যাক) ২৯,০০০ (সুদ/লাভ) = ৮০,০০০ টাকা বা তারও কম। 

শুভমিতার গাওয়া একটা গান আছে: ‘যে ভাবেই তুমি সকাল দেখো, সূর্য কিন্তু একটাই।’ যে নামেই ডাকো, ‘লাভ’ কিংবা ‘সুদ’ এর কোনোটাই আপনি আসলে পাচ্ছেন না। সুদ খাওয়া পাপ মনে করে সঞ্চয়পত্র না কিনে টাকা ব্যাংকে ফেলে রাখছেন যারা, ধরা যাক ৫ বছর ধরে এক লাখ টাকা ব্যাংকে ফেলে রাখলেন, পঞ্চম বছরের শেষে দেখবেন ওই এক লাখ টাকা ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে ৫১ হাজারের সমান হয়ে গেছে। ইসলামী বা বাণিজ্যিক যেকোনো ব্যাংক ব্যবস্থাতেই জমা রাখেন না কেন, আপনি টাকা হারাচ্ছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকে সুদ নিলেও আপনার কোনো গুনাহ হবার কথা নয়, কারণ সুদ খাবেন কী, আসলই তো আপনার মুখ থেকে ফসকে যাচ্ছে।

আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। সদরঘাটে এক মুচিকে দিয়ে আমার জুতা রঙ করাচ্ছি এক বিকেলে। মোবাইল ফোন তখন সবেমাত্র চালু হয়েছে এবং আমার সামনে দিয়ে এক রিকশাওয়ালা এক হাতে রিকশার হ্যান্ডেল এবং আরেক হাতে মোবাইল কানে ধরে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলেন। মুচি রিকশাওয়ালার দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললেন, ‘গাঁজা-সিগারেটের ধোঁয়াটা তাও দেখা যায়, এই যন্ত্র দিয়া টাকাটা কখন, কীভাবে উইড়া যায় বোঝনই যায় না!’

মুদ্রাস্ফীতির স্বর্ণযুগে সাধারণ মানুষের আয় ও সঞ্চয়েরও অনেকটা একই দশা।