ভূ-গর্ভস্থ না ভূ-উপরিস্থ: পানির নীতিগত ব্যবহার

জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ প্রথমবারের মতো পালিত হয় বিশ্ব পানি দিবস। ১৯৯৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল, পানি সম্পদ সুরক্ষা সকলের দায়িত্ব। প্রতিবছরের মতো ২০২৩ সালেও দিবসটি পালিত হচ্ছে এবং এবারের প্রতিপাদ্য ‘নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি’। আমরা কি সেই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করতে তৎপর?

পাভেল পার্থপাভেল পার্থ
Published : 22 March 2023, 01:14 PM
Updated : 22 March 2023, 01:14 PM

এখনও বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানি না পেয়ে কৃষক আত্মহত্যা করছেন। অথচ জাতিসংঘের ১৭টি টেকসই লক্ষ্যমাত্রার একটি সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকেও এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। আর মাত্র ৭ বছর। উপকূলে পানির জন্য বাড়ছে দ্বন্দ্ব। চিম্বুক পাহাড়ে এক কলস পানির জন্য ভোর রাত থেকে অপেক্ষা করার নিদারুণ যাতনা সইতে হচ্ছে। নগরের বস্তিতে প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে পানিযন্ত্রণার মিছিল। তাহলে কীভাবে আমরা পানি সুরক্ষার লক্ষ্য অর্জন করব? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী এখনো দেশের ৪১ ভাগ মানুষের সুপেয় পানির অধিকার নিশ্চিত হয়নি। সরকারি ২০ লাখ ও বেসরকারিভাবে স্থাপিত দেড়কোটি গভীর-অগভীর নলকূপ প্রতি দশজনের জন্য একটি নলকূপ পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে (জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর)। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ অনুযায়ী দেশের তিন ভাগের একভাগ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ প্রথমবারের মতো পালিত হয় বিশ্ব পানি দিবস। ১৯৯৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল, পানি সম্পদ সুরক্ষা সকলের দায়িত্ব। প্রতিবছরের মতো ২০২৩ সালেও দিবসটি পালিত হচ্ছে এবং এবারের প্রতিপাদ্য ‘নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি’। আমরা কি সেই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করতে তৎপর? কারণ, প্রতিনিয়ত দেশের পাবলিক জলাধার খুন হচ্ছে। মাটির তলার পানি উধাও হচ্ছে। ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পানি দশক, ২০০৮ সালকে আন্তর্জাতিক পয়ঃনিষ্কাশন বর্ষ ও ২০১৩ সালকে আন্তর্জাতিক পানি সহযোগিতা বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে দেশ-দুনিয়ায় পানির সংকট কাটেনি। বরং প্রতিদিন পানিযন্ত্রণা নিষ্ঠুর ও প্রবল হচ্ছে। এখনও দেশের পাহাড় থেকে সমতল, চর থেকে হাওর, বরেন্দ্র থেকে অরণ্য, গড় থেকে সমতল, নদী থেকে দ্বীপ– এক প্রবল পানিহীনতায় তড়পাচ্ছে। জীবনের মৌলিক শর্ত পানি আজ নানা শর্তে অধরা হয়ে উঠছে। করপোরেট বোতলে বোতলে বন্দি হচ্ছে পানীয় জল। প্রাকৃতিক পানির আধার দখল ও দূষণে বিলীন। কেবল মানুয় নয়; গাছপালা বা গবাদি প্রাণী কী বন্যপ্রাণী সবার জীবন থেকেই ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে পানি। পানির নীতিগত ব্যবহারকে তৎপর করবার দাবি জানিয়ে চলতি আলাপে সবুজবিপ্লব পরবর্তী সেচব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক রাজনীতির মাধ্যমে পানিহীনতার বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করবো।

সেচের পানি বঞ্চনা ও কৃষকের আত্মহত্যা

জমিতে সেচের পানি না পাওয়ায় ক্ষোভে-দুঃখে দুই সাঁওতাল কৃষক আত্মহত্যা করেছিলেন বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে। ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ঈশ্বরীপুর গ্রামে। অভিনাথ মার্ডি বরেন্দ্রর অন্যসব সাঁওতাল পরিবারের মতোই কার্যত এক ভূমিহীন পরিবার। আত্মহত্যা বিষয়ক বহু গবেষণা জানাচ্ছে, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও অন্যান্য পেশার চেয়ে কৃষকরাই আত্মহত্যার ঝুঁকিতে বেশি থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)’ ২০২০ সালে প্রকাশিত গবেষণাতেও জানাচ্ছে, অন্যান্য পেশাজীবীর চেয়ে কৃষিপেশায় আত্মহত্যা বেশি। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ১৯৮০ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দেড় হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। অষ্ট্রেলিয়াতে চার দিনে একজন, যুক্তরাজ্যে সপ্তাহে একজন এবং ফ্রান্সে দুই দিনে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেন। ভারতের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেবে ১৯৯৫ থেকে প্রায় তিন লাখ (২,৯৬৪৩৮ জন) কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দেখা গেছে মহারাষ্ট্র, উড়িষা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট এবং ছত্রিশগড়ে কৃষকের আত্মহত্যার পরিস্থিতি ও প্রবণতা বেশি। এমনকি বাংলাদেশেও আত্মহত্যার খতিয়ানে কৃষকদের সংখ্যাই বেশি। ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশান অ্যান্ড রিসার্চ’ ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া আত্মহত্যার প্রায় ৫৫ ভাগই কৃষক বা কৃষিশ্রমিক। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এত কৃষক আত্মহত্যা কেন? ভারতে কৃষক আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান বিষয়ে বহু গবেষণায় দেখা গেছে ফসলহানি, ঋণের বোঝা, বিটিতুলার মতো জেনেটিক ফসল চাষ, খরা, দূরারোগ্য ব্যাধি, কন্যাদায়গ্রস্থতা, পারিবারিক কলহ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে আত্মহত্যা হয়ে থাকে। ডংগ্রি ও দেশমুখ মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে কৃষক আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দুর্বল সেচব্যবস্থাকেও দায়ী করেছেন ( দেখে নিতে পারেন : জার্নাল অব ইনজুরি অ্যান্ড ভায়োলেন্স রিসার্চ, জানুয়ারি ২০১২, ৪/১, পৃ.২-৫)। অনাবৃষ্টি, খরা ও দুর্বল সেচব্যবস্থার কারণে ফসলহানি হয়, ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরে কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। পি ঘোষ (২০১৩), আর গাগদেকার (২০১৩), এস সোয়াইন ও অন্যান্যরা (২০১৭) কৃষক আত্মহত্যার পেছনে থাকা এমন কারণগুলো খুঁজে বের করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও খরার কারণে ১৯৮৩ এবং ১৯৮৮ সালে কৃষকের আত্মহত্যা বেড়েছিল। বাংলাদেশে সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার পেছনে পানিবঞ্চনাই কারণ হিসেবে বিবৃত করছেন তাদের পরিবার ও সমাজ।

সেচব্যবস্থাপনা, ক্ষমতা ও বাজারের রাজনীতি

কৃষি, মৎস্য, শিল্প, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য ও বন্দরসহ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতগুলোর উন্নয়নে বা মোটাদাগে মোট দেশজ উৎপাদনে পানির ভূমিকা অপরিহার্য। দৈনন্দিন ভোগ, সেচ, যোগাযোগ এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পানির ওপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক পানির উৎস তথা বৃষ্টিপাত ও ভূ-উপরিস্থ পানির উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের আদি সেচব্যবস্থা। প্রাচীন মিশরে নীল নদ এবং ফাইয়ুমের লেক থেকে পানি ব্যবহার করে আদি প্রাকৃতিক সেচ ব্যবস্থাপনা শুরু হলেও আজ যন্ত্রনির্ভর সেচের আওতা ছড়িয়েছে অন্যান্য অঞ্চলে। এক হিসাবে দেখা যায়, পৃথিবীর সেচকৃত মোট জমির (২১ কোটি ৯৭ লাখ ৪৯ হাজার থেকে ২৫ কোটি হেক্টর) প্রায় অর্ধেক জমি ভারত, পাকিস্থান, চীন এবং বাংলাদেশে। তো এই যন্ত্রনির্ভর সেচ কীভাবে দেশব্যাপী বিস্তৃত হলো, নাকি পরিকল্পিতভাবেই করা হলো? বর্তমান বাংলাদেশের কৃষি সম্পূর্ণটাই যন্ত্রনির্ভর সেচের উপর নির্ভরশীল এবং এখানে মূলত ভূ-গর্ভস্থ পানিই ব্যবহৃত হচ্ছে। ষাটের দশকে শুরু হওয়া তথাকথিত সবুজবিপ্লব প্রকল্পের মাধ্যমে চালু হলো পাতালপানিকে যন্ত্র দিয়ে টেনে তুলে সেচ দেয়ার এই নিদারুণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি কেবল করপোরেট মুনাফার বাজারকেই চাঙ্গা ও জায়েজ করেনি, বরং প্রত্যক্ষ কি পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন এবং সম্পর্ককে বদলে দিল।

বিশ্বব্যাংকের (২০০৫) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের জাতিসংঘের কারিগরি মিশনের ফলাফল হিসেবে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১৯৬৪ সালে পানি বিষয়ক এক মহাপরিকল্পনা তৈরি হয়। বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ১৯৫০ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার পানিসম্পদ স্কিম গ্রহণ করা হয়, যার অধিকাংশই শস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং প্রায় এক হাজার হেক্টর থেকে ১০ হাজার হেক্টর এলাকার কৃষিকে প্রভাবিত করে। এসব প্রকল্প বন্যা নিয়ন্ত্রণ, খাল, সেচ কাজসহ নদীতীর রক্ষা ও নদী খননের সঙ্গে জড়িত ছিল। বাংলাদেশে গ্রামীণ অঞ্চলে পানিব্যবস্থাপনা, মওসুমভিত্তিক বন্যা ব্যবস্থাপনা, লোকায়ত সেচপ্রযুক্তি, অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণ কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলে কনকনা পদ্ধতির মাধ্যমে লবণাক্ততার ভেতর মিষ্টিপানির ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সুপ্রাচীন। ১৯৫৪ সালে এ অঞ্চলে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যার পর জাতিসংঘের ক্রুগ মিশন পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরির সুপারিশ করে এবং ১৯৫৯ সালে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্থান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (তৎকালীন ইপিওয়াপদা, আজকের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড)’। পরে মার্কিন সহায়তায় ১৯৬৪ সালে ২০ বছর মেয়াদী পানি উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা তৈরি হয়। এই মহাপরিকল্পনা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেড়িবাঁধ, সেচ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ ও পোল্ডার নির্মাণের তীব্র সুপারিশ করে। এই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেচপ্রকল্প পরিচালিত হয়। ১৯৬৪ সালে ‘আন্তর্জাতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাংক (আইবিআরডি) মিশন’ ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্পের ওপর অগ্রাধিকারমূলক কৌশল গ্রহণের প্রস্তাব করে। ১৯৭০ সালে বিশ্বব্যাংকের যৌথমিশনের মাধ্যমে জাতীয় পানি পরিকল্পনার সুপারিশ হয়। ১৯৮৩ সালে এর কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮৭ সালে জাতীয় পানি পরিকল্পনা সম্পন্ন হয় এবং ১৯৯২ সালে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) গঠিত হয়। ১৯৮৭-১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর বন্যা কর্ম পরিকল্পনা জোরদার হয় এবং ১৯৯৬ সালে বন্যা পরিকল্পনা সমন্বয়কারী সংস্থা ও ওয়ারপো একীভূত হয়। ১৯৯৯ সনে জাতীয় পানি নীতি প্রণীত হয়।

প্রথমদিকে একেবারেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে কোনো এলাকায় বড় আকারের জমির জন্য সেচযন্ত্র বসানো হতো এবং কৃষকদের সেচের পানি ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত চাষে অভ্যস্ত করে তোলা হতো। কারণ প্রথমদিকে পাতালপানিকে যন্ত্র দিয়ে তুলে কৃষিকাজে ব্যবহার করবার বিষয়টি স্থানীয় কৃষকদের জন্য ছিল একেবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা। এটি তাদের কাছে এক ধরনের কৃষিগত সাংস্কৃতিক আঘাতও ছিল। পরবর্তীতে সেচখাতকে বেসরকারিকরণ করা হয় এবং ক্ষুদ্রসেচ যন্ত্র আমদানি করা হয়। গ্রামেগঞ্জে এসব সেচযন্ত্র নষ্ট হলে মেরামতের জন্য কিছু স্থানীয় কারিগর ও কারখানা গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সেচযন্ত্র একেবারেই এক অনিবার্য উপকরণ হয়ে ওঠে এবং গ্রামে-গঞ্জে এই যান্ত্রিক সেচ ঘিরে নানা ধরনের বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানও গড়ে ওঠে।

ভূ-গর্ভস্থ না ভূ-উপরিস্থ: পানির সিদ্ধান্ত কার?

১৯৫৯-৬০ সালে মোট কৃষিজমির প্রায় ৭ ভাগ জমি প্রচলিত সেচের আওতায় ছিল। বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চল এবং রাজশাহীর মতো বরেন্দ্র অঞ্চলে শুষ্ক মওসুমে বোরো আবাদের জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি প্রচলিত সেচের জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু দিনে দিনে যন্ত্রনির্ভর ভূ-গর্ভস্থ সেচ বেড়েছে এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এক বিশাল বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বহু প্রমাণ আছে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহারকে মূলত বৈধ করেছে বিশ্বায়িত ক্ষমতা কাঠামো। বহুপাক্ষিক ব্যাংক ও করপোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষিপ্রকল্প ও গবেষণাগুলো ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহারকে নানাভাবে বৈধ করছে, যাতে ভূ-গর্ভস্থ সেচব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি বিশাল আকারের পুঁজিবাজার তরতাজা থাকে। মাটি, কৃষি বা মানুষ নয়; এই যন্ত্রনির্ভর সেচব্যবস্থাপনার অন্যতম লক্ষ্য হলো মুনাফা।

কেবল পাতাল পানি নয়; আছে উজান-ভাটির পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রিক বিবাদ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, উজান থেকে পানিপ্রাপ্তি হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় উত্তরোত্তর পানিসংকট তৈরি হয়ে এখানকার ফসলের উৎপাদন ও মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্যে প্রভাব ফেলছে। তিস্তা, গঙ্গা, কুশিয়ারার মতো অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও সেচকাজে এর ব্যবহার কেবল কোনো গ্রামের কোনো একজন কৃষক সিদ্ধান্ত নিতে পারে কী? এখানে রাষ্ট্রপক্ষের ভেতরেই রাজনৈতিক দরবার জারি আছে। তাহলে কৃষক সেচের পানি পাবে কোথায়?  

বৃষ্টির পানির ওপরও আর নির্ভর করা যাচ্ছে না। কারণ ফসলের মওসুম ও ঋতুকাল বদলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত আছে। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, অনিয়মিত বৃষ্টি বাড়ছে। বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ জীবনযাত্রা খরার কারণে মারাত্মক সমস্যায় পড়ছে এবং এতে গ্রামীণ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত এক বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে।

পানির নীতিগত ব্যবহার

কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা পানিসহ সকল প্রাণ ও বাস্তুতন্ত্রের এথিক্যাল বা নীতিগত ব্যবহার ও সম্পর্ককে বিবেচনা করে। খনার বচন, মৈমনসিংহ গীতিকা, চাকমা গেংখুলি-ধনপুদিপালা, মান্দি আজিয়া-রেরে কিংবা দেশের ক্ষয়িষ্ণু লোককথা ও কৃষি বিশ্বাসগুলো পাঠ করলে বোঝা যায় পানি আমাদের কাছে এক পবিত্র বিষয়। পাতাল, ভূমি, আসমান ও কল্পনা এই চারতলে পানি প্রবাহিত হয়। গ্রামীণ সমাজ বহু লোকায়ত জ্ঞানের ভেতর দিয়ে কৃষিকাজে পানির এথিক্যাল ব্যবহারের চর্চা করেছিল। এখনো গ্রামীণ নারীরা মাছ কাটাবাছা ধোয়ার পর সেই পানি লাউ-কুমড়া গাছের গোড়ায় ঢালেন কিংবা জমিনে সেচের জন্য যত ধরনের লোকায়ত সেচযন্ত্র আছে তা পানির অপচয় রোধে সজাগ থাকে। যন্ত্রচালিত সেচের ক্ষেত্রে পানির এথিক্যাল বা নীতিগত ব্যবহার মনস্তাত্ত্বিকভাবেই অস্বীকার করা হয়।

পঞ্চাশের দশকে আমরা গণমাধ্যম, বিদ্যায়তন কী পাবলিক পরিসরে একটা যন্ত্রণাকর প্রত্যয় শুনিনি, ‘পানিসংকট’। সবুজবিপ্লব প্রকল্পের পর থেকে গত ত্রিশ বছর ধরে এই শব্দের ব্যবহার ও মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আমরা এখন এই শব্দের দ্যোতনা ও এর কতধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারি নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে প্রতিজনই এটি বুঝতে পারি। জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক বিভাগের (ইউএনডিইএসএ ২০০৫) মতে পানিসংকট যৌথভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট ঘটনা।

যান্ত্রিক সেচের মাধ্যমে আমরা বহু পাতাল পানির অপচয় করেছি। বিষয়টি যান্ত্রিক সেচ প্রতিষ্ঠার অনেক পরে আমারা বোঝার চেষ্টা করেছি। যদিও প্রথমদিকে সেচপ্রকল্প শুরু হওয়ার সময় পানির অপচয় বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পানির নীতিগত ব্যবহার মানে সবস্তরের সব পানির জন্যই প্রযোজ্য। ভূ-গর্ভস্থ বা ভূ-উপরিস্থ নয়। ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎসকে বাদ দিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির অপচয় যদি একইমাত্রায় হতে থাকে সেটিও আমাদের সংকটের মুখোমুখিই দাঁড় করাবে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার ও মাটিতে পানি পুনর্ভরণের লোকায়ত সব প্রযুক্তি ও প্রথাকে স্বীকৃতিসহ মূলধারার সেচব্যবস্থাপনায় যুক্ত করতে পারলে আমরা আমাদের সেচচিন্তাকে প্রসারিত করতে পারব। যন্ত্রনির্ভর সেচের ওপর চাপ কমাতে শস্য বহুমুখীকরণ, বিকল্প শস্য, কমসেচ নির্ভর কৃষি, ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার, রবিশস্যের প্রসার এরকমের প্রস্তবনা, গবেষণা ও মাঠে কৃষকের বহু চলমান কাজও আছে। এমনকি কেবল বোরো মওসুমে ধানচাষে সেচকে গুরুত্ব দেয়া হয় এবং আউশ-আমন এবং অন্যান্য রবিশস্যের ক্ষেত্রে সেচকাজ বিবেচনায় থাকে না। শস্যবহুমুখীকরণেও সেচব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বিষয়ে বহু আলোচনা আছে। পরিবেশ ও জনমুখী সেচব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সকল পক্ষের সিদ্ধান্ত, গবেষণা, তর্ক, চর্চা, ঐক্য ও সংহতি দরকার।