ঢাকা লিট ফেস্ট, গোথেনবার্গ গ্রন্থমেলা ও গণমানুষের লেখালেখি

গণমানুষ নিজেরা যখন নিজেদের গল্প বলবেন বা নিজেদের কথা লিখবেন, তার সাহিত্যমান যাই থাকুক- তা আদতে নিখাঁদ গণমানুষের লেখালেখি।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 7 Jan 2023, 03:21 PM
Updated : 7 Jan 2023, 03:21 PM

ঢাকায় শুরু হয়েছে লিট ফেস্টের দশম আয়োজন। এই আয়োজন ঘিরে পুরোনো বিতর্ক যেমন ফিরে এসেছে, পাশাপাশি যোগ হয়েছে কিছু নতুন প্রশ্ন। সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাজ্যের ওয়েলস প্রদেশের ‘হে’ গ্রামের নামানুসারে সাবেক উপনিবেশগুলোতে এই উৎসব চালান করে দেবার একটা প্রচেষ্টা ছিল নানা করপোরেটের তরফ থেকে। এরকম তৎপরতা আমাদের দেশেও শুরু হয়েছিল। শেষতক ঢাকার ‘হে উৎসব’ মেটামরফোসিস হয়ে আজকের ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ নাম ধারণ করেছে।

এই উদ্যোগ যে শুরু থেকেই এলিটদের মেলা তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন নেই। কেননা খোদ আয়োজকরাও কখনো দাবি করেননি যে, এটা এলিটদের মেলা নয় বা এটি দেশের বাংলা ভাষাভাষীসহ অন্য বহুবিধ আদিবাসী গণমানুষের একটি উৎসব। কিন্তু এবার প্রশ্ন উঠেছে দর্শক-শ্রোতাদের টিকেট কেটে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা নিয়ে।

এখানে একটি বিষয় খোলাসা করতে চাই। ঢাকা লিট ফেস্টের মতো একটি আয়োজনের বিরোধিতা করার কোনো কারণ নেই। কেননা এলিটদেরও লেখালেখি করার, উৎসব করার অধিকার আছে, যেমন আছে আমজনতার। এটিকে গণবিচ্ছিন্ন বলেও দোষ দেবার কিছু নেই। এলিটরা গণবিচ্ছিন্ন না থাকলে আর এলিট থাকেন কীভাবে? কিংবা তাহলে এলিট হয়েইবা লাভ কী?

এবার টিকেট চালু নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এখানে আমি প্রশ্ন তোলার কিছু দেখি না যদি আমার আপনার প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় রাজস্ব এখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়ে না থাকে। এই ক্ষেত্রে খোদ আয়োজকরা বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারতেন। তবে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, “শুরু থেকেই ঢাকা লিট ফেস্টে সম্পৃক্ত ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এবার তেমনভাবে সম্পৃক্ত হতে না পারলেও আগামীতে মন্ত্রণালয় এই উৎসবে পৃষ্ঠপোষকতা করবে।” তবে মান্যবর মন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মন্ত্রণালয় কীভাবে জনগণের করের টাকা কতটা খরচ করবেন, তার স্বচ্ছতা থাকা বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, একদিকে জনগণের করের টাকাও খরচ করবেন আবার টিকেট বিক্রির সুযোগও অবারিত রাখবেন– ঔপনিবেশিক এই দ্বৈত বন্দোবস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে সঙ্গত হতে পারে না। আয়োজকরা যদি সরকার থেকে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে না থাকেন তাহলে অবশ্যই তারা টিকেট বিক্রির অধিকার রাখবেন। এখানে প্রশ্ন তোলার কোনো কারণ নেই।

এই উৎসবের অনুষ্ঠানসূচি, আয়োজকবৃন্দ আর আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে প্ৰতীয়মান হয় এটি সাহিত্যের উৎসব হলেও শিল্প ও সংস্কৃতির বহুবিধ পরিধিকে তুলে ধরার একটা প্রচেষ্টা রয়েছে এতে। যদিও প্রাধান্যটা এলিটদেরই। এটাও আয়োজকদের ব্যাপার তারা কীভাবে তাদের উদ্যোগ ও ব্যবসাকে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাবেন। যেখানে করপোরেট স্পন্সর বা বিজ্ঞাপনের যোগসাজসের একটা অর্থপূর্ণ ভূমিকা থাকে।

লিট ফেস্ট নিয়ে কথা আর না বাড়াই। উৎসবটি সফল হোক। এবার গোথেনবার্গ গ্রন্থমেলা নিয়ে আলোকপাত করে লেখার সমাপ্তি টানতে চাই।

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয় গোথেনবার্গ গ্রন্থমেলা। কয়েক বছর করোনার ঝক্কির পর পুরোদমে সামগ্রিক কলেবর নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এটি দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রন্থমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলাটি পৃথিবীর বৃহত্তম। ফ্রাঙ্কফুর্টের সঙ্গে গোথেনবার্গ মেলার পার্থক্য হলো প্রথমটি মূলত প্রকাশককেন্দ্রিক আর গোথেনবার্গের আয়োজন হচ্ছে দেশটির গণমানুষের লেখালেখি, গণগ্রন্থাগার আর গণসংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে।

গোথেনবার্গ মেলা নিয়ে আরও কয়েকটি কথা বলে গণমানুষের লেখালেখি প্রসঙ্গে আলোকপাত করব। ১৯৮৫ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু হওয়া এই আয়োজন মূলত একটি বাণিজ্যিক মেলা ছিল শুরুতে। পরবর্তীতে এটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বৃহত্তম সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপ নিয়েছে ধাপে ধাপে। বর্তমানে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হলেও এটি আদতে বেসরকারি-সরকারি যৌথ পৃষ্ঠপোষকতার দৃষ্টান্তমূলক চমৎকার একটি আয়োজন। এই মেলায় বই, লেখক, পাঠক, গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকদের কেন্দ্রে বিবেচনা করা হলেও এর বহুমাত্রিক কর্মসূচিগুলোতে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, জলবায়ু-পরিবেশ, শিক্ষা, রাজনীতি থেকে শুরু করে জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত হেন কোনো বিষয় নেই যা যথাযথভাবে তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়া হয় না। চার দশকে পা দিতে যাওয়া এই মেলার বিবিধ প্রান্ত, মঞ্চ ও চত্বরগুলোর নাম ও কর্মযজ্ঞের কাঠামো দেখলেই বোঝা যাবে এই মেলা যেন প্রথিবীর এক বনসাই উপস্থাপনা।

বিশ্ব চত্বর, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চত্বর, সবুজ চত্বর, খাবার-দাবার চত্বর, তথ্যপ্রযুক্তি চত্বর, সাহিত্য মঞ্চ, সাহিত্যসমাজ চত্বর, অপরাধ কল্পকাহিনী চত্বর, বিভিন্ন প্রদেশের জন্যে মঞ্চ, কবিতার জন্যে পৃথক হল, অনুবাদের জন্যে স্বতন্ত্র মঞ্চ, গল্পের জন্যে একাধিক মঞ্চ, গ্রন্থাগার চত্বর, বিভিন্ন পরিসরের সেমিনার, সংলাপ আর সাক্ষাৎকারের জন্যে কতগুলো হল আর সেমিনার কক্ষ, বিভিন্ন অধিদপ্তর এবং বিদেশি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্যে আলাদা আলাদা মঞ্চ আর চত্বর, ছোট-বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নিজ নিজ মঞ্চ এবং অনুষ্ঠান আয়োজনের নিজস্ব উদ্যোগ, সংবাদপত্র এবং বেতার দূরদর্শনের নিজ নিজ মঞ্চ– সব মিলিয়ে নন্দন ভাবনার এ এক এলাহি কারবার।

বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কীভাবে সমন্বয় করে তা তুলে ধরবার জন্যে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সুইডিশ আর্টস কাউন্সিলের অর্থায়নে এবং পরিচালনায় প্রতিবছর সারা দুনিয়ার অনুবাদকদের গোথেনবার্গ গ্রন্থমেলা ফেলোশিপ দেওয়া হয়। এমনকি বাংলাদেশ থেকে অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক এবং জার্নিম্যান প্রকাশনীর তারিক সুজাত এই ফেলোশিপ লাভ করেছিলেন।

এই মেলার আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো প্রতিবছর কোনো একটি দেশ বা ভাষার সাহিত্যকেও মূল উপজীব্য করা হয় একইসঙ্গে একাধিক দেশের লেখালেখির নির্বাচিত কয়েকটি কণ্ঠস্বরকে মেলায় আমন্ত্রণ করে ওই দেশ ও ভাষার সাহিত্যকে সম্মানিত করা হয়। এ বছর এই বিরল সমানের অধিকারী হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে এই মেলায় সম্মানিত করা হয় ২০১৩ সালে।

পরে এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রয়াত শামসুজ্জামান খান উদ্যোগী হয়েছিলেন বাংলাদশকে এই মেলার মূল উপজীব্য দেশ হিসেবে তুলে ধরার জন্যে। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সব উদ্যোগ থেমে যায়। দুই-একজন ব্যাতিক্রম ছাড়া বাকি যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর আর সংগঠনের পদ দখল করে একধরনের স্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে বসে আছেন, তাদের নিয়ে আলোচনা করাও বাতুলতা। কেননা তারা জেগে ঘুমাচ্ছেন। ওনারা নিজেরাই কেবল নিজেদের তরে।

ওনারা লেখালেখির নাম ‘তেলেভাজা’ ধান্দাবাজি বচন হাজির করে নিজেদের পদ-পদবি, বিদেশ সফর, প্লট বাগিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত। এখানে নাম উল্লেখ করে কাউকে ছোট বা বড় করতে চাই না। অনেকটাই দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল কামনা করার মতো সময় অতিবাহিত হচ্ছে আমাদের লেখালেখির পরিমণ্ডলে।

করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কা সামলিয়ে এবার গোথেনবার্গ বইমেলা আগের রূপে ফিরেছে। এই মেলায় আমন্ত্রিত হয়ে গণমানুষের লেখালেখি বিষয়ে একটি সংলাপে কথা বলার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। এই সংলাপে ইউরোপের বাইরের কণ্ঠস্বর হিসেবে আমি এবং ইউরোপের কণ্ঠস্বর হিসেবে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সুইডেনের প্রতিথযশা কবি, অনুবাদক এবং সম্পাদক লার্স হ্যাগার। এই সংলাপের বিষয় বিবেচনার পেছনে একটি প্রকাশনাকে আলোর পাদপ্রদীপে নিয়ে আসাই ছিল আয়োজকদের উদ্দেশ্য।

ইউরোপের একটি বহুভাষাভিত্তিক সাহিত্য উদ্যোগ উপসালা সাহিত্যকেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে একটি প্রকাশনা বের হয়। সারা বছর ধরে এই কেন্দ্র আয়োজিত লেখালেখি ও পাঠ অগ্রগতি বিষয়ক নানা কর্মযজ্ঞ শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় মানুষের সঙ্গে পেশাজীবী এবং অপেশাদার লেখকদের লেখা নিয়ে দেশ-বিদেশের নানা ভাষার মানুষের রচনায় সমৃদ্ধ নিয়মিত এই প্রকাশনা। এরকম একটি গ্রন্থ গত বছরও প্রকাশিত হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছেন ইউরোপ এবং ইউরোপের বাইরের এশিয়া, আফ্রিকার কেনিয়া, তানজানিয়া, ক্যামেরুন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারসহ নানা দেশের ও ভাষার দুই শতাধিক লেখক। লেখকদের মধ্যে রয়েছেন বাসচালক, ডাকপিয়ন, রেস্তোরাঁর কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কূটনীতিক, রাজনীতিকসহ নানা পেশা ও পেশাবঞ্চিত মানুষ। আন্তর্জাতিক এই উদ্যোগের সঙ্গে কর্মসূত্রে আমার যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছিল। প্রকাশনার সুইডিশ শিরোনাম: Från ett avlägsets land, 2022 (‘দূর দেশ থেকে’)।

এই সংলাপে লার্স হ্যাগার মোটা দাগে আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে এই লেখায় আলোচনা করতে চাই। তার আগে গণমানুষের লেখালেখি নিয়ে কয়েকটি কথা বলে নেয়া ভালো। গণমানুষের লেখালেখি আসলে কী? যে লেখালেখি বা যার বা যাদের লেখালেখি গণমানুষের সম্মিলিত বা জনগোষ্ঠীর একক কোনো ব্যক্তিমানুষের আনন্দ বেদনার কথা ও গল্প নিখাদ কারও কলমে কোনোরকম স্বার্থ সিদ্ধির ধান্দা ব্যতিরেকে বেরিয়ে আসবে।

এখানে বলে নিতে চাই গণমানুষের লেখালেখি ‘জাতীয় সাহিত্য’ হলেও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কেননা জাতীয় সাহিত্যের মধ্যে একধরনের অবশ্যম্ভাবী রাজনীতি থাকে, তা যে সবসময় ঠিক পথে বা ঠিক মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখানে যেমন সামরিক একনায়ক থেকে ফ্যাসিস্ট গণশত্রুরাও যখন ক্ষমতায় থাকবেন তখন তাদের রাজনৈতিক ধারার কিছু লেখকেকে ঠিকাদারি দেবেন, তাদের মর্জিমতো জাতীয় সাহিত্য রচনা করাতে। এরকম বাস্তবতায় পাকিস্তান আমলে আমাদের রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এই বঙ্গেও।

একইভাবে ইরানের সাহিত্য হবে সেদেশের সেন্সর নীতি মেনে মোল্লাদের মর্জিমাফিক, ভারতও যদি একদিন নরেন্দ্র মোদীর ভাবধারা পূজা করে কতিপয় লেখক বা বুদ্ধিজীবী যদি লেখালেখি করেন তাতে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আমাদের নির্বাসিত এক বোন তো সেই সুর কখনো কখনো ধরে থাকেন। ভিন দেশের ক্ষমতার জাতীয় সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী কন্ঠস্বর হিসেবে বাহবা নেবার অধিকার এবং স্বাধীনতা দুটোই তার আছে। কিন্তু গণমানুষের লেখালেখি তার থেকে কিঞ্চিৎ দূরে হলেও দূরবর্তীই বটে।

গণমানুষের লেখালেখির ধারণা বলতে গণমানুষের গল্প ও কথা যে লেখায় উঠে আসবে তা যেমন, ঠিক অন্যভাবে গণমানুষের নিজেদের গল্প নিজেরা যখন বলবেন সেটাও গণমানুষের লেখালেখি। তবে মূলধারার সাহিত্য বিবেচনা বলতে নির্ভর করবে খোদ দেশ ভাষা সাহিত্য ও জনগোষ্ঠীর ধারাটা কেমন তার ওপর। যেমন গণচীনে কমিউনিস্ট পার্টির ধারা, ভারতে বিজেপি ধারা, রাশিয়ায় পুতিন ধারা, আমেরিকায় বাজার ও পুঁজির ধারা, মধ্যপ্রাচ্যে বাদশা ও মোল্লা ধারা। এসব ধারানির্ভর লেখালেখি কি আদতে গণমানুষের লেখালেখি হিসেবে বিবেচিত হবে?

এর বিপরীতে লালনের সাহিত্যকর্ম, রবীন্দ্রনাথের রচনা, হাসন রাজার লেখালেখি, নজরুল, জসীম উদ্দীন, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, আহমদ ছফার লেখা গণমানুষের লেখালেখি হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে।

যেমন মাও সেতুঙের লেখা, শ্রমিকদের উদ্দেশে পাবলো নেরুদার লেখা, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক লেখা, মহাত্মা গান্ধীর লেখালেখি গণমানুষের কথাই বলে দার্শনিক এবং প্রায়োগিক বিবেচনায়। তবে লেখালেখি বা গল্প বলার গূঢ় রহস্য হচ্ছে এতে অসততার জায়গা নেই। গল্পে বা লেখালেখিতে অসততা থাকলে আখেরে তা পাঠকের চোখে বা গণমানুষের চোখে ধরা পড়বেই।

এখানে বলে নিই, গণমানুষ নিজেরা যখন নিজেদের গল্প বলবেন বা নিজেদের কথা লিখবেন তার সাহিত্যমান যাই থাকুক তা আদতে নিখাঁদ গণমানুষের লেখালেখি। এই গণসাহিত্য বা গণসাহিত্যের মানুষেরা কাগজ কলম নিয়ে লিখতে না পারলেও বা লিখতে না বসলেও শত শত বছর ধরে চলে আসা নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে যে গল্প বলার রীতি বা রেওয়াজ তা সব ভাষার মানুষের মাঝেই বিরাজমান। আধুনিক এই সময়ে অন্যের গল্প আয়োজন করে বা সময় করে বসে শোনার পর্যায় আর আগের মতো নেই। তাই বলে কি সেই গল্প বলার সুযোগ শেষ হয়ে যাবে? অবশ্যই না।

কার্যকর গণতন্ত্রের দেশগুলোতে যে কারণে পঠন অগ্রগতির জন্যে নানা উদ্যোগ ও আয়োজন থাকে। এরকম একটি আয়োজনের দৃষ্টান্ত হলো উপসালা সাহিত্যকেন্দ্রের এবারের প্রকাশনা ‘দূর দেশ থেকে’। এই গ্রন্থ গণমানুষের লেখালেখির একটি নমুনা।

এর সূত্র ধরেই লার্স হ্যাগার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন উপসাহিত্য কেন্দ্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী? সংক্ষেপে বলতে গেলে গণমানুষের নিজ নিজ গল্পগুলো বলার অধিকার ও স্বাধীনতাকে অবারিত করা। এই স্বাধীনতা ও অধিকার অবারিত আছে কিন্তু প্রকাশের কোনো জায়গা বা সুযোগ নেই, তাহলে? সাহিত্যকেন্দ্রের এই প্রকাশনা সেই অধিকার ও স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপদানের একটা ক্ষেত্র। যেখানে সমাজ ও জনপদের সকল স্তরের সকল ভেদাভেদ ভুলে নিজ নিজ গল্প বলার সুযোগ পেয়ে থাকেন গদ্যে বা পদ্যে।

সবাই কি লেখক হতে পারে বা লিখতে পারে? সবার গল্প থাকে। আপনার নিজের গল্প আপনাকেই বলতে হবে। আপনার গল্প আপনি মরে যাবার আগে আপনাকেই বলে যেতে হবে। আপনার গল্প অবলা রেখে চলে গেলে অন্য কেউ তো আপনার গল্প বলতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথ তার গল্প বলে গেছেন। এবার আপনার পালা আপনার গল্প বলার। আর এর জন্যে উদ্যোগ ও আয়োজন তো থাকা চাই। সবার জীবনের গল্প আছে, সবার গল্প আছে, তাই সবাই গল্প বলবেন গল্প লিখবেন। সকলেই লেখক হবেন কি হবেন না, তার চেয়ে বড় কথা লিখবেন সকলেই।

বাংলাদেশ এবং সুইডেনের লেখালেখির কাঠামোর মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম বাংলাদেশে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি আর সুইডেনের রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বাধা। তাহলে কোনটা ভালো। দুটোই সমানভাবে ভালো এবং সমানভাবে সঙ্কটময়। উত্তরণের উপায় হলো দুটোর মধ্যে ভারসাম্য থাকা।

কবি জসিম উদ্‌দীন তার কিছু বক্তৃতা এবং প্রবন্ধে বিশেষ করে ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্টের সূত্র ধরে এরকম ভারসাম্যের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। প্রয়াত শামসুজ্জামান খান ওই ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন এবং তার নিমিত্তে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সব যেন থমকে গেল। তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে ভাবার মতো কেউ কি নেই? একুশে গন্থমেলা ২০২৩- এর পূর্বেই এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা বিতর্ক এবং পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আর সময়টা এখনই।

সবশেষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বরাবর একটি প্রশ্ন, ১৯৭৫-এর ট্রাজেডির পর বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত লেখক ট্রাস্ট অকার্যকর হয়ে যায়। জাতির জনকের দল টানা প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় থাকলেও ‘বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট’ পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ কেন নেয়া হলো না?