এতকিছুর পরও বলতে হয়, চলচ্চিত্র-বিশ্বের এক তীর্থস্থান এই অস্কার মঞ্চ। এর পেছনে পুঁজির জোর ও প্রযুক্তির দৌঁড় আছে। তাই এখান থেকে যে ছবিকেই পুরস্কৃত করা হোক না কেন, সেটি কোনো না কোনো বার্তা পৌঁছে দেয় বিশ্ববাসীর কাছে। অস্কার বাণিজ্য যেমন সামলায়, বিশ্বরাজনীতিও সামলায়।
Published : 23 Mar 2023, 03:55 PM
প্রতিটি পুরস্কারেই কিছু মানদণ্ড থাকে। চলচ্চিত্রে পুরস্কার প্রদানেও এর ব্যতিক্রম হয় না। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা অস্কার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের অনুষ্ঠান, এখানে মার্কিন ছবিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে ইদানিং তারা আগ্রহী হয়ে উঠছে বিদেশী ছবিগুলোর প্রতি। ২০২০ সালে অস্কারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অ-ইংরেজি ভাষায় বানানো ‘প্যারাসাইট’ শ্রেষ্ঠ ছবির মর্যাদা পায়। ৯২তম অস্কারে বোং জুঁ-হ পরিচালিত এই কোরিয়ান ছবিটি চারটি বিভাগে পুরস্কার পায়, সেগুলোর ভেতর শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্যের পুরস্কারটিও ছিল।
অনেকদিন ধরেই হলিউড তাদের গণ্ডির বাইরে থাকা মেধাকে নিজেদের সাথে যুক্ত করতে চাচ্ছে। অস্কারের মাধ্যমে পুরস্কৃত করে তারা বিদেশী পরিচালকদের সুযোগ করে দিতে চায় হলিউডে। নতুন পরিচালক মানে নতুন চিন্তা-ভাবনা, নতুন গল্প। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন অন্য দেশের ছবিকে যুক্ত করা মানে অনুষ্ঠানের দর্শকও বৃদ্ধি পাওয়া। আর তা যদি হয় এশিয়ার তাহলে তো কথাই নেই, দর্শক বাড়বে হুহু করে, কারণ ইউরোপের চেয়ে বেশি মানুষের বাস এই এশিয়ায়।
বলে রাখা ভালো, অস্কার অনুষ্ঠানে দর্শক বৃদ্ধি পাওয়া মানে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া। বেশি দর্শক অনুষ্ঠান দেখছে মানে তাদের পুরস্কৃত ব্যক্তি ততো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে আর এর মাধ্যমে অস্কারের মঞ্চ আখেরে মার্কিন স্টুডিওগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থকেই রক্ষা করে। সাধারণ শিল্পীকে তারকা বানানো কিংবা তারকাকে মহাতারকা বানানো কারখানারই একটি সুপরকল্পিত ব্যবসায়িক কৌশল। এতে হলিউডের প্রযোজনা সংস্থাগুলোর ব্যবসা করাটা সহজ হয়ে যায়। এজন্যই দর্শক খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অস্কার তথা হলিউডের জন্য।
‘প্যারাসাইট’ যে বছর পুরস্কৃত হলো, তার আগের পাঁচ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে অস্কারের দর্শক কমতে শুরু করেছিল, যদিও মাঝের এক বছর কিছুটা বাড়তি ছিল, তবে তা আশা জাগাতে পারেনি অস্কার কর্তৃপক্ষের। নিয়েলসেন মিডিয়া রিসার্চের (Nielsen Media Research) মতে, টিভিতে ও বাসার বাইরে লাইভ স্ট্রিমিং মিলিয়ে ২০১৫ সালে অস্কারের দর্শক ছিল ৩৬.৬ মিলিয়ন, যা আগের বছরের তুলনায় ৭.১ মিলিয়ন কম। ২০১৬ সালে দর্শক সংখ্যা আরও কমে হয় ৩৪.৩ মিলিয়ন। ২০১৭ সালে হয় ৩২.৯ মিলিয়ন। ২০১৮ সালে অস্কার অনুষ্ঠান দেখে আরও কমসংখ্যাক মানুষ, ২৬.৫ মিলিয়ন। পরের বছর, ২০১৯ সালে দর্শক কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯.৬ মিলিয়নে। ওই বছরেরই শেষের দিকে পৃথিবীতে ছড়াতে শুরু করে কোভিড-১৯। ২০২০ সালের শুরুতে মহামারীর বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি বিশ্বনেতারা। আতঙ্ক তখনো গ্রাস করেনি মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে। তারপরও দেখা যায় ২০২০ সালে দর্শক কমে দাঁড়ায় ২৩.৬ মিলিয়নে। ২০২১ সালে অবশ্য মহামারী আতঙ্কে গোটা বিশ্ব কাবু। এ বছর অস্কারের দর্শক আরও কমে আসে, ১০.৪ মিলিয়ন। যদিও তখন মানুষ ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছিল, কিন্তু অস্কার অনুষ্ঠানের ভাগ্যে ঘটে উল্টো ঘটনা। ২০২২ সালে এসে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় অস্কার, দর্শক বেড়ে হয় ১৫.৩৬ মিলিয়ন। বলা বাহুল্য নয়, এই বছর জাপানের ছবি ‘ড্রাইভ মাই কার’ পায় শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির পুরস্কার।
‘প্যারাসাইট’-এর সাফল্যের বছরেই একটি অসন্তোষ দেখা দেয়, অভিযোগ ওঠে অস্কারে এশিয়ানদের উপেক্ষা করা হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় বলা হতে থাকে, হলিউডে এশিয়ান যারা কাজ করছেন, তারা উপেক্ষিত এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগে ভালো ছবি জমা পড়লেও শেষপর্যন্ত সেগুলোকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমার মনে হয়, অভিযোগটি আমলে নেয় অস্কার কর্তৃপক্ষ। তাতে লাভ বৈ ক্ষতি তো নেই! এশিয়ার ছবিকে স্থান দেওয়া মানে এশিয়ার বিপুল সংখ্যক দর্শককেও আকৃষ্ট করা। আগেই বলেছি, অস্কারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দর্শক। আসলে গত এক যুগ ধরেই দর্শক সংকটে ভুগছে অস্কার।
২০০০ সালের দিকে তাকালে দেখব ওই বছর ৪৬.৩৩ মিলিয়ন মানুষ অস্কার দেখেছে। এরপর আর কখনো ওই অংক ছুঁতে পারেনি অস্কারের কোনো আসর। ওঠানামা আছে, কিন্তু ২০০০ সালের ৪৬.৩৩ মিলিয়ন দর্শকের মাইল ফলক আর ডিঙোনো যায়নি আজ অব্দি। যদিও ইদানিং একটু একটু করে আবার দর্শক ফিরছে, কিন্তু সেটা খুবই নগণ্য। করোনার পর এশিয়ার ছবি ‘ড্রাইভ মাই কার’ দিয়েই মনে হয় দর্শককে আকৃষ্ট করা গেছে ২০২২ সালে। আর এ বছর ২০২৩ সালে অস্কারের দর্শক ছিল ১৮.৭ মিলিয়ন। যা গেল বছরের তুলনায় ৩.৩৪ মিলিয়ন বেশি। এ বছর ছিল এশিয়ার জয়জয়কার। আমার ধারণা এশিয়াকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই দর্শক সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে অস্কার। এশিয়ার বিশাল দর্শকগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করার জন্যই এবার তারা ভারত, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন সর্বত্রই নজর দিয়েছেন।
অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস ওরফে অস্কারের আয়োজন করে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস। এটি যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, গোটা বিশ্বের মধ্যে খুবই জাঁকজমকপূর্ণ চলচ্চিত্রের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান যদি শঙ্কাজনকহারে দর্শক হারাতে থাকে, তাহলে একদিকে এর গৌরব যেমন হারিয়ে যাবে, তেমনি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে অনেকগুলো পক্ষ। কাজেই দর্শক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে। দুর্মুখেরা তো বলে থাকেন, ২০২২ সালে অস্কারের মঞ্চে সকলের সামনে উপস্থাপক ক্রিস রককে যে চড় মেরেছেন উইল স্মিথ, সেটা ছিল অস্কারের দর্শক বাড়ানোর জন্য সাজানো নাটক। অস্কারের বিরুদ্ধে এমনিতেই বহুদিন ধরে বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগ আনা হচ্ছিল, সেরকম এক পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের এমন আচরণ অস্কারকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে দিয়েছিল। তবে স্মিথের ওপর দশ বছরের নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে উল্লিখিত ঘটনাটি সাজানো ব্যাপার নয়। স্মিথের জীবনীগ্রন্থ পড়লেই বোঝা যায়, তিনি কিছুটা রগচটা স্বভাবেরই মানুষ।
তবে এ বছর বিতর্কিত কোনো ঘটনা নয়, অস্কার আলোচনায় থেকেছে এশিয়ার কারণে। শ্রেষ্ঠ হলো যে ছবিটি ‘এভরিথিং এভরিহোয়ের অল অ্যাট ওয়ান্স’, সেখানে মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মালয়েশিয়ার অভিনেত্রী মিশেল ইয়েহো, তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীও হয়েছেন ৯৫তম অস্কারে। এটাই প্রথম কোনো এশীয় নারীর অস্কার জয়। একই আসরে সেরা পার্শ্বঅভিনেতার পুরস্কার জিতেছেন একই ছবির অভিনয়শিল্পী চীনা বংশোদ্ভূত ভিয়েতনামে জন্ম নেওয়া কি হিউ কুয়ান। অন্যদিকে, সেরা মৌলিক গানের পুরস্কার জিতেছে ভারতীয় নাচেগানে ভরপুর ছবি ট্রিপল ‘আর’-এর ‘নাটু নাটু’ গান। শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কারও জিতেছে ভারতের ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইসপারার্স’। মনোনয়নে ছিল ভারতের আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র ‘অল দ্যাট ব্রেথস’।
৯৫তম অস্কারে এশিয়ার একাধিক পুরস্কার প্রাপ্তিতে অনেকে খুশি হলেও, কিছুটা অসন্তোষ দেখা গেছে এস এস রাজামৌলি পরিচালিত ছবি ট্রিপল ‘আর’কে নিয়ে। ভারতের দক্ষিণী পরিচালক তামারেড্ডি ভরদ্বাজের অভিযোগ অর্থ দিয়ে অস্কার কিনেছেন রাজামৌলি। এমন অভিযোগ তুলেছেন আরও অনেকে। তবে এমন অভিযোগের কোনো ভিত্তি আমি খুঁজে পাইনি। সামান্য অর্থ লেনদেন করতে যাবে না অস্কার কর্তৃপক্ষ। তাদের লক্ষ্য বরং থাকে আরও দূরে। তারা আসলে পুরস্কার দেওয়ার ভেতর দিয়ে বর্তমান ভারতের দর্শনকে মার্কিনী অনুমোদন দিতে চায়। আরও একটি বিষয় না বললেই নয়, ভারতীয় তারকাদের পুরস্কৃত করলে বিশ্ববাজারে তাদের মূল্য বাড়ে, আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের বাজারে ছবি প্রযোজনা করতে চায় মার্কিন স্টুডিওগুলো। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাউকে বিশ্বতারকার মর্যাদা দিয়ে তারপর তাকে নিয়ে ছবি বানালে সেই জনগোষ্ঠীর ভেতর সেই ছবিটি যে ভালো ব্যবসা করবে তাতে আর সন্দেহ কি!
ট্রিপল ‘আর’ ছবিটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মোড়কে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চরম প্রকাশ এবং তার সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় তথা পৌরাণিক বীররস। বর্তমানে ভারত সরকার যে মন্ত্রে দীক্ষিত, তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় রাজামৌলির এই ছবিতে। একই ভাবধারায় পুষ্ট চলচ্চিত্রকে পুরস্কার দেওয়া মানে কোনো না কোনোভাবে সেই ভাবধারাকেই অনুমোদন দেওয়া। আর হলিউড ও অস্কারের মধ্য দিয়ে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নানাবিধ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে থাকে, তা তো সর্বজনবিদিত। এখন বন্ধুপ্রতীম আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদকেও হয় তো একটু সমর্থন করছে।
তবে এতকিছুর পরও বলতে হয়, চলচ্চিত্র-বিশ্বের এক তীর্থস্থান এই অস্কার মঞ্চ। এর পেছনে পুঁজির জোর ও প্রযুক্তির দৌঁড় আছে। তাই এখান থেকে যে ছবিকেই পুরস্কৃত করা হোক না কেন, সেটি কোনো না কোনো বার্তা পৌঁছে দেয় বিশ্ববাসীর কাছে। অস্কার বাণিজ্য যেমন সামলায়, বিশ্বরাজনীতিও সামলায়।