সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত: মধ্যবিত্তের অসহায় দীর্ঘশ্বাস

Published : 29 Sept 2021, 12:03 PM
Updated : 29 Sept 2021, 12:03 PM

'সঞ্চয়পত্র' বাঙালির দৈনন্দিন অর্থনৈতিক জীবনে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকা একটি নাম। মোটাদাগে বলতে গেলে, বাংলাদেশ জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীনে জনগণকে সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করা ও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে আহরণের উদ্দেশে এবং সাধারণের নির্ঝঞ্ঝাট অর্থ বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করার অন্য নাম সঞ্চয়পত্র। বৃহত্তর দৃষ্টিকোণে, সাধারণ মানুষের হাতে জমানো টাকা লম্বা সময়ের জন্য ফেলে না রেখে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগে মুনাফা লাভ, দেশের বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী যেমন- নারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, প্রবাসী বাংলাদেশী এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসার সুযোগ এবং সরকারের সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে আহরিত অর্থ দ্বারা জাতীয় বাজেট ঘাটতি পূরণ করার সুযোগ।

সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সিদ্ধান্তের পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। এ সঞ্চয়পত্রকে ঘিরে এত আলোচনা-সমালোচনা হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে এ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিশ্চিত এবং নিরাপদ বিনিয়োগ। নিশ্চিত এবং নিরাপদ বিনিয়োগ হওয়ার কারণে সঞ্চয়পত্র সব শ্রেণির মানুষের কাছে বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় আর্থিক পণ্যএই কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, দেশের মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের বড় অংশই হয় ব্যাংকে, না হয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়। দেশের সঞ্চয়ী মানুষের একটা বড় অংশই সঞ্চয়পত্রে টাকা রেখে সেই মুনাফার টাকায় জীবনধারণ করেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং অবসরে যাওয়া লোকজন। স্বভাবতই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর সিদ্ধান্ত সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 

সঞ্চয়পত্রের ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা, অনলাইন ব্যবস্থাও চালু করা, একক ও যৌথ নামে সর্বোচ্চ কত টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে তার সীমা নির্ধারণ প্রভৃতি ব্যবস্থা প্রচলনের পরেও সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর খড়্গ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশকে হতবিহ্ববল করেছে। 

এর আগে গত বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়। স্বভাবতই এর প্রভাব পরে আমানতের সুদহারেও। গত জুলাই শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার কমে ৪ শতাংশে নেমে আসে কোনও কোনও ব্যাংকে আমানতের সুদহার ২ শতাংশে নেমে আসেঅন্যদিকে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকে টাকা রেখে সাধারণ মানুষ আসলে কোনো মুনাফা পান না। বরং টাকার মান কমে। এ পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনে আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে জ্বলেছিল সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। সেই মুনাফার ওপর খড়্গ মানুষের আশারআলোক বর্তিকার ঔজ্জ্বল্য একেবারেই ম্লান করে দিয়েছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর এ খড়্গ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনে বয়ে এনেছে ঘোর অমানিশার আমাবস্যার রাত

কিন্তু কেন এ অবস্থা? মানুষ কেন অকুলপাথারে পড়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে কোন শ্রেণির মানুষকে সরকারের এ সিদ্ধান্ত বেশি হতাশাগ্রস্ত করেছে? কোন শ্রেণির মানুষের ওপর বেশি প্রভাব পড়েছে? এ কথার উত্তর খুঁজলে আমরা দেখতে পাবো মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদের অনেকেই হয়ত গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে কিংবা অবসর প্রাপ্ত চাকরিজীবী যারা পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা বিনিয়োগ করেছে এ সঞ্চয়পত্রে। এ দুই শ্রেণির মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভর করতো। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর খড়্গ এ দুই শ্রেণির মানুষের জীবনকে বিভীষিকাময় করে দিয়েছে। এমন এক সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যখন করোনা মোকাবেলায় সারাদেশের জনগণ হিমশিম খাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) যৌথ গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে নতুন করে দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। আর চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন দেশের মোট শ্রমশক্তির তিন শতাংশেরও বেশি মানুষ। যখন মানুষ করোনার ধাক্কা মোকাবেলা করতে গিয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে, যখন মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে ঠিক, সেই সময় তার শেষ সম্বল সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর খড়্গ! এ যেন মানুষের জীবনে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।

বিকল্প পথের সন্ধান না দিয়ে কিংবা বিকল্প পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে কতটুকু মানবিক হয়েছে? সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। মানুষের কাছে আসলে এ মুহূর্তে বিনিয়োগের বিকল্প খাত কি রয়েছে? যদি শেয়ার বাজারের কথা ধরা হয়, তাহলে এ শেয়ার বাজার নিয়ে আমাদের জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতার শেষ নেইশেয়ার বাজারকে কেন্দ্র করে কত লোক পথে বসেছে তার ইয়ত্তা নেই। স্বয়ং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে শোনা শেয়ার বাজারকে কেন্দ্র করে সেই সব বিশেষণ তথা 'জুয়া খেলা' আবার কখনও 'ফটকা বাজার' প্রভৃতি মানুষের স্মৃতিতে এখনো সমুজ্জ্বল। আর যদি ফাইন্যান্স কোম্পানির কথা বলি তাহলে ফাইন্যান্স কোম্পানিকে কেন্দ্র যে লুটপাট হয়েছে তা রীতিমত বিভীষিকাময়। প্রশাসক নিয়োগ করেও লুটপাটের একটি টাকাও উদ্ধার করা যায় নি। 

এত দিন সঞ্চয়পত্র কেনা হলে প্রথমে একবার অগ্রিম কর দিতে হত। পরবর্তীতে সেই সঞ্চয়পত্রের টাকা ব্যাংকে যাওয়া মাত্র ওই অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ যদি ১ লাখ টাকার ওপর হয় তাহলে আরেকবার আবগারি শুল্ক, পরবর্তিতে বছর শেষে আবার ব্যাংক প্রদত্ত মুনাফার ওপর কর দেওয়ার বিধান ছিল। মোটামুটিভাবে এক মুরগি তিনবার জবাই করার মতো অবস্থা। কিন্তু এত কিছুর পরেও যে টাকাটা হাতে পাওয়া যেত তা দিয়ে করোনাকালে অনেকেই জীবন ধারণ করে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো মধ্যবিত্তের জীবনে নেমে এলো এ অর্থনৈতিক আঘাত।

মজার বিষয় হচ্ছে যে, 'উচ্চবিত্ত সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ভোগ করে' এই দোহাই দিয়ে যারা মুনাফা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা হয়তো ভুলে গেছেন গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর গড়ে ৬৫১ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে। এই পাচারের সাথে জড়িত অবশ্যই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি নয়। এই পাচার পুরোটাই করে ধনিক এবং নব্য ধনিক সমাজের মানুষেরা। কাজেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা নিয়ে উচ্চবিত্ত খুব একটা চিন্তা করে বলে মনে হয় না । বরং দেশে কিংবা বিদেশে, নামে কিংবা বেনামে বিভিন্ন পন্থায় তারা তাদের বিনিয়োগের একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে।

রাষ্ট্রের কাজ শুধু ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা কিংবা নব্য ধনিক শ্রেণি তৈরি নয়। অথবা রাষ্ট্রের কাজ সবসময় নিজেকে লাভ-ক্ষতির হিসেবে আবদ্ধ করা নয়। বরং রাষ্ট্রের উচিৎ তার সকল শ্রেণির নাগরিকের প্রতি মানবিক আচরণ করা। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীলকণ্ঠী পাখির মত দারিদ্র নামক বিষ হাসিমুখে হজম করে জীবন সংগ্রাম অবিরত চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য বিকল্প বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত না করে, তাদের হাতের পাঁচ সঞ্চয়পত্রের ওপর মুনাফা কমানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ।