একাত্তরে ভবেরচর এলাকার বীর কিশোরদের প্রাণবিয়োগের কারণে লোকে এই গ্রামকে বলে শোকের গ্রাম। প্রতি বছর ৭ ডিসেম্বর আসে। ওই দিন ভবেরচরের মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ হয়, বুকে শোকের ঢেউ খেলে।
Published : 06 Dec 2023, 11:26 PM
তখনও জানতাম না মুক্তিযুদ্ধ কী? আমি দেখতাম জেঠিমা রাবেয়া খাতুনের চোখে কান্নার বান। প্রতিদিন তিনি আমাকে একই গল্প বলছেন। সেসব গল্প শুনতে আমার ক্লান্তি লাগত না। আমি শুনতাম কেমন করে আউয়াল সরকারকে হত্যা করা হয়েছে। কেমন করে তুলে নেওয়া হয়েছে তার চোখ, কেটে দেওয়া হয়েছে পুরুষাঙ্গ; থেঁতলে দেওয়া হয়েছে শরীর! এক অজানা শিহরণে আমি বোঝার চেষ্টা করতাম একজন জীবন্ত কিশোরের শরীর কীভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা যায়! ভেবে আমার গা গুলিয়ে আসত। কোনো কোনো দিন আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠতাম। তখন জেঠিমা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন ‘তুই তো আমার আউয়াল সরকার। আমার হারিয়ে যাওয়া বুকের মানিক।’ জেঠিমার গল্প শুনতে শুনতে ভেজা চোখে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের মধ্যে একসময় হয়তো ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু গল্পের বীজগুলো ছড়িয়ে পড়ত আমার মগজের কোষে কোষে।
জেঠিমার মুখেই প্রথম শুনতে পাই তার ছেলের মতো আরও আট কিশোরের আত্মত্যাগের করুণ কাহিনি। হারিয়ে যাওয়া নয় কিশোর, জেঠিমার পুত্রশোক, তার কোলে আমি এবং মুক্তিযুদ্ধ পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ায় আমাকে ক্রমাগত সেসব দিনের দিকে ধাবিত করে। সেসব অযুত দিনের, স্বপ্নের, রক্তের, খুনের, হিংস্রতার ভয়াল ইতিহাসে কখন যেন আমি নিজেকেই সমর্পণ করে ফেলি। শুরু হয় আমার মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার অনুসন্ধান, চর্চা ও অন্বেষণ।
একাত্তরে হানাদারদের ভয়াল রোষে পড়া এক গ্রাম ভবেরচর। যুদ্ধের শুরুতেই এখানে মুক্তিসংগ্রামের দানা বাঁধতে শুরু করে। এই গ্রামের পুবদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সামরিক ভাষায় এ সড়ককে বলা হতো এমএসআর বা মেইন সাপ্লাই রুট। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিদের সমস্ত রসদ প্রবেশ করত এই সড়ক দিয়ে। ফলে হানাদার বাহিনী যেকোনো কিছুর বিনিময়ে সড়কটি সচল রাখতে চাইত। অন্যদিকে মুক্তিসংগ্রামীদের প্রধান কাজ ছিল সেতু-কালভার্ট উড়িয়ে দিয়ে শত্রুদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এ নিয়েই মূলত দখলদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘাত।
১৯৭১ সালে ৩০ অগাস্ট স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভবেরচর সেতুটি উড়িয়ে দেয়। হানাদার বাহিনী বিধ্বস্ত সেতুর স্থলে কাঠ দিয়ে সেতু বানিয়ে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখে। সেতুর পাশে সেমি ক্যাম্প স্থাপন করে তল্লাশির নামে প্রতিদিন যাত্রীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়, অসহায় নারীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ ফুঁসে ওঠে। ক্ষোভে এলাকাবাসী এক রাতে সেতুটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু সামান্য আগুনে পাহাড়ি কাঠে বানানো সেতুটি ধ্বংস করা সম্ভব হয় না। পরদিন ৭ ডিসেম্বর ফজরের আজানের পর থেকে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী সেতুটি ভাঙতে শুরু করে। সকাল ১০টার দিকে সেতুর কাছে ছদ্মবেশ নিয়ে রেড ক্রসের লোগো-সংবলিত একটি মাইক্রোবাসে করে হঠাৎ চলে আসে রক্তপিপাসুর দল। এটি যে হানাদাদের মাইক্রোবাস, তা বুঝতে সময় লেগে যায় সেতুর দুদিকে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের।
আলীপুরার দিকে শিলার মতো গুলি আসছে। একটু থেমে আবার বিরামহীনভাবে গুলি। কড়ই, শিমুল আর শিশুগাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ছে। লোকজন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাচ্ছে। কী করবে, কোন দিকটায় যাবে বুঝতে পারছে না। সবার মাথায় জান বাঁচানোর চিন্তা। কেউ সেতুর ওপর থেকে লাফিয়ে খালে পড়ছেন। কেউবা পাশের ডোবায় ঝাঁপ দিয়েছেন। বালুধুমের মাঠ পেরিয়ে কোনোরকমে ভবেরচর বাজারে পৌঁছতে পারলে আর বিপদ থাকে না। তাই ভয়ার্ত লোকজন পিঁপড়ার ঝাঁকের মতো বাজারের দিকে ছুটছে। ইতোমধ্যে বাজারের অধিকাংশ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে শক্তি কমে যাওয়া গুলি এসে পড়ছে টিনের চালে। যেভাবে গুলি আসছে তাতে বাজারও নিরাপদ নয়। দিশেহারা লোকজন করিমখাঁ, হোগলাকান্দি, বাঘাইকান্দি, কালীপুরা আর আন্ধারমানিকের দিকে ছুটছে। গুলির শব্দে দূরের গ্রামগুলোও কেঁপে উঠছে।
গুলি থেকে মাথা বাঁচিয়ে সবাই পালিয়ে যেতে পারলেও পাশের একটি নির্জন কবরস্থানে আশ্রয় নেয় কয়েকজন কিশোর। হানাদাররা কবরস্থানটাকে জালের মতো বেড় দেয়। আড়ালির ঘনঝোপ আর কবরের সুড়ঙ্গ থেকে কিশোরদের বের করে আনে। এরপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যাতৃষ্ণা মেটায়। ঘাতকের দল সেদিন কিশোরদের খুন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি; পাশবিক নির্যাতনের এক ঘৃণিত নজিরও তৈরি করে। হানাদাররা কয়েকজন কিশোরকে বিবস্ত্র করে পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়। চোখ উপড়ে ফেলে। দেহ থেকে হাত ও আঙুল বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেদিন হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় আবদুল আউয়াল সরকার, মতিউর রহমান জাহাঙ্গীর, শাহাদত হোসেন, শাহজালাল মৃধা, রুহুল আমীন সরকার, উমেশ চন্দ্র মালি, নূর মাহাম্মদ ব্যাপারী, নূরুল ইসলাম ও গোলাম হোসেন নামের নয়জন কিশোর। ওইদিন ভবেরচর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ কৃষক মো. ইসমাইল সরকার ও স্বর্ণকার হরিপদ চক্রবর্তীও হত্যাকাণ্ডের বলি হন।
ভবেরচর গণহত্যা যে আকস্মিকভাবে হয়েছে তা নয়, বরং এই গণহত্যা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। পাকিস্তানি হানাদাররা আগে থেকেই এই এলাকার মুক্তিসংগ্রামীদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ ছিল। তাই অগাস্ট মাসেই পাকিস্তানি মার্শাল ল’ আদালত এই এলাকার যুবকদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। তাদের শায়েস্তা করতে না পেরে গণহত্যাভিযানের পরিকল্পনা করে। একাত্তরে শত্রুদের কবল থেকে এই গ্রামকে মুক্ত করার জন্য যে বীর কিশোররা জীবন উৎসর্গ করেছিল; জন্মসূত্রে তাদের প্রতি আমার অপরিমেয় ঋণ।
একাত্তরের যে বিশালতা তাতে এই নয় কিশোরের আত্মদান হয়তো খুব বড় কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এ রকম ছোট ছোট শিশির বিন্দু দিয়েই রচিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু আমার ছেলেবেলায় জেঠিমা রাবেয়া খাতুন আমার মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের যে বীজ বুনে দিয়েছিলেন আমি এখনও তা বহন করে বেড়াই। জেঠিমার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে ভাবতাম, কবে বড় হবো! আমার কিশোরকাল উত্তীর্ণ না হতেই আমি এক যুদ্ধে নেমে পড়ি। ১৯৯৫ সালে ১৬ বছর বয়সে প্রকাশ করি ‘মেঘনার চরে মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি সংকলন। তখন আমাদের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ তেমন কথা বলত না। এর দুই বছর পর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভবেরচর গণহত্যায় বীর শহীদদের স্মরণে নামফলক নির্মাণ করি। ২০২১ সালে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বের হয় আমার লেখা ভবেরচর গণহত্যার আখ্যান-‘গণহত্যার গহন গল্প: প্রসঙ্গ ভবেরচর’। এর আগে ২০১৮ সালে ‘গণহত্যা গজারিয়া: রক্ত মৃত্যু মক্তি’ ও ২০২০ সালে গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ (মুন্সীগঞ্জ জেলা) শিরোনামে আমার দুটি বই প্রকাশিত হয়।
একাত্তরে ভবেরচর এলাকার বীর কিশোরদের প্রাণবিয়োগের কারণে লোকে এই গ্রামকে বলে শোকের গ্রাম। প্রতি বছর ৭ ডিসেম্বর আসে। ওই দিন ভবেরচরের মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ হয়, বুকে শোকের ঢেউ খেলে। ওইদিন কবরস্থানের সামনে গিয়ে স্বজনহারা মানুষ দোয়া-দুরূদ পড়েন; নীরবে কান্না মোছেন। ভবেরচর সেতুর সামনে গিয়ে তারা বুক চাপড়ে মাতম করেন। বেদনায় কুঁকড়ে ওঠেন— কত নৃশংস ছিল ওরা; সেই কথা মনে করে।