মহামারীকালে সঞ্চয় ভাঙছে মানুষ

দীর্ঘদিনের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে বছর দুয়েক আগে দশ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন গৃহিনী ফরিদা আক্তার। স্বামীর বেতনের সঙ্গে প্রতি মাসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বাবদ ৮ হাজার ৬৪০ টাকা যোগ হওয়ায় তাদের পাঁচজনের পরিবার মোটামুটি মসৃণভাবেই চলছিল। কিন্তু তাতে বাধ সেধেছে করোনাভাইরাসের মহামারী।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2020, 03:59 PM
Updated : 19 July 2020, 05:07 PM

ফরিদার স্বামী বজলুর রশীদ কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুমাস ধরে তার বেতন বন্ধ। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বাসবোর যে বাসায় তারা থাকেন, তার ভাড়া দিতেও এখন হিমশিম অবস্থা। 

সংসারের খরচ চালাতে ফরিদাকে তাই হাত দিতে হয়েছে সঞ্চয়ের টাকায়।

সঞ্চয়পত্রের দশ লাখ টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা তুলে ফেলার জন্য গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছিলেন মধ্যবয়সী এই নারী। সেখানেই তার সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়।

ফরিদা বলেন, “কি আর করব ভাই, এখন আর চলছে না। করোনাভাইরাস সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। মেয়াদ পূরো হওয়ার আগেই পাঁচ লাখ টাকা ভেঙে ফেললাম।”

ফরিদা আক্তারের মত অনেকেই এখন সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ভেঙে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। আবার যারা কয়েক মাস আগেও সংসার খরচ থেকে জমানো টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার কথা ভাবছিলেন, সেই টাকা তাদের খরচ করে ফেলতে হচ্ছে জরুরি প্রয়োজনে।

বৃহস্পতিবার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, এই মহামারীর মধ্যেও বিপুল সংখ্যক মানুষ মুখে মাস্ক পড়ে ভিড় জমিয়েছেন সঞ্চয়পত্রের কাজের জন্য।

তাদের কেউ মাসের মুনাফার টাকা তুলতে এসেছেন, অনেকে এসেছেন বিনিয়োগ করার টাকা ভাঙ্গানোর আবেদন জমা দিতে। কেউ আবার আগে আবেদন করার টাকা তুলতে এসেছেন। খুব কম মানুষই নতুন সঞ্চয়পত্র কিনছেন।

শুধু সঞ্চয়পত্র নয়, এই মাহামারীকালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপোজিট প্লাস স্কিম (ডিপিএস) ও ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) ভেঙেও সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন অনেকে। পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দায় তলানিতে নেমে আসা শেয়ার কেউ কেউ বড় লোকসানে দিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন কিছু নগদ টাকা হাতে রাখার জন্য।

ডাচ-বাংলা ব্যাংকে পাঁচ বছর মেয়াদী একটি ডিপিএস খুলেছিলেন ব্যবসায়ী আব্দুল হাই টুটুল। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে জমা রাখতেন। দুই বছর পার করে এখন আর তিনি সেই টাকা টানতে পারছে না। মহামারীর মধ্যে ব্যবসা প্রায় বন্ধ। সেই ডিপিএস তিনি ভেঙে ফেলেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে টুটুল বলেন, “ব্যবসা নেই; আয়-রোজগার নেই। সংসারই চালাতে পারছি না। আবার ডিপিএসের টাকা জমা দেব কি করে। এখন ভেঙে ফেললাম। পরে ব্যবসা ভালো হলে আবার খুলব।”

ব্যাংকের বাইরে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফডিআরে ভালো মুনাফা দিয়ে থাকে। সেজন্য ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে (ডিবিএইচ) পাঁচ লাখ টাকার একটি এফডিআর খুলেছিলেন ঢাকায় একটি বায়িং হাউজে কর্মরত ফখরুল ইসলাম।

মার্চের শেষে সরকারি ঘোষণায় অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন ফখরুল। কয়েকদিন আগে অফিস থেকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ব্যবসা নেই; অফিসে আর আসতে হবে না।

এই বিপদের মধ্যে এফডিআর ভাঙাতে রোববার ঢাকায় এসেছেন ফখরুল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কি আর করব, চাকরিটা চলে গেল। এখন সঞ্চয় যা আছে, সেটা ভাঙিয়েই তো চলতে হবে।”

২০১৬ সালের শেষ দিকে পুঁজিবাজারে দশ লাখ টাকার মত বিনিয়োগ করেছিলেন গোবিন্দ্র চন্দ্র দাশ। সেটা এখন কমতে কমতে চার লাখে ঠেকেছে।

যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গোবিন্দ চাকরি করেন, তারা এখনও বিদায় করে দেয়নি। তবে বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে লোকসানে থাকা শেয়ারগুলোই বিক্রি করে দিতে হয়েছে গোবিন্দকে।

“কিছুই করার নাই রে ভাই, মরার উপর খাঁড়ার ঘা। দশ লাখ টাকার শেয়ার চার লাখ টাকায় বিক্রি করে দিতে হল।”

ব্র্যাক, ডেটা সেন্স ও উন্নয়ন সমুন্বয় গত জুনের শুরুতে একটি যৌথ সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, চলমান করোনাভাইরাস মহামারীতে দেশের মানুষের পারিবারিক উপার্জন গড়ে ৭৪ শতাংশ কমে গেছে। অর্থাৎ, আগে যে পরিবার ১০০ টাকা আয় করত, এখন সেখানে আয় হচ্ছে মাত্র ২৬ টাকা।

১৪ লাখের বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন কিংবা ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন বলেও উল্লেখ করা হয় ওই গবেষণায়।

সামগ্রিকভাবে এই সঙ্কটের সময় ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ কমেছে জানিয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহেল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় সব মানুষেরই আয় কমে গেছে। চাকরিও হারিয়েছেন অনেকে। বাধ্য হয়ে তারা এখন সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন।

“অনেকে আবার এক ধরনের আতঙ্কের কারণে টাকা তুলে কাছে রাখছেন। বিশেষ করে যে সব ব্যাংকের অবস্থা একটু খারাপ, সেসব ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছেন। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর আমানত কমেছে।”

৩০ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হলেও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর গত অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত সময়ের সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, জুলাই-মে সময়ে সব মিলিয়ে ১১ হাজার ১১ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।

সর্বশেষ মে মাসে ৪৩০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের মে মাসে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।

তার আগের মাস এপ্রিলে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার থেকে ৬৬২ কোটি টাকা বেশি সুদ-আসল বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে।

মুনাফার হার বেশি হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছিল। তাতে বাড়ছিল সরকারের ঋণ। এই পরিস্থিতিতে সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে গত অর্থবছর। পাশাপাশি টিআইএন (কর শণাক্তকরণ নম্বর) এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করাসহ কিছু শর্ত আরোপ করে। তাতে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে আসে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করা ছাড়া সরকারের উপায় ছিল না। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার এটি একটি কারণ। কিন্তু এখন মহামারীর মধ্যে বিপাকে পড়া মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে বাধ্য হচ্ছে। 

“এই কঠিন সময়ে অনেকের চাকরি চলে গেছে। কারো চাকরি থাকলেও বেতন দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠান। গরীব মানুষ সরকারসহ নানা জায়গা থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা কিছু বলতে পারছে না; বাধ্য হয়ে যেখানে সে সঞ্চয়টুকু আছে ভেঙে ফেলছে। আর যার সঞ্চয় নেই, সে পরিচিতদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছে।”