যে নেতার জন্ম না হলে...

যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, সেই নেতার জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, মুজিব আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়ে আমরা যেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখি।

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 16 March 2023, 06:01 PM
Updated : 16 March 2023, 06:01 PM

১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম না নিলেও শেখ মুজিব কীভাবে একজন পরিপূর্ণ রাজনীতির মানুষ হয়ে ওঠেন তা আমাদের সবারই জানা দরকার। তাকে জানা-বোঝার জন্য তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বই তিনটি পড়া জরুরি।

বঙ্গবন্ধু যে একজন অসম সাহসী মানুষ ছিলেন তা এখন কারও অজানা নয়। এই সাহসের উৎস যদি আমরা খুঁজতে যাই– তাহলে দেখা যাবে মানবপ্রেম আর দেশপ্রেমই মূলত তাকে সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। মানবতার অবমাননা হচ্ছে, মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এরকম ঘটনা চোখে পড়লে ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব প্রতিবাদ করতেন।

শেখ মুজিব তার কৈশোরে স্কুলের ছাদ মেরামত করার জন্য বাংলার তৎকালীন দুই বরেণ্য রাজনীতিক শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথরোধ করে দাবি জানাতে দ্বিধা করেননি। ওই ঘটনায় তার সাহসের তারিফ করেছিলেন ওই দুই বড় নেতা। স্কুল ছাত্র থাকতেই সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়েছিলেন শেখ মুজিব। পরে সোহরাওয়ার্দী হয়ে উঠেছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু। আজকের দিনের শিশু-কিশোররা ভাবতেও পারবে না, কিশোর মুজিব কত সব মানবিক কাজ করেছিলেন। বস্ত্রহীন মানুষকে বস্ত্র দান করে, অন্নহীনকে অন্নের ব্যবস্থা করে, সহপাঠীর সমস্যাকে আন্তরিকভাবে সমাধান করে তিনি সবার নজর কেড়েছিলেন। মানুষের প্রতি দরদ বা ভালোবাসা ছিল তার মধ্যে সহজাত। কৈশোরে যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, তা ধরে রেখেছিলেন আমৃত্যু। দেশের প্রশ্নে তিনি কখনোই কারও সঙ্গে আপস করেননি। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ও কল্যাণচিন্তা তাকে সব সময় তাড়িত করত– দেশের জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশপ্রেমের চূড়ান্ত নজির রেখে গেছেন। ভীরু বাঙালিকে সাহসী করে তুলেছিলেন তিনি। শেখ মুজিবের কাছ থেকে সাহসের পাঠ আত্মস্থ করে বাঙালি মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছে।

শেখ মুজিবের চরিত্রে অনেক সদগুণের সমাবেশ ঘটেছিল বলেই তিনি কালজয়ী হতে পেরেছেন। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিকে খেয়াল করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। একটি মানুষ কী করে এতটা ক্ষমাশীল আর উদার হতে পারেন, তা যারা তাকে কাছ থেকে দেখেননি তাদেরকে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। পৃথিবীর কিছু কিছু নেতা লৌহ মানব বা কঠিন শাসক হিসেবে পরিচিতি পেলেও বঙ্গবন্ধুর বৈশিষ্ট্য একেবারেই ভিন্ন। তিনি রাজনৈতিক নেতা হয়েও ক্ষমা, দয়া, ঔদার্যের যে মহান কীর্তি রেখে গেছেন ইতিহাসে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে, বঙ্গবন্ধু নেতা হিসেবে যত বড় ছিলেন, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তত বড় ছিলেন না। এ কথার সঙ্গে আমি একমত নই। নেতা বঙ্গবন্ধু যতটা মহান ছিলেন, রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুও ছিলেন একইভাবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও পরিপক্ব।

১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণদান কালে বঙ্গবন্ধু বেশ কিছু মূল্যবান কথা বলেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে বলেছিলেন, “বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপস-মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তি কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহা ছাড়া আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সংঘর্ষ ও বিরোধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। আমরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সাথে শুধুমাত্র সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করি নাই, অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক করিয়া নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ বাদ দেই নাই এবং সবশেষে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। ঐ সকল যুদ্ধবন্দী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ও উপমহাদেশে ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান। এই কাজ করিতে গিয়া আমরা কোনো পূর্বশর্ত আরোপ অথবা কোনো দরকষাকষি করি নাই। আমরা কেবলমাত্র আমাদের জনগণের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের কল্পনায় প্রভাবিত হইয়াছি।”

পাকিস্তানিরা তার ওপর অন্যায় আচরণ করেছে, নির্বাচনে জেতার পরও ক্ষমতা দেয়নি, অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, তারপরও বঙ্গবন্ধুর প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়া খুব সাধারণ ঘটনা নয়।

বঙ্গবন্ধু কখনোই সংঘাত বা বিদ্বেষের রাজনীতিকে সমর্থন করেননি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে তার অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। নিজের ক্ষতি মেনে নিয়েও তিনি অন্যের সুখের জন্য চেষ্টা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব বাঙালি সেনাসদস্য পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি সবকিছু করেছেন। ভারত বার বার বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধবন্দিদের বিষয়ে দরকষাকষি করতে বলেছিল, কিন্তু ভারতের সেই কথায় বঙ্গবন্ধু খুব একটা কান দেননি। তিনি উতলা হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানে আটকা পড়া বাঙালি সন্তানদের জন্য। তিনি পাকিস্তানে আটক সেনাদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের চাকরিতে বহাল রাখলেন। যুদ্ধবন্দি সেনাসদস্যদের সাধারণত চাকরিতে বহাল রাখার তেমন কোনো নজির নেই– পাকিস্তানও সেটা করেনি। বঙ্গবন্ধু সেটা করলেন তার ঔদার্যের কারণে। অথচ কি আশ্চর্য! যাদের তিনি সন্তান ভেবে চাকরিতে বহাল রাখলেন, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করলেন– তারাই কিনা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। তারাই তাকে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে হত্যা করল নির্মমভাবে।

পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে ‘ট্রেইটর’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘This time Mujib will not go unpunished’. ইয়াহিয়ার এই কথায় এটা স্পষ্ট বোঝা যায়– বাংলার স্বাধীনতাকামী আপসহীন বঙ্গবন্ধুই ছিলেন পাকিস্তানিদের বড় শত্রু এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ব্যাপারে পাকিস্তানিরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। কিন্তু পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত যা করতে সাহস করেনি– তা-ই করল বাংলাদেশের পাকিস্তান ফেরত সেনাসদস্যরা। সাংবাদিক বরার্ট ফ্রস্ট একবার বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার সবচেয়ে ভালো গুণ কী? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাঙালিকে ভালোবাসি। এরপর প্রশ্ন ছিল, আপনার বড় দোষ বা দুর্বল দিক কী? বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল, আমি বাঙালিদের বড় বেশি ভালোবাসি।

বঙ্গবন্ধু যাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন, ঔদার্য দেখিয়েছিলেন, তারাই উন্মত্ত হয়ে বুলেট চালিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বুকে। পনেরো অগাস্টের ঘাতক এবং তাদের সহযোগী ও উপকারভোগীরা এখনো ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আওয়ামী লীগের নিশানা মুছে ফেলার জন্য। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাই বর্তমান সরকারের উচিত হবে বাংলার ঘরে ঘরে মুজিব আদর্শ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হওয়া এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা। বঙ্গবন্ধু একটি কথা বারবার বলতেন, “বুকের রক্ত দিয়ে হলেও বাঙালির ভালোবাসার ঋণ আমি শোধ করে যাবো ইনশাল্লাহ।” বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন, তিনি বুকের রক্ত দিয়েই বাঙালির ভালোবাসার ঋণ শোধ করে গেছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আত্মত্যাগের ঋণ শোধ করা।

১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত– আমি শোষিতের পক্ষে।” বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু শোষিত মানুষের পক্ষেই ছিলেন। এ কারণেই তিনি দেশের কৃষক-শ্রমিককে যুক্ত করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ই নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই সোনার বাংলা হয়ে উঠত। ঘাতকের দল তার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ না দিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।

আজকের সভ্য মানুষ সমঅধিকারে বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি চায় শান্তিপূর্ণ সুখী জীবন। একটি শান্তিপূর্ণ জীবন পেলে, সার্বিক নিরাপত্তা পেলে ব্যক্তিমানুষের আর কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না। জোর করে কোনোকিছু চাপিয়ে না দিয়ে মানুষের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করা দরকার। নিয়ম মেনেই বিশ্ব এগিয়ে যাবে, তবে নতুন বিশ্ব কোন পথে চলবে, নতুন দিনের সমাজতাত্ত্বিকদের সেই কথাটা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে যুক্তিকেই গুরুত্ব দিতে হবে। পৃথিবী অতীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, দেখেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপতৎপরতা। সমাজতন্ত্র তথা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রাণান্ত প্রচেষ্টাও মানুষ দেখেছে। এখন তাই ভবিষ্যতের পৃথিবী নিয়ে মানুষ কোনো কল্পকথা শুনতে চায় না। কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে পৃথিবীব্যাপী মানুষ আজ একটি মানবিক বিশ্বব্যবস্থা ও আইনের শাসন কামনা করছে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই গড়ে তোলা সম্ভব হবে আগামী দিনের সুখী, সমৃদ্ধিশালী, সুন্দর পৃথিবী।

যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, সেই নেতার জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, আমরা মুজিব আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়ে যেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখি।