প্রাথমিকের ‘ক্ষুদে ডাক্তার’, সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রমের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ডাক্তারের ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মানসিকতা প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা খুব অল্প বয়সেই এই শিশুদের মনে তৈরি করা হয়ে যায়।

দিপন দেবনাথদিপন দেবনাথ
Published : 16 Oct 2023, 04:10 AM
Updated : 16 Oct 2023, 04:10 AM

অসম্ভব মায়াবী সব চোখ অথচ ভ্রু কুঁচকানো গম্ভীর মুখ। চিকিৎসকদের মতো সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে। কারও কারও অ্যাপ্রোনের বোতাম আবার উঁচু-নিচুভাবে লাগানো। গোটা পনের ছাত্র-ছাত্রী। বয়স কারও ৯, কারও ১০। জানা গেল, এরা তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কেউ দেয়ালের সাথে সাঁটানো উচ্চতা মাপার স্কেল দিয়ে সহপাঠীর উচ্চতা মাপছে, কেউ দূর দেয়ালে ঝোলানো আই-চার্ট অক্ষর দেখিয়ে দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করছে আবার কেউ কেউ ওজন মাপার মেশিনে ওজন মাপছে। এমন সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে পেলাম সিংগাইর উপজেলার গোলাইডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করতেই সমস্বরে সকলে গলা উঁচু করে বলল, ‘আমরা ক্ষুদে ডাক্তার’। মন কৌতুহলোদ্দীপ্ত আনন্দে ভরে উঠল। হঠাৎ করেই মনে হলো, একঝাঁক তরুণ চিকিৎসক মানবসেবার ব্রত নিয়ে বেড়ে উঠছে এই শিশুদের মধ্য দিয়ে যারা শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থায় নয় আগামীর বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুগান্তর ঘটাবে।

‘ক্ষুদে ডাক্তার’ বর্তমান সরকারের উদ্ভাবনী ভাবনার চমৎকার এক ফসল। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অংশ হলো ফাইলেরিয়াসিস নির্মূল ও কৃমি নিয়ন্ত্রণ। ২০১১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে কৃমি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে উদ্ভাবন করা হয় এই ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে কৃমি নিয়ন্ত্রণ, জলাতঙ্ক, ম্যালেরিয়া, পুষ্টিহীনতা, ভিটামিন এ-প্লাস ক্যাম্পেইন, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা বিষয়ে শিক্ষা প্রদানসহ শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সহপাঠীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়।

শুরুর দিকে শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘ক্ষুদে ডাক্তার’ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০১৮ সাল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ক্ষুদে ডাক্তার কর্মসূচি চালু করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে এ কার্যক্রম চালানো হয়ে থাকে। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি)-এর তথ্যমতে সহপাঠীদের মাধ্যমে শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে সারাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় রয়েছে ২৩ লাখ ৫০ হাজার ‘ক্ষুদে ডাক্তার’ যাদের বয়স ৫ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। এই কার্যক্রম শুরুর আগেই প্রতিটি বিদ্যালয়ে উচ্চতা মাপার ফিতা, দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার চার্ট (আই চার্ট) এবং ওজন মাপার মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে।

।সাধারণত বছরে দু-বার জাতীয় কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহে শিশুদের কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো এবং স্কুলের অন্য বাচ্চাদের উচ্চতা, ওজন, আই টেস্ট করাসহ ক্ষুদে ডাক্তাররা অন্যান্য স্বাস্থ্যশিক্ষা দিয়ে থাকে। বছরব্যাপী ভ্যাকসিনেশনে সহায়তা করাসহ যেকোনো ধরনের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কর্মসূচিতে তারা কাজ করে। পরবর্তীতে সাপের কামড়কে ক্ষুদে ডাক্তার কর্মসূচির আওতায় আনা হবে মর্মেও জানা গিয়েছে। সাপে কামড় দিলে কী করণীয়, কোথায় গেলে চিকিৎসা পাবে তা ক্ষুদে ডাক্তাররা সহপাঠীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জানাবে।

বিদ্যালয়ের প্রতি শ্রেণি থেকে তিনজন ক্ষুদে ডাক্তার নির্বাচন করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ক্ষুদে ডাক্তার বাছাই করা হয়। একজন শ্রেণিশিক্ষক বা তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকের মাধ্যমে তাদের কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত করা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরুর দুই থেকে তিনদিন আগেই প্রতিটি টিম যার যার নির্ধারিত ক্লাসে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা দেয়। এরপর সপ্তাহব্যাপী শ্রেণিভিত্তিক সকল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তারা শ্রেণিভিত্তিক মোট শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীদের গড় ওজন, উচ্চতা এবং অস্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রণয়ন ও সংখ্যা নির্ণয় করে। এই তথ্যসমূহ নির্ধারিত ফরমে লিপিবদ্ধ ও বিদ্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় ক্ষুদে ডাক্তারদের মাধ্যমে ‘সকাল বিকাল মাজব দাঁত, রোগ জীবাণু করব কাত’ বা এরকম বিভিন্ন বার্তা প্রচার করে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন করা হয়।

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রমের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ডাক্তারের ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মানসিকতা প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা খুব অল্প বয়সেই এই শিশুদের মনে তৈরি করা হয়ে যায়। তারা অন্যের প্রতি সহমর্মী হতে শেখে। শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। দলগতভাবে কাজ করতে গিয়ে তারা খুব অল্প বয়সেই নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করে।

বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্ব সমাজে টিকে থাকার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ সমাজ তৈরির কোনো বিকল্প নেই। আর বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায় থেকে ক্ষুদে ডাক্তারের মতো কার্যক্রম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া শ্রেণিকক্ষ বা স্কুলের আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, সহপাঠীদের যেকোনো অসুবিধায় এগিয়ে আসা, একে অপরের খোঁজ রাখাসহ বিভিন্ন সামাজিক দায়বদ্ধতায় নিজেদের সম্পৃক্ত করার মানসিকতা তৈরির জন্য ক্ষুদে ডাক্তারের মতো আরও কিছু সহশিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।