রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে ছোটগল্পের সঙ্গে তুলনা করা হয়— যাদের সাসপেন্সে ভরা গল্প শেষ হয়েও শেষ হয় না।
Published : 11 Mar 2024, 11:27 AM
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই, বস্তুত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের ভেতরে গৃহদাহ—বিশেষ করে দেবর-ভাবির টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি নির্বাচনের নানা সমীকরণের প্যাঁচে পড়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্ধেক আসন নিয়ে বর্তমান সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দলটি যে আরও একবার ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে, সেই অনুমান রাজনীতিসচেতন মহলে ছিল। তবে সেই ভাঙনটি যে এত দ্রুত কার্যকর হবে, সেটি হয়তো অনেকের ভাবনায় ছিল না।
সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ—যাকে তার বিরোধীরা ‘স্বৈরাচার’ বলতে পছন্দ করেন এবং নিজেদের প্রয়োজনে সেই স্বৈরাচারকে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন সময়, তার দলটি এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হলো। বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দল বোধহয় এতগুলো খণ্ড হয়নি।
লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে এরশাদের নেতৃত্বে যে মূল দলটি ছিল, সম্প্রতি সেটি ভাগ হয়ে গেছে দেবর-ভাবির মধ্যে। অর্থাৎ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ বেশ কিছুদিন ধরে দলে ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে থাকলেও গত ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে তাকে দলের নতুন চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এরশাদের জীবদ্দশাতেই দলটি ৪ ভাগে ভাগ হয়েছে। মূল দলের বাইরে এখনও সক্রিয় জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি–জেপি (প্রতীক বাইসাইকেল); নাজিউর রহমান মঞ্জুরের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (প্রতীক গরুর গাড়ি)— যার বর্তমান সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (প্রতীক কাঁঠাল) — যার বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. এম. এ. মুকিত
মাঝখানে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকও রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন এবং তিনিও আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠন করছেন বলে গুঞ্জন ছিল। বিশেষ করে ছেলে এরিককে নিয়ে তিনি নতুন একটি মেরুকরণের যে চেষ্টা করছিলেন তার প্রমাণ ২০২২ সালের পয়লা জানুয়ারি জাতীয় পার্টির ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক আলোচনায় বিদিশা বলেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে চমকের পর চমক আসবে।’ কয়েক মাস পরেই তার সন্তান এরিকের বয়স ২১ হবে উল্লেখ করে বিদিশা বলেন, ‘ভুলে গেলে চলবে না, এরশাদ সাহেব সেনা পরিবারের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। এরিক আজ একা না। এরিকের সঙ্গে সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার এবং এরশাদকে যারা ভালোবাসে, তারা আছে।’ (বিডিনিউজ, ০১ জানুয়ারি ২০২২)।
স্মরণ করা যেতে পারে, এরশাদের সঙ্গে বিয়ের পর বিদিশা জাতীয় পার্টিতে পদ পেলেও বিচ্ছেদের পরে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরশাদের মৃত্যুর পরে তিনি তার পুত্র এরিককে নিয়ে ফের জাতীয় পার্টিতে সক্রিয় হতে চেয়েছিলেন। যদিও সেই সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সম্ভবত সরে গেছেন। তিনি সক্রিয় থাকলে এবং সত্যি সত্যি আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠন করলে দলটি ছয় খণ্ড হতো!
এরশাদ জীবিত থাকাকালেই জাতীয় পার্টির ভেতরে নানারকম সংকট দানা বাঁধছিল, যা তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরও তীব্র হয়। সবশেষ গোল বাঁধে একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ইস্যুতে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে এরশাদের মৃত্যুর পর ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ছোট ভাই জি এম কাদের উভয়ই নিজেকে দলটির চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দেন। এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন জি এম কাদের। উপরন্তু এই সময়ে তারা দুজনই সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হতে চেয়ে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন। তখন রওশন ও কাদেরের মধ্যে একটা সমঝোতা হয় যে, রওশন হবেন বিরোধী দলীয় নেতা আর জি এম কাদের হবেন বিরোধী দলীয় উপনেতা ও দলের চেয়ারম্যান। ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কাউন্সিলে ৩ বছরের জন্য দলের চেয়ারম্যান হন জি এম কাদের।
কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আবার দেবর-ভাবির টানাপড়েন তৈরি হয়। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচেনর প্রাক্কালে এমন ঘটনা ঘটতে থাকে যে, শেষমেষ নির্বাচন থেকে রওশন এবং তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত দলের একাধিক সিনিয়র নেতা দলের মনোনয়নও পাননি। কেউ কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও হেরে গেছেন।
সবশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে যেদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে দ্বাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং দলের সিনিয়র নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংসদ সচিবালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি করে, সেদিনই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদ থেকে জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন।
যদিও জাতীয় পার্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দলের গঠনতন্ত্রে ২৯৯ সদস্যের যে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কথা বলা আছে, সেখানে চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য, মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, বিভাগীয় সম্পাদকসহ অন্যান্য পদের উল্লেখ থাকলেও ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ বলে কোনো পদ নেই। তার মানে রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো বৈধ পদেই নেই। অথচ তিনি দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে বহিষ্কার করে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন! তাকেই আবার কাউন্সিল ডেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হলো!
প্রসঙ্গত, গত ৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিশনে রওশন এরশাদপন্থিরা কাউন্সিল করে নতুন কমিটি ঘোষণা দেন। এতে তিন বছরের জন্য রওশন এরশাদ চেয়ারম্যান এবং কাজী মামুনুর রশীদ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ৩৭ ধারায় বলা আছে— ‘কোনো কারণে দলের চেয়ারম্যানের অপসারণের প্রয়োজন দেখা দিলে প্রেসিডিয়াম জাতীয় কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করবে। উক্ত জাতীয় কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশনের একমাত্র বিষয়বস্তু হবে চেয়ারম্যানের অপসারণ সম্পর্কিত দাবি এবং চেয়ারম্যান অপসারণ সম্পর্কিত দাবিতে অপসারণের ব্যাখ্যা সংবলিত কারণ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকবে। জাতীয় কাউন্সিলের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ভোট যদি দাবির পক্ষে হয়, তাহলে চেয়ারম্যান অপসারিত হবেন।’ কিন্তু রওশন এরশাদ যে পদে (প্রধান পৃষ্ঠপোষক) ছিলেন, সেই পদে থেকে তিনি দলের কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন কি না এবং তার আহুত সম্মেলন দলের নতুন চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ঘোষণা করতে পারে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন।
যদি জাতীয় পার্টি এখন রওশনের নেতৃত্বে আরেকটি খণ্ড হয়ে যায় তাহলে দলের প্রতীক লাঙ্গল কার? এরইমধ্যে জি এম কাদেরকে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এবং তার দলের সিনিয়র নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বিরোধী দলীয় উপনেতা ঘোষণা করেছেন স্পিকার। অর্থাৎ আইনত জি এম কাদেরই জাতীয় পার্টির মূল অংশ তথা লাঙ্গল প্রতীকের হকদার। এখন রওশন যে দল গঠন করেছেন বা তিনি যে আলাদা হয়ে গেছেন, তাতে তিনি লাঙ্গল প্রতীক দাবি করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে তাকে নির্বাচন কমিশনে নতুন করে নিবন্ধনের আবেদন করতে হবে। যদি নিবন্ধন পান তাহলে তার নতুন জাতীয় পার্টিকে নতুন কোনো প্রতীক দেয়া হবে— যেরকম এর আগে আরও তিনটি জাতীয় পার্টিকে প্রতীক দেয়া হয়েছে।
যদিও কাউন্সিলে রওশন দাবি করেছেন, ‘স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই— এরশাদের জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। আমরা এক আছি, ঐক্যবদ্ধ আছি এবং থাকব। অতীতে যারা পার্টি ছেড়ে গেছে, তারা কেউ এরশাদের নীতি-আদর্শ নিয়ে যায়নি।’ প্রশ্ন হলো, জাতীয় পার্টিতে বিভেদ না থাকলে তিনি কেন তার দেবরের নেতৃত্বাধীন দলের বাইরে গিয়ে নতুন চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ঘোষণা করলেন? এটা কি বিভেদ নয়?
তবে মোদ্দা কথা হলো, ‘সব সম্ভবের দল’ জাতীয় পার্টিতে ভাঙন এবং নাটকের এখানেই হয়তো শেষ নয়। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা গেছে, জাতীয় পার্টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারস্থ হয়েছে। তাতে অনেক সময় মনে হয়েছে জাতীয় পার্টি হয়তো আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’। যদিও বিএনপিবিহীন এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রাধান্যনির্ভর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় ফলাফলকে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ‘কোরবানি’ বলে অভিহিত করেছেন। আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে ‘বেঈমানী’ করেছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। ফলে রওশনের নেতৃত্বে নতুন যে জাতীয় পার্টির আবির্ভাব ঘটল কিংবা দলের যে নতুন চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ঘোষিত হলো, সেটি এখানেই শেষ নাকি ক্ষমতাসীন দলের মধ্যস্থতায় দেবর-ভাবির মধ্যে পুনরায় সমঝোতা হবে— সেটি দেখার জন্য হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কেননা রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে ছোটগল্পের সঙ্গে তুলনা করা হয়—যাদের সাসপেন্সে ভরা গল্প শেষ হয়েও শেষ হয় না।