অন্তত ডিজিটাল সেবায়, আমাদের তরুণরা কপিতে মনোযোগ না দিয়ে নিজস্বতা আর উদ্ভাবনেই বেশি মনেযোগ দিক। তাহলে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে দেশকে উন্নতির পথ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে পারব।
Published : 12 Dec 2022, 01:05 PM
কথাটিকে গুরুগম্ভীর শোনাতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা কি বলছে? বাস্তবতা তো আসলে তাই-ই যা আমরা আমাদের জীবন দিয়ে শিখি। সেই শিক্ষা তো আমার কাছে এমনই– উদ্ভাবনের সংস্কৃতি তৈরি করে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
যতটা দেখেছি, তাতে এটা বললে খুব বেশি অন্যায় হবে না যে, যারা উদ্ভাবনের ধারা তৈরি করতে পারে না সেখানে উন্নয়ন নিজস্বতা পায় না। আর ধার করা উদ্ভাবনে উন্নয়নটাও হয় ধার করা, অনেক ক্ষেত্রে ঠুনকো। তবে ধার করা উদ্ভাবন আমাদের লাগবে, অবশ্যই লাগবে। কিন্তু নিজেদেরও সেখানে কিছু যোগ করতে হবে। কাস্টমাইজ করতে হবে। আবার নিজস্ব উদ্ভাবন লাগবেই। এটাই আমার জীবনের শিক্ষা।
আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবনের কথাই ধরুন। সামান্য গুড়, একটু লবণ আর এক মগ পানি। এই একটা উদ্ভাবন দিয়েই তো আমরা লাখ লাখ মানুষের জীবন আলো বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। গাছের জীবন থাকার রহস্য উম্মোচনও তো বিশ্বখ্যাত উদ্ভাবন। বাতাসের ভেতরে থাকা তরঙ্গের মাঝ দিয়ে শব্দ আদান-প্রদানও তো আমাদের এই বাংলায়ই প্রথম আলোচনা হয়েছে। সুতরাং উদ্ভাবনের সংস্কৃতি যে আমাদের নেই তেমনটি ভাবার কিন্তু সুযোগ নেই। তবে ডিজিটাল সেবায় উদ্ভাবনে আমরা কিন্তু যোজন যোজন দূরে।
ধরুন না গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কারের কথা। বাংলায় এই আবিষ্কার আসতে মাত্র আড়াইশ বছর লেগেছে! কারণ কী? বাংলায় ব্যবহার উপযোগী করে ওই উদ্ভাবনকে ব্যবহার করতেই সময় খরচ হয়ে গিয়েছে।
সাম্প্রতিক ইতিহাসের কথায় যদি আসি, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেন। সত্যিকার অর্থে দিন বদলের ওই স্লোগান তরুণদের মধ্যে সব কিছু জয় করে ফেলার একটা উন্মাদনা বার্তা নিয়ে হাজির হলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনো আমার মতো তরুণকেও আলোড়িত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান। আমিও লেগে পড়ি নতুন কিছু করে ফেলার কাজে। টেলিযোগাযোগ খাতের বেশ কিছু কাজ করেছি ততদিনে। হঠাৎ খেয়াল করলাম চারিদিকে বহু ডিজিটাল সেবা বাজারে নামছে। দেশ-বিদেশের উদ্ভাবনের দিকে নজর থাকার কারণে বুঝতে পারছিলাম ওইসব সেবার অনেকগুলোই ছিল হুবহু কপি। যা আসলে আমাদের সমস্যার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে মিলছিলও না। সে কারণে খেয়াল করবেন ওইসব হাইরেটেড সেবার অনেকগুলো আবার নেইও হয় গিয়েছে। আমি কারও নাম বলতে চাই না।
কয়েক বছরের মধ্যে খেয়াল করলাম মোবাইল অপারেটরদের চ্যানেল ব্যবহার করে এক মোবাইল অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর সেবা বাংলাদেশে চলে এসেছে। এই আলোচনায় যাওয়ার আগে অবশ্য আমার ডাচ-বাংলা ব্যাংককে ধন্যবাদ বলা উচিৎ। কারণ তারাই দেশে প্রথম মোবাইল আর্থিক সেবা চালু করেছিল। যারা খবরাখবর রাখেন তারা ততদিনে কেনিয়ার এমপায়সার কথা জেনে গিয়েছেন। কেনিয়াতে তখন মোবাইল আর্থিক এই লেনদেন পদ্ধতির আন্তর্জাতিক খ্যাতি এসে গিয়েছে। আমরা সেটাকেই বাংলাদেশে কপি করে নিয়ে আসি। ডাচ-বাংলা ব্যাংক তখন ডিবিবিএল মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে সেবাটা চালু করে, পরে নাম বদলে ‘রকেট’ করেছে। এরপর তো আরও অনেকগুলো সেবা বাজারে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না এই সেবাগুলো মানুষের কাজে এসেছে। তবে তার জন্যে গ্রাহকদেরকে কতটা চড়ামূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে তা গ্রাহকরাই বলবেন। আমি কেবল বলব উদ্ভাবনটিকে আমরা যদি খানিকটা হলেও নিজস্বতা দিতে পারতাম তাহলে হয়তো অন্যরকম হতে পারত।
যেহেতু অনেক দিন সিঙ্গাপুরে থেকে টেলিযোগাযোগের ব্যবসা করেছি, সুতরাং সহজ এবং সাশ্রয়ী লেনদেন কতটা জরুরী তা সম্পর্কে ভালোই ধারণা জন্মেছে। কিন্তু দেশে এলেই এ বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই এক ধরনের মন খারাপ কাজ করত। এক পর্যায়ে মাথায় একটা চিন্তা আসে এবং কয়েকজন সমমনা বন্ধুকে নিয়ে আলোচনায় বসি। আলোচনাটা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছেও পৌঁছায়। তাতেই যেন ভোজবাজির মতো কাজ হয়ে যায়।
আমাদের আলোচনা ছিল, আর্থিক অ্যাকাউন্ট খোলা যেহেতু খুবই ঝক্কির কাজ, তাই এটাকে সহজ করতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সহজেই আমরা কাজটা করেও ফেলে। গ্রাহক পরিচয় নিশ্চিতকরণের জন্যে তখন দেশের প্রথম ইলেক্ট্রনিক কেওয়াইসি আমাদের হাতে। আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু তারপরও ভয় ছিল এই উদ্ভাবনকে গ্রাহক-নিয়ন্ত্রক সংস্থা গ্রহণ করবে তো? অবাক করা ব্যপার হলো, গ্রাহক রাতারাতি গ্রহণ করে নিল। জাতীয় পরিচয়পত্রের দুই দিক স্ক্যান করে মুহূর্তেই অ্যাকাউন্ট খোলা যায়– এর চেয়ে সহজ আর কি হতে পারে! নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবশ্যই ধন্যবাদ বলতে হবে কারণ তারাও বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবেই নিল। যদিও চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে আরও একটু দেখে নিতে চাইছিল তারা। তবে যারা সবার আগে গ্রহণ করবে বলে ভেবেছিলাম চ্যালেঞ্জটা আসলো আমার সেই প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধুদের কাছ থেকে। তারা এটা নিয়ে নানান সমালোচনা শুরু করলেন। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো যখন উদ্ভাবনের এই সুবিধাটা পরখ করে দেখলেন তখন আবার সবাই হুড়মুড় করে আমাদের ই-কেওয়াইসি কপি করে ফেললেন।
আমার ভালোলাগা এখানেই যে, দেশের আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশনে এই উদ্ভাবনটি কাজে লাগছে। এখন দেশের সবগুলো মোবাইল আর্থিক সেবা তো অবশ্যই, অনেকগুলো ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এখন এই উদ্ভাবন ব্যবহার করছে। শুধু এই একটা উদ্ভাবনের কারণে আট-দশ পৃষ্ঠার ফর্মপূরণ করে অ্যাকাউন্ট খোলার হাত থেকে বেঁচেছে গ্রাহক। বেঁচেছে তাদের সময় আর খরচও। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচিয়েছে তাদের ব্যবসার খরচ। আর দেশ পেয়েছে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গতি।
এরপর আমাদের আরও একটা উদ্ভাবন তো তথ্য প্রযুক্তির বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়েছে। না চাইতেও কিছু স্বীকৃতি চলে এসেছে ঘরে। সেটা হল, যেকোনো মোবাইল ফোন থেকে *১৬৭# ডায়াল করে অ্যাকাউন্ট খোলার পদ্ধতি। এখানেও আমরা সমালোচনার শিকার হয়েছি। কিন্তু এখন দেখছি আমাদের এই উদ্ভাবন, আরও কেউ কেউ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।
এই প্রযুক্তটা কীভাবে কাজ করে একটু বলি। কোনো গ্রাহক ধরুন যার ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট নেই। তিনি যদি মোবাইল ফোন থেকে *১৬৭# ডায়াল করেন তার অর্থ হবে গ্রাহক সচেতনভাবে আমাদেরকে তার অ্যাকাউন্টটা খুলে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। তার এই অনুমতিসাপেক্ষে আমরা ওনার ব্যবহৃত মোবাইল অপারেটর থেকে চারটি তথ্য নিয়ে নেব। আর সেগুলো সরকারের ‘পরিচয়’ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র ডেটাবেইজের মাধ্যমে মিলিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে দেব।
এই দুটি উদ্ভাবন গত সাড়ে তিন বছরে দেশে নতুন প্রায় সাত কোটি আর্থিক অ্যাকাউন্ট দিয়েছে। এই উদ্ভাবনগুলো গ্রাহক ভোগান্তি কমিয়েছে, গ্রাহক আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ কমিয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষেও তখন আগের চেয়ে কম খরচে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আর এ সবই দেশকে আরো বেশি এগিয়ে নিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করছে।
আমি নিজে যেহেতু উদ্ভাবন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছি এবং দেখছি তাতে সাফল্য মেলে। আমি চাইব, অন্তত ডিজিটাল সেবায়, আমাদের তরুণরা কপিতে মনোযোগ না দিয়ে নিজস্বতা আর উদ্ভাবনেই বেশি মনেযোগ দিক। তাহলে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে দেশকে উন্নতির পথ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে পারব।