বিজ্ঞানকে সিলেবাসের অংশ না ভেবে, তাকে পাশের নম্বর প্রাপ্তির বিষয় না করে, চাকরির বিষয় না ভেবে সংস্কারহীন আলোকিত জীবনের অংশে পরিণত করতে হবে।
Published : 25 Dec 2023, 04:36 PM
দীর্ঘদিন ধরেই আমরা একটি বিজ্ঞানমুখী বা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার কথা বলছি। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও প্রান্তিক মানুষের কাছেও তা চলে গেছে। মানুষ বিজ্ঞান পড়ছে-শিখছে বিজ্ঞানকে ভালবেসে নয় বিজ্ঞানের সুবিধার জন্য।
দেশের সবচেয়ে রক্ষণশীল শিক্ষার ধারা কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু বলছে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। জীবনযাপন করছে ধর্মান্ধের। বিজ্ঞানের বই পড়া, বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্কতা এক কথা নয়। বিজ্ঞান পড়ে-শিখে যদি বিজ্ঞানমনস্ক, উদার ও মুক্তমনা শিক্ষার্থী-জাতি তৈরি না হয় তাহলে সেই বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কতটুকু?
বাংলাদেশের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, মেডিকেলের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালগুলোতেও এখন ধর্মান্ধতার চর্চা বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল একবার কোনো এক আলোচনায়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চতর মাদ্রাসা’ বলে অভিহিত করায় তোপের মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন বাস্তবতাকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবহ, পরিবেশের কী কোনো উন্নতি হয়েছে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পরিস্থিতি ষাটের ও সত্তরের দশকেও যেমন ছিল তেমনও নেই!
কয়েকদিন আগে দেশের এক শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় আমন্ত্রিত এক ট্রান্সজেন্ডার বক্তাকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়নি, বক্তৃতা দিতে দেয়নি! সেজন্য ইউজিসি তাদেরে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছে। সহজেই অনুমেয়, কতটা ধর্মান্ধতার চর্চা হচ্ছে ওইসব প্রতিষ্ঠানে? বলতে পারেন তাহলে এই বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কী? যদি তারা উদার ও সংস্কারমুক্ত মানুষ না হতে পারে?
তার মানে এই নয় যে সরকারের নতুন কারিকুলামে, বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব ও পরিধি কমিয়ে দেয়াকে সমর্থন করছি। কিন্তু কিছু মানুষের কারিকুলারেম বিরোধিতা ও দোষারোপের ভাষা-বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে যেন বিজ্ঞান শিক্ষা কম হবার কারণেই দেশ রসাতলে যাচ্ছে, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? শিক্ষার্থীরা যতটুকু বিজ্ঞান এতদিন শিখেছে তার ফলাফল ও প্রভাবই বা কোথায়?
বিজ্ঞান শিক্ষার সমান্তরালে বিজ্ঞানমনস্কতার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কেন একটির সঙ্গে আরেকটির সংযোগ হতে পারছে না তা চিহ্নিত করা জরুরি। সরকারকে শতভাগ দায় দেয়া যেতে পারে; কিন্তু বদলে যাওয়া, বদলে দেয়া সমাজ, ধর্ম-সংস্কৃতির কোনো নাগরিক দায় নেই সেটা বলি কী করে? বিজ্ঞান শিক্ষার সংকট নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের যে বিলাপ দেখছি, তারাই কওমি মাদ্রাসার রক্ষণশীল শিক্ষা ও তাদের কারিকুলাম নিয়ে নীরব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শুধু বর্তমান সরকার নয়, কোনো শাসকই তাদের দায় এড়াতে পারে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কতটা মুক্ত ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পরিবেশ আছে? আগের তুলনায় কতটা নিম্নমুখী হয়েছে? তা নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে? হয়নি। অথচ শিক্ষার উন্নয়নে ও গুণমান এবং দুর্বলতা নির্ধারণে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। উন্নত দেশগুলোতে অনেক ছোটখাটো বিষয় নিয়েও গবেষণা হয়। রাতে ঘুমাতে গিয়ে কতজন মানুষ বিছানা থেকে পড়ে যায়, দেশে কি বা কোন নামের আধিক্য আছে, আনড্রিয়া না অলিভিয়া? সেটা নিয়েও গবেষণা হয়, ইত্যাদি। এগুলোও ওইসব দেশের গবেষণার বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার মান ও সামাজিক মূল্যবোধের গতিপ্রকৃতি কেমন সেটা নিয়ে আজ অবধি কোনো গবেষণা হয়েছে বলে শুনিনি।
এ যুগে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ধর্মান্ধ জঙ্গিরাও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কেরামতি বোঝে। তারাও এর শিক্ষাগ্রহণ করে। কিন্তু সেটা কি বিজ্ঞানকে ভালবেসে? মোটেই তা নয়। তারা বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে চায় আরও ধর্মান্ধতা ও অন্ধকারের জন্য। সেটা নিশ্চয় আধুনিক সমাজে কাম্য নয়। বিশ্বাস মানেই বিজ্ঞানহীনতা ও যাচাই-বাছাই অযোগ্য। একটি অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা আমাদের উদ্দেশ্য হতে পারে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রচলিত বিজ্ঞান শিক্ষার চেয়ে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলে বিজ্ঞানচর্চার জন্ম ও বিকাশ আপনিই ঘটবে।
“বিজ্ঞান কাকে বলে? দুই শব্দে বিজ্ঞান হচ্ছে ‘ভুলপ্রমাণযোগ্য সাধারণীকরণ’ বা ‘ফলসিফাইয়েবল জেনারালাইজেশন’। বিজ্ঞানে দুটি পর্যায় বা পর্ব আছে। প্রথম পর্যায়ে বিশেষ হাইপোথিসিস মাথায় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিন্যাস করতে হয়। এটা বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ট্যাক্সোনোমিক পর্যায়, কিন্তু এটা বিজ্ঞান নয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বিন্যস্ত তথ্যের ভিত্তিতে এমন একটি সাধারণ সূত্রের প্রস্তাব করতে হয়, যে সূত্রটি ভুল প্রমাণযোগ্য বা ফলসিফাইয়েবল। বিজ্ঞানের কোনো সূত্র সত্য নয়, ভুল প্রমাণযোগ্য আপাত সত্য। এই সূত্রকে ভুল প্রমাণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। ভুল প্রমাণিত হলে সূত্র সংশোধন করতে হবে কিংবা বাতিল করে নতুন সূত্রের প্রস্তাব করার চেষ্টা করতে হবে। ব্যস এটুকুই বিজ্ঞান।” (শিশির ভট্টাচার্য)
অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা বিজ্ঞান পড়েন ও পড়ান কিন্তু বিজ্ঞান কী তা বোঝন না। বিজ্ঞান মানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চিন্তা করার ক্ষমতা— সেটা তাঁদের মধ্যে নেই। আমাদের সমাজে কি এমন মানুষের প্রয়োজন আছে? আমরা চাই শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান শিখুক, কিন্তু মুখস্ত বিদ্যায় তোতা পাখি ওয়ে উঠুক তা চাই না।
বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্কতার বিরোধ থাকার কথা নয় কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট তার বিপরীত। এখানে বিজ্ঞানে লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষা নিয়েও কেউ বিজ্ঞান বিশ্বাস না করতে পারেন, বিজ্ঞানবিরোধী হতে পারেন এবং প্রচণ্ড সংস্কারাচ্ছন্ন হতে পারেন। আবার সাহিত্য কিংবা সমাজবিজ্ঞান পড়েও একজন মানুষ মুক্তমনা, সংস্কারমুক্ত ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির হতে পারেন।
ড. আহমদ শরীফ, ড. হুমায়ুন আজাদ কেউই বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, উদার ও মুক্তমনা মানুষ। উভয়েই বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে লেখালেখি করেছেন। এমনকি বিজ্ঞানমনস্কতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখি ও বক্তব্যের কারণে হুমায়ুন আজাদ মৌলবাদীদের হাতে জীবনই দিয়েছেন।
একজন শিক্ষার্থী নিউটন-আইনস্টাইন পড়েও অন্ধ ও যুক্তিহীন হতে পারেন। প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্রও বিবর্তনবাদের ধারা, তত্ত্ব অবিশ্বাস করতে পারেন। এগুলোকে ভ্রান্ত মনে করতে পারেন। প্রচলিত বিজ্ঞান শিক্ষার সংকট এখানেই।
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি মুখস্ত করাই কি বিজ্ঞান? কোনো শিক্ষার্থী অনেক ফিজিক্স, গণিত জানেন, বোঝেন তাতেই কি তার বিজ্ঞান শিক্ষা সার্থক ও সম্পন্ন হবে? সেটা হবে না। বিজ্ঞান হচ্ছে একটি দর্শন। যে দর্শনের মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করা, কার্যকারণ অনুসন্ধান করা। সেটা করার তৃষ্ণা ও মানসিকতা যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি না হয় তবে কারিকুলাম পরিবর্তন করে কি হবে? বিজ্ঞানের বই পড়ে, তত্ত্ব মুখস্ত করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জন করতে পারে কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারবে না। আর বিজ্ঞান পড়ে এই জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি বিজ্ঞানমনস্কই হতে না পারে তবে এর থেকে হতাশার আর কী আছে?
শিক্ষা যদি হয় নিছক পরীক্ষায় ভালো নম্বর ও চাকরি পাওয়ার বিষয় তাহলে সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা এর চেয়ে ভালো কীভাবে হবে? বিনা বাক্যে কোনো কিছু মেনে নেয়ার প্রবণতাকে আমাদের দেশে ভালো ছাত্র বা গুডবয় হিসেবে অভিহিত করা হয়। এখানে প্রশ্ন করাকে, সন্দেহ করাকে, অস্বীকার করাকে অবাধ্য ও বেয়াড়া মনে করা হয়। এটা কি শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ? তেমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা এমন করুণই হবে।
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আমরা জানি একজন সমাজ সংস্কারক এবং সাহিত্যিক হিসেবে। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না অথচ তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশুদের বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি শিশুদের শিখিয়েছেন, আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতির কার্যকরণ। অকপটে বলেছেন, কোনো রথের চাকায় ভর করে সূর্য যাতায়াত করে না, বলেছেন সূর্য পৃথিবীর নিচে কোথাও গিয়ে চোখ বুজে ঘুমায় না।
অন্ধকারকে দূর করতে পারে আলো তেমনি ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার দূর করতে পারে বিজ্ঞানমনস্কতা আর তার জন্য চাই বিজ্ঞানের যথার্থ শিক্ষা। বিজ্ঞানকে সিলেবাসের অংশ না ভেবে, তাকে পাশের নম্বর প্রাপ্তির বিষয় না করে, চাকরির বিষয় না ভেবে তাকে সংস্কারহীন আলোকিত জীবনের অংশে পরিণত করতে হবে।
বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসঙ্গে আমাদেরকে যে বিষয়গুলোকে ভাবতে হবে; ১) দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা কেন ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে? ২) নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান শিক্ষা কেন গুরুত্বহীন হচ্ছে? ৩) বিজ্ঞান শিক্ষা যতটুকু আছে বা হচ্ছে সে মাত্রায় বিজ্ঞানমনস্কতা কেন তৈরি হচ্ছে না? ৪) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, শিল্প ও সেবাখাতের উন্নয়ন ও পরিষেবায় যদি পুরোটাই বিদেশনির্ভর হতে হয় তাহলে দেশের বিজ্ঞান শিক্ষা কোথায়, কীভাবে ভূমিকা রাখছে? ৫) বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পড়ে সরকারি প্রশাসনের সুবিধানির্ভর ক্ষমতাকেন্দ্রিক চাকরিই যদি হয় উদ্দেশ্য হয় তাহলে বিজ্ঞান শিক্ষার দরকার কী?
সরকার ঘোষিত নতুন শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশে বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষার যে অবস্থা-বাস্তবতা সে বিষয়ে তাঁদের পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে নীতিতে যে কারিকুলাম দেয়া হয়েছে তাতে বিজ্ঞান শিক্ষাকে সংকুচিত করা হয়েছে। এই কারিকুলাম অপরিবর্তিত রেখে সেই আকাঙ্ক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে বাস্তব চর্চার এই বিরোধ ও অসঙ্গতি দূর করা জরুরি।