সংস্কৃতির জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রসঙ্গে

স্বাধীন দেশের প্রথম দিকে সংস্কৃতি অঙ্গনে আমলাতন্ত্রের বড়সড় বহর না থাকলেও, কর্মযজ্ঞ ছিল বিশাল। ছিল না এখনকার মতো ডজন-ডজন সংস্কৃতি-মোড়ল।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 7 June 2023, 11:13 AM
Updated : 7 June 2023, 11:13 AM

বাজেট উপস্থাপনের পর অন্যান্য অঙ্গনের মতো সংস্কৃতি অঙ্গন থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছে। পহেলা জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে। এরপর থেকে দাবি উঠেছে সংস্কৃতির জন্য জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে শতকরা এক ভাগ বরাদ্দ দেবার জন্যে। প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দের হার শতকরা ০.০৯ ভাগের সামান্য ওপরে। অথচ এই বরাদ্দ ২০১৯-২০২০ সালের বাজেটেও প্রায় ০.১১ ভাগের মতো ছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাজেট বরাদ্দ কমতির দিকে। এই বাস্তবতায় সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়লদের প্রতিক্রিয়া অমূলক নয়।

এবারের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ প্রণীত বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ওই ক্ষীণাকার বাজেটেও সংস্কৃতির জন্যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, সংস্কৃতির কাঠামো, পরিকাঠামো এবং অবকাঠামোর জন্যে পরিষ্কার ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। স্বাধীন দেশের সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ওই সময়ে সবকিছু নতুন করে এবং অনেক কিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল। মোটাদাগে উল্লেখ করা যায় শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমির নবযাত্রা, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থাগার, আর্কাইভ, জাদুঘর ব্যবস্থাপনা, চারু ও কারুশিল্পের বিকাশে মনোযোগসহ ভবিষ্যতের আলোকিত জাতি গঠনের দিকনির্দেশনা ছিল ওই সময়ে সরকারের কর্মযজ্ঞে।

ওই সময়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা ১৯৭৫ সালের ভয়াবহ ট্রাজেডির পর বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই শতকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল টানা প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় থাকলেও ওই বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট পুনরুজ্জীবিত করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৯৯৫ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরেই ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন আর সভাপতিত্ব করেছিলেন কবি জসীম উদ্ দীন।

প্রথম বাজেটের সঙ্গে বর্তমান বাজেটের তুলনা করলে দেখতে পাই, প্রস্তাবিত বাজেট ৫১ বছরে প্রায় হাজারগুণ বেড়েছে। সেই তুলনায় সংস্কৃতির কাঠামো-পরিকাঠামো বাড়েনি বললেই চলে। ক্ষেত্রবিশেষে আমলাতন্ত্রের জাঁতাকলে সংস্কৃতির জন্যে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিষ্পেষিত হয়েছে।

স্বাধীন দেশের প্রথম দিকে সংস্কৃতি অঙ্গনে আমলাতন্ত্রের বড়সড় বহর না থাকলেও, কর্মযজ্ঞ ছিল বিশাল। ছিল না এখনকার মতো ডজন-ডজন সংস্কৃতি-মোড়ল। ওই সময়ে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি জসীম উদদীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আব্দুল মতিন চৌধুরী, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের মতো সংস্কৃতির জন্যে দরদী সুদূর দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মেধাবী ও আলোকিত অনেক মানুষ স্বাধীন দেশের সংস্কৃতির উন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এর বিপরীতে বর্তমান সময়ে আমরা পার করছি অনেকটাই পুরস্কার ও পদলোভী বিবৃতিজীবী, বুদ্ধিজীবী আর মোড়লের কাল। তারা জাতীয় সংস্কৃতির জন্যে কোনো কর্মপরিকল্পনা হাজির করতে না পারলেও সময় বুঝে গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে নিজেদের চেহারা তুলে ধরার সুযোগটা ঠিক ঠিক নিতে পারেন।

সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য ১৯৭৫ সালের পর কোনো সরকারের আমলেই উল্লেখযোগ্যরকম ভালো বাজেট ছিল না। যদিও ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে ওবায়দুল কাদের যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যথেষ্ট কর্মতৎপর ছিল। বর্তমান সরকারের টানা দেড় দশকে সেই কর্মতৎপরতা অনুপস্থিত। তবে উল্লেখ করা দরকার, আবুল কালাম আজাদ সংস্কৃতি মন্ত্রী থাকাকালীন দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উন্নয়নের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী কিছু তৎপরতা ছিল। ওই সময়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে প্রধান করে দেশের গ্রন্থাগার উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য এবং অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে সংস্কৃতির উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের জন্যে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি তাদের সুপারিশসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিলেও পরের দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ওই প্রতিবেদনের ব্যাপারে কোনোরকম ইতিবাচক উদ্যোগ কি নিয়েছেন? এমনকি ওই প্রতিবেদন দুটো প্রকাশ্যেও আনা হয়নি। এই সময়কালে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং খোদ মন্ত্রণালয় অনেকটা রুটিন দায়িত্ব পালন করেই দায় সেরে চলেছেন।

এবার বাজেট নিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়লদের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গত দেড় দশক ধরে প্রায় প্রতিবছর বাজেট প্রকাশের পর তাদের তরফ থেকে অনেকটা একই ধরনের রুটিন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে আসছেন। অবস্থাটা ‘বলনেওয়ালা’ বলে যান, ‘শুনলেওয়ালা’ শুনেন কিনা তা বোঝা না গেলেও বাজেটে সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দ দিন দিন তুলনামূলক হারে কমতেই থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে উন্নয়ন বাজেট থেকে কিছু থোক বরাদ্দ এলেও তার ফলাফল জানামতে সুখকর নয়। সেই ‘তিতা’ অভিজ্ঞতা থেকেই কি সরকারের নীতিনির্ধারদের তরফে সংস্কৃতির জন্যে বাজেট বৃদ্ধিতে অনীহা?

অন্যান্যবার সংস্কৃতির মোড়লদের এরকম প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবারে প্রতিক্রিয়ার চিত্র ভিন্নরকম। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ইতোমধ্যে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে, শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা মতবিনিময় সভায়। একই সঙ্গে ৯ জুন দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

আমার মনে একটা প্রশ্ন। গত দেড় দশকে ওইসব সংস্কৃতি মোড়লদের অনেকেই সরকার থেকে নানা পদ, পদবি, পুরস্কার ও ঠিকাদারি বাগিয়ে নিয়েছেন। সংস্কৃতির পেশাদারি উন্নয়ন ও বিকাশের জন্যে উল্লেখযোগ্য কোনো দাবি ও কর্মপরিকল্পনার কোনোটাই সরকার বরাবর হাজির করেননি। এই সংসদে সরকারি দল থেকেই সংস্কৃতি অঙ্গনের আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, মমতাজ বেগমসহ কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। তারা এই সংসদে সংস্কৃতির জন্যে কী করলেন জানতে ইচ্ছে করে।

প্রতিক্রিয়া প্রকাশকারীরা বিগত বছরগুলোতে দেশের সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্যে দিকনির্দেশনামূলক বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা হাজির করতে পারেননি। অথচ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাজেটের বেলায় এসে অনেকটা বিরোধী দল সেজে গেলেন কেন? এর রহস্য কী? সত্যি সত্যি সংস্কৃতির জন্যে বাজেট বরাদ্দের পক্ষে দূতিয়ালি করতে চাইলে বাজেট উপস্থাপনের আগেই তারা প্রথমে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও সংসদে সংস্কৃতি বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারতেন। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে দলীয় ফোরামে বিশেষ করে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও এর সংস্কৃতি বিষয়ক উপকমিটির সঙ্গে পরামর্শ করতে পারতেন। এই কমিটিও সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজনে ঠাসা। এমনকি এই কমিটির প্রধান আতাউর রহমান নাটকের মানুষ। তাহলে দোষটা কাকে দেবেন?

আদতে সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়লরা কী তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে ঠিক কাজটা করেছেন? নাকি পদ ও পদবি ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তি, পরিবার ও ব্যবসায়িক স্বার্থের দিকে মনোযোগী ছিলেন? নির্বাচনী বছরে এসে সুযোগ বুঝে এক্কেবারে রাস্তায় নেমে এলেন? এটা নীতিনির্ধারকদের নজরে আসার কৌশল নয় তো?

ডক্টর আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিগত 'নির্বাচনী ইশতেহার কমিটি' প্রণীত ইশতেহারে সংস্কৃতির জন্যে আলাদা কোনো অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ ছিল না। যদিও যুব উন্নয়ন পরিচ্ছেদে সারদেশে উপজেলা সদরে পাঁচশ যুবকমপ্লেক্স নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল।

যুব কমপ্লেক্সের অধীনে একটি প্রেক্ষাগৃহ, নাট্যশালা, গ্রন্থাগার এবং সাহিত্য অনুষ্ঠানের জন্যে একটি মঞ্চ ও সেমিনার কক্ষ নির্মাণের কথা ছিল। ওই নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ তার টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষপ্রান্তে এখন। অথচ এই যুব কমপ্লেক্স নিয়ে কোনো তরফ থেকেই কেউ কোনো উচ্চবাচ্য হলো না।

অন্যদিকে সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়লরা রাস্তায় নেমে এলেন সংস্কৃতির জন্যে কমপক্ষে শতকরা এক ভাগ বরাদ্দের দাবি নিয়ে। তাদের দাবি মতো বরাদ্দ দেয়া হলে প্রস্তাবিত বাজেট থেকে সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দের পরিমাণ হবে ৭ হাজার ৬ শ ১৭ কোটি টাকা। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের কাঠামো এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পরিকাঠামোর অধীনে এই টাকা ব্যবহার করার মতো লাগসই কর্মযজ্ঞ হাজির করার মতো কেউ কি আছেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভেতরে বা বাইরে?

সংস্কৃতির জন্যে কমপক্ষে শতকরা এক ভাগ বরাদ্দ গণতান্ত্রিক বিশ্বে অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। যেসব দেশে এরকম বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে তাদের কাঠামো-পরিকাঠামো এবং কর্মযজ্ঞের সঙ্গে আমাদের কাঠামোর তুলনামূলক একটা সমীক্ষা করে গলদ দূরকরণ, সেই সঙ্গে লাগসই কর্মযজ্ঞ প্রণয়ন জরুরি। তার আগে তড়িঘড়ি করে বরাদ্দ বাড়ালে ঠিকাদারির পসার বাড়লেও বাড়তে পারে, সংস্কৃতির উন্নয়ন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশের কারণ থেকেই যায়। অবস্থাটা শেষে এমন গিয়ে দাঁড়াবে, ‘সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল’।

কোনো কোনো দেশে বিশেষ করে আইসল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ডের মতো দেশে সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দ কখনো কখনো শতকরা দুই ভাগেরও ওপরে থাকে। উত্তর ইউরোপের দেশগুলোসহ পশ্চিমের অনেক গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রে সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দের পরিমাণ শতকরা এক ভাগের ওপরেই থাকে। কয়েক বছর আগে কানাডার আর্টস কাউন্সিলের তুলনামূলক একটি সমীক্ষা থেকে এরকম চিত্র পাওয়া যায়। ওইসব দেশে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দই শেষ কথা নয়। স্থানীয় সরকারের সকল স্তরে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ দেখভাল করা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দেবার জন্যে স্বতন্ত্র বিভাগ বা দফতর থাকে। আমাদের দেশে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, পৌরসভা পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সকল স্তরে এরকম বন্দোবস্ত কার্যকর করা দরকার।

তুলনামূলক সমীক্ষা তো দূরের কথা আমাদের নিজস্ব সুপারিশ বা উপাত্ত যা আছে তার আলোকেও কর্মযজ্ঞ সাজালে সংস্কৃতির বাজেটের এই করুণ চিত্র আমাদের দেখতে হতো না। আমাদের একটি আধুনিক যুগোপযোগী সংস্কৃতি নীতি নেই। দেড় দশক ধরে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পরিচালিত হচ্ছে ২০০৬ সালে জামায়াত-বিএনপি সরকার প্রণীত সংস্কৃতি নীতি দিয়ে। আমাদের ভাষা নীতি নেই, গ্রন্থ নীতি নেই, অভিধান সভা নেই, ভাষা উন্নয়ন বোর্ড নেই, অনুবাদ নীতি নেই। এরকম 'নেই'-এর তালিকা বড়ই দীর্ঘ।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি লোক দেখানো প্রতিষ্ঠান। এটিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনে, পর্যাপ্ত স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করে আমলাতন্ত্রের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো জরুরি। তাতে বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা আমাদের দেশের আদিবাসী মানুষের ভাষা-সাহিত্যকে বাঁচানোর পক্ষে উপকারে আসতে পারে।

বিলুপ্তির খপ্পরে পড়া যাত্রাশিল্পকে বাঁচানোর জন্যে যাত্রা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা দরকার। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনকে প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কৃতি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে দেশের সংস্কৃতির উন্নয়ন, বিকাশ ও রক্ষার জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বিদ্যমান শিল্পকলা একাডেমি যুগোপযোগী সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্যে যথেষ্ট নয়।

অন্যদিকে বইমেলা আয়োজন নিয়েই বাংলা একাডেমির অনেকটা হিমশিম অবস্থা। যদিও দুনিয়ার আর কোনো দেশের এরকম একাডেমি বইমেলার মতো একটি বিশাল অনুষ্ঠানযজ্ঞ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে না। বাংলা একাডেমির আরও জরুরি ভূমিকা পালন করার এখতিয়ার রয়েছে। দুনিয়ার এরকম একাডেমি বিশেষ করে ফরাসি একাডেমি, দিল্লির সাহিত্য একাডেমি, সুইডিশ একাডেমি, দিনেমার একাডেমির খবর নিয়ে দেখুন। একাডেমির সাধারণ পরিষদের নির্বাচন হয় না প্রায় দেড় দশক ধরে। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কেউ কি নেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভেতরে ও বাইরে এসব বিষয়ে নজর দেবার মতো?  

১৬ কোটি মানুষের দেশে উপজেলা পর্যায়েই গণগ্রন্থাগার নাই। প্রেক্ষাগৃহগুলো একের পর বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দুই কোটি মানুষের ঢাকা শহরে সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের জন্যে সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি কতটুকু কী করবে? প্রয়োজন নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি সংস্কৃতি কমপ্লেক্স গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে গ্রন্থাগার, প্রেক্ষাগৃহ, নাট্যশালা এবং সাহিত্য, সংগীত ও নৃত্যের জন্যে আলাদা মঞ্চ।

এসব প্রয়োজন ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত কর্মশালা এবং সিম্পোজিয়াম করে সংস্কৃতির মোড়লরা রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ পেতে পারেন। আর তা না হলে ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’-এর মতোই দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে বছরের পর বছর ।

স্বাধীন দেশের জনপ্রশাসনের পরিচালনার বাজেট শতকরা ১০ ভাগের কাছাকাছি। এর বিপরীতে গোটা দেশের সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দ ০.০৯ ভাগের মতো। তাও আবার এর সিংহভাগ আমলা, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতনাদির পেছনে প্রশাসনিক খরচ। আদতে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ তেমনটা নেই। এই চিত্র থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি দেশটা কেমন মাথাভারী আমলাতন্ত্রের খপ্পরে আছে। অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, দুনিয়ার আর কোনো দেশে এরকম আমলাতোষণ বাজেট আছে কি?

এর থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগটা হতে পারে দেশের সংস্কৃতির উন্নয়নের মধ্য দিয়ে। শুরুটা হতে হবে জাতীয় সংস্কৃতি নীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন থমকে আছে রাজধানীকেন্দ্রিক কতিপয় বুদ্ধিজীবী, আমলা, চতুর বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ী আর করপোরেট ঠিকাদারের খপ্পরে পড়ে। এই খপ্পর থেকে বের হয়ে আসার পথ বাতলানো থাকতে হবে প্রত্যাশিত সম্ভাব্য জাতীয় সংস্কৃতি নীতিতে। তাতে সংস্কৃতির জন্যে বাজেট বরাদ্দ প্রসঙ্গ হালে পানি পেতে পারে।