খেতাবপ্রাপ্ত বীর-০৫: নিজের স্বার্থের জন্য দেশের ক্ষতি করো না

যখন মিথ্যা কথা বলতে শুনি। দুর্নীতিবাজদের বড় বড় কথা বলতে দেখি। তখন ঠিক থাকতে পারি না। দেশের টাকা যারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে তাদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। এরাই দেশের শত্রু।

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 16 Feb 2024, 09:24 AM
Updated : 16 Feb 2024, 09:24 AM

রহমতপুর নেমেই যেতে হবে কালিকাপুর গ্রামে। মুঠোফোনে এমনটাই জানিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলিমুল ইসলাম। রহমতপুর মোড় থেকেই একটি অটোরিকশায় সে পথেই এগোই। ক্রমেই চারপাশের পরিবেশ বদলে যেতে থাকে। প্রকৃতির আলিঙ্গনে আমরাও এগোতে থাকি।

সকাল তখন ১১টা। ময়মনসিংহ শহরের অদূরে পাখিডাকা এমন নিরিবিলি গ্রাম পাবো চিন্তাতেই আসেনি। অটোরিকশাটি নামিয়ে দেয় কালিকাপুর মদিনাতুল উলুম বেগ মাদ্রাসার সামনে। মাদ্রাসাটি বেশ পুরনো, আলিমুল ইসলামের পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই তৈরি হয়েছিল।

মাদ্রাসার সামনের রাস্তায় অপেক্ষায় থাকি। খানিক পরেই ডানপাশের দেয়াল ঘেষা পথে এগিয়ে আসে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলিমুল ইসলাম। বয়স আশির মতো। কিন্তু এখনো বেশ সুঠামদেহী। পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই। গ্রামের ঘাসবিছানো মেঠো পথে হয়তো সেটার প্রয়োজনও পড়েনি। তার সঙ্গেই এগোই।

গ্রামটির ভেতর ছোট ছোট বাড়ির পাশে পুকুর। পুকুর পাড়ের চারপাশে নাম না জানা বড় বড় গাছ। মাঝেমধ্যেই উড়ে এসে পুকুরের জলে ডুব দিচ্ছে দু-একটা পানকৌড়ি। উড়ে যাওয়ার সময় তাদের ঠোঁটে ছটফট করছে ছোট্ট কয়েকটা মাছ। এসব দৃশ্যেই বিমোহিত হই।

গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই গরু আর ছাগল রয়েছে। আলিমুলের বাড়িতে রয়েছে ভেড়াও। বড় বড় গাছে ঘেরা তার বাড়িটি। উঠানে খেলা করছে শিশুরা। এমনই এক চমৎকার গ্রামে বসবাস করছেন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক আলিমুল ইসলাম। তার মুখে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনার কথা জানব বলেই ছুটে গিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে।

ইস্কান্দার আলী মাস্টার ও নজিরননেছার চতুর্থ সন্তান আলিমুল। বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কালিকাপুর প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর ভর্তি হন খাঘডহর হাই স্কুলে।

আলিমুল তখন ক্লাস এইটে পড়েন। একদিন লোকমুখে জানতে পারেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়ার খবরটি। রিক্রুটিং চলছিল ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে।

তার ভাষায়, “দেখলাম সবাই বড় লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। আমিও দাঁড়ালাম। অফিসারদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ই তারা পছন্দ করে একেকজনকে টান দিয়ে আলাদা জায়গায় রাখছে। আমাকেও ওখানে দাঁড় করায়। এরপর ওখান থেকে আবার বাছাই করে। পরে মেডিকেলও হয়। সবগুলোতেই টিকে যাই। বাড়িতে ফিরলে খবরটা শুনে বাবাসহ সবাই খুব খুশি হন।

এরপর ছয় মাস ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে, ইবিআরসি সেন্টারে। বাড়িতে তো খুব একটা কষ্ট করতাম না। আরামেই ছিলাম। ফলে প্রথম দিকে ট্রেনিংটা খুব কষ্টের ছিল। পরে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিই।

সিপাহী হিসেবে ১৯৬৬ সালে জয়েন করি। আর্মি নম্বর ছিল ৩৯৩৬৫০৮। ট্রেনিং শেষে পোস্টিং হয় সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন ওই ইউনিটটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পরে চলে আসে চট্টগ্রামে। একাত্তরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিল জয়দেবপুরে, রাজবাড়িতে।”

১৯৭১ সালে কাজী মুহাম্মদ সফিউল্লাহ (কে এম সফিউল্লাহ) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। ২৮ মার্চ সকালে তিনি জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে আলিমুলসহ বাঙালি সেনা সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বেরিয়ে যান।

এ প্রসঙ্গে বীরপ্রতীক আলিমুল বলেন, “জয়দেবপুর থেকে বের হওয়ার পর আমাদের সকল গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। আমাদের দেখে পথে পথে জনতাও উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে। মনের ভেতর তখন অন্যরকম আনন্দের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে আমরা টাঙ্গাইলে অবস্থান করি। ওখানে জনতার উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে সবাই অনুপ্রাণিত হই। পরে চলে আসি ময়মনসিংহে, স্টেডিয়ামে।

২৯ মার্চ বিকেলে ময়মনসিংহে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সমস্ত অফিসার, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদের নিয়ে এক বৈঠক হয়। ওই বৈঠক থেকেই ওখানে যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়। ওইসময় ময়মনসিংহ টাউন, শম্ভুগঞ্জ ব্রিজসহ নদীর ওইপাড়ে ছোটখাট কয়েকটি অপারেশন করেছি। পরে আমরা চলে যাই সিলেট শ্রীমঙ্গলে, ক্যাম্প করি একটা চা ফ্যাক্টরিতে। ওখান থেকেই যেখানে নির্দেশ দিত সেখানে অপারেশন করেই আবার ক্যাম্পে ফিরে আসতাম।”

আলিমুল ইসলাম প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে এবং পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। সিলেটের একাংশ, আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপুর, আজবপুর, সরাইল, শাহবাজপুর, মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেন তিনি।

একবার সীমান্ত এলাকা থেকে দিনের বেলায় মাধবপুর অভিমুখে রওনা হন আলিমুল ইসলামসহ ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের লক্ষ্য, সড়কে চলাচলরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়ি অ্যামবুশ করা। ২৩ মে বেলা আনুমানিক দুইটায় তারা ওই সড়কের এক জায়গায় দুটি অ্যান্টিট্যাংক মাইন পুতে পাকিস্তানি সেনাবাহী গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকেন।

এর পর কী ঘটেছিল? শুনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলিমুলের মুখে।

তিনি বললেন যেভাবে, “সময় গড়িয়ে যায়। কিন্তু ওইদিন পাকিস্তানিদের কোনো গাড়ি আসে না। আমরা এতে ধৈর্য হারাই না। রাতেও অ্যামবুশস্থলেই অবস্থান করি। পরদিন বেলা তখন আড়াইটা। পাকিস্তানিদের গাড়ি তখনও আসেনি। আমাদের অধিকাংশ তখন দুপুরের খাবারে ব্যস্ত। বাকিরা ছিলেন সতর্ক অবস্থায়। ঠিক তখনই পাকিস্তানি সেনাদের বিরাট এক কনভয় অ্যামবুশস্থলের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। এত বড় কনভয় আসবে আমরা ভাবতে পারিনি।

খাবার ফেলে সবাই দ্রুত নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে আসে। আমি ছিলাম একেবারেই সামনে। ফলে মাইন বিস্ফোরণের পরপরই প্রথম গুলি চালাতে হবে।

জিপ, লরি ও পিকআপ মিলে পাকিস্তানি ওই কনভয়ে ছিল মোট ২২টি গাড়ি। সংখ্যাটা এত বড় হবে কমান্ডার ও পেছনে থাকা সহযোদ্ধারা অনুমানও করতে পারেননি। আমরা কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম। কারণ, সংখ্যায় আমরা মাত্র ২২ জন আর পাকিস্তানি সেনাদের সংখ্যা আমাদের চেয়ে প্রায় সাত-আটগুণ বেশি। ওরা পাল্টা আক্রমণ করলে সবাই মারা পড়ব।

কিন্তু তবুও আমরা বিচলিত হননি। মরতে হলে লড়াই করেই মরব। এর মধ্যে পাকিস্তানিদের একদম সামনের জিপটি সেতুর বিকল্প রাস্তা দিয়ে চলে যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গাড়িটিও তার পেছন পেছন এগোয়। চতুর্থটি ছিল আর্মিদের পিকআপ ভ্যান। ওটা যাওয়ার সময়ই আমাদের পেতে রাখা মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে পিকআপটি উড়ে কয়েক গজ দূরে গিয়ে পড়ে। এর পেছনের গাড়িরও একই অবস্থা হয়। ফলে পাকিস্তানি কনভয়ের বাকি গাড়িগুলোও থেমে যায়।

আমাদের অস্ত্রগুলো তখন গর্জে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোলাগুলিতে হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। বাকিরা ছোটাছুটি করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা এর কিছুক্ষণ পরই পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন টিকতে পারি না। দ্রুত সরে পড়তে থাকি। ওরা গুলি করতে করতে আমাদের ধাওয়াও করে। কিন্তু কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। মাধবপুরে ওটা ছিল আমাদের একটা সফল অপারেশন। এখনও মনে হলে অন্যরকম আনন্দ লাগে।”

শেষের দিকে আলিমুলরা চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের পশ্চিম-উত্তরে, ক্যাম্প করেন একটা স্কুলে। স্টেশনের পশ্চিম পাশে ছিল খাল, খালের ওপর একটা ব্রিজ। একদিন ওই ব্রিজের নিচে সফিউল্লাহ, হেলাল মোর্শেদসহ তারা ছিলেন চার-পাঁচজন। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ছিল খালের পূর্বপাড়ে। সকাল তখন ৮টা-৯টা হবে। আলিমুলের অস্ত্র ছিল এসএমজি, পজিশনে ছিল ব্রিজের পিলারের আড়ালে। তুমুল গোলাগুলি চলে তখন। পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি এসে লাগে তার পায়ে।

তার ভাষায়, “গুলিটা পায়ে লেগে বেরিয়ে পেছনের একটা পিলারে লেগে স্প্লিন্টারের টুকরা এসে লাগে আমার শরীরে। একটু অবাক হলাম। পেছন থেকে কে গুলি করবে? পরে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি পিটিসুর ভেতর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ডান পায়ের গোড়ালির পেছনটা ভেদ করে একটা গুলি বেরিয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে, গৌহাটি হাসপাতালে। তখন ওই হাসাপাতাল যুদ্ধে আহত রোগীতে ভর্তি। হাসাপাতালের বারান্দাতেও কাতরাতে দেখেছি রক্তাক্ত শত শত ভারতীয় সেনাকে। একাত্তরে ভারতীয় আর্মিও রক্ত দিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার জন্য।”

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যুক্ত থাকেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলিমুল ইসলাম। ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন হাবিলদার (সার্জেন্ট) হিসেবে অবসরে যান তিনি।

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি প্রকাশ করেন এই বীরপ্রতীক। অকপটে বলেন, “একটা স্বাধীন দেশ ও পতাকা পেয়েছি। এটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। এখন দেশ অনেক উন্নত হচ্ছে। আমার দেশের ছেলেমেয়েরা নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে সারা পৃথিবীতেই বাংলাদেশকে তুলে ধরছে এটা জানলেই আনন্দ লাগে। তৃপ্ত হই তখন।”

খারাপ লাগে কখন?

তিনি বলেন, “যখন মিথ্যা কথা বলতে শুনি। দুর্নীতিবাজদের বড় বড় কথা বলতে দেখি। তখন ঠিক থাকতে পারি না। দেশের টাকা যারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে তাদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। এরাই দেশের শত্রু।”

শত বাধা ভেঙে পরবর্তী প্রজন্মই দেশকে আরও এগিয়ে নেবে— এমনটাই বিশ্বাস বীর মুক্তিযোদ্ধা আলিমুল ইসলাম বীরপ্রতীকের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো, ঠিক এভাবে, “আমরা রক্ত দিয়ে এই দেশটাকে স্বাধীন করেছি। স্বাধীন এই দেশটাকে তোমরা সঠিক পথে এগিয়ে নিও। নিজের স্বার্থের জন্য দেশের ক্ষতি করো না। তাহলে এই পৃথিবীতে তুমিও ক্ষতির মুখে পড়বে। দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করো। আগামী প্রজন্মের জন্যই দেশটাকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া সবসময়ই তোমাদের সঙ্গে থাকবে।”

ছবি: সালেক খোকন