আদিবাসী ফুটবলার মেয়েরা বঞ্চনা ডিঙিয়ে যাচ্ছে

রূপনা কিংবা ঋতুপর্ণাকে কাপ্তাই বাঁধ কিংবা অপহরণ পাড়ি দিতে হয়নি। তবে পাহাড়ে জিইয়ে থাকা জনমিতির রাজনীতি, উন্নয়নের বাহাদুরি কিংবা বিপন্ন প্রকৃতির বাস্তবতাকে সামাল দিয়েই খেলার মাঠে আসতে হয়েছে।

পাভেল পার্থপাভেল পার্থ
Published : 8 August 2023, 07:03 PM
Updated : 8 August 2023, 07:03 PM

আপনাদের কী ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা মনে আছে? সেই যে নিউজিল্যান্ড। সেই যে মাওরি আদিবাসী। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল যখন নিউজিল্যান্ড পৌঁছায় তখন মাওরি আদিবাসীদের নিয়মে সকলকে অভ্যর্থনা দেয়া হয়। নাকে নাক ঘষে, জিভ বের করে সে এক অনন্য কায়দা। মাওরি তরুণদের অভ্যর্থনা নৃত্য ও রীতির সেই ছবি সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মাওরি আদিবাসীদের সাথে সংহতি জানিয়ে মুহূর্তটিকে অবিস্মরণীয় করে তুলেছিলেন।

আট বছর পর সেই মুহূর্ত কেন জানি আজ খুব মনে পড়ে। আজ আদিবাসী দিবসের ক্ষণে সেই স্মৃতি কেন জানি প্রকট হয়ে ওঠে। মনে হয়, আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশকে নিজেদের সংস্কৃতিতে বরণ করে নেয়ার জন্য বিশাল স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে আছে কিছু তরুণ ফুটবল খেলোয়াড়। রূপনা চাকমা, শিউলি আজিম, মণিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, ঋতুপর্ণা চাকমা, সোহাগী কিস্কু, আনুচিং মোগিনিসহ আরও তরুণ সম্ভাবনায় আদিবাসী ক্রীড়াবিদ। চাকমা, মান্দি বা গারো, সাঁওতাল কিংবা মারমা নিয়মে বাংলাদেশকে আদিবাসী দিবসের বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে তারা। নিজ নিজ মাতৃভাষায় তারা অভিবাদন জানাচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজকে। চারদিকে ভেসে আসছে চাকমা ভাষায় ‘ঝু-ঝু’, মান্দিদের আচিক ভাষায় ‘রিমচাকসুয়া’, সাঁওতালি ভাষায় ‘জোহার’ এবং মারমা ভাষায় ‘অগাসা’ এমন মধুরতম সব অভিবাদন। মাতৃভাষায় রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ‘বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের’ এই সাহসী মেয়েরা। কারণ রাষ্ট্র তাদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে। আকাশ-বাতাস উতল করে বাজছে চাকমা গান ‘ঝিমিত ঝিমিত জুনি জ্বলে মুর দেশত দেবা তলে এই আমা দেশ’, বাজছে সাঁওতালি গান ‘বাংলোদিশম মুজ দিশম মুজ বাহাতে পারাওকান’। আদিবাসী ভাষায় দেশপ্রেমের গান। হাতে হাত ধরে টানটান দাঁড়িয়েছেন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাগণ। তেভাগা, টংক, ফুলবাড়ি, ইকোপার্ক, বাগদাফার্ম আন্দোলনের ছলছল স্মৃতি নিয়ে সামিল হয়েছেন বহুজন। গ্লানি আর দাগ মুছে সমগ্র বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াল হার না মানা ফুটবলার মেয়েদের সাথে। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখে, একসাথে বাংলাদেশ গাইছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...’।

এবারের আদিবাসী দিবসে কেন যেন এমনই এক নিতান্ত সরল স্বপ্নছবি সামনে ভাসে। এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আদিবাসী তরুণ’। প্রতিপাদ্যটির বাংলা করা হয়েছে, ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি’। হয়তো এ কারণেই আদিবাসী ফুটবলার তরুণ মেয়েদের কথা মনে ভাসে। যারা দেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করতে খেলার মাঠে জীবনবাজি রেখে লড়ছে। কিন্তু হঠাৎ এই স্বপ্নময়তা কেন জানি চুরমার হয়ে যায়। সেই আট বছর আগের মাওরি আদিবাসীদের সাথে জাতীয় ক্রিকেট দলের সংহতির ছবিও বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। বরং জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিনই’ যেন প্রকট হয়ে ওঠে। ‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে, নিয়ে গেছে তারে; কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে, যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হল তার সাধ;’। কেন চাষের জমিনে সেচের পানি না পেয়ে অভিমানে মরিবার সাধ হয় বরেন্দ্রর দুই অভাগা সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ আর রবি মার্ডির? কেন জঙ্গল বাঁচাতে গিয়ে জান দিতে হয় মান্দি তরুণ পীরেন স্নালের? কেন পাহাড় থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় কল্পনা চাকমা? আদিবাসী জীবনের এমন সহস্র প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। আর তাই বহুজাতি ও ভাষার বাংলাদেশ সময়ে সময়ে বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। কারণ বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ ভালো নেই। নিরন্তর জন্মমাটি, মাতৃভাষা আর আপন সংস্কৃতির ময়দান থেকে তাদের উচ্ছেদ হতে হয়। এই নিপীড়ন আর বঞ্চনার ভেতরেই কেউ কেউ তরুণ ফুটবলারদের মতো আলোকশিখা হয়ে ওঠে। চলতি আলাপখানি উল্লিখিত তরুণ ফুটবলারদের ভেতর দিয়ে আদিবাসী জীবনের অমীমাংসিত কিছু প্রশ্নকে সামনে আনছে। স্বপ্ন দেখছে রাষ্ট্র একদিন এই আলোকশিখাদের নিয়ে আদিবাসী দিবসে ‘কাউকে পেছনে না রাখার’ সাহসী উচ্চারণ করবে।

অবদান কিংবা নক্ষত্রপুঞ্জ

মুক্তিযুদ্ধ আর কৃষক সংগ্রাম ছাড়া আদিবাসীদের অবদান কী? বৃহত্তর সমাজে আদিবাসী সংস্কৃতি কী ভূমিকা রাখছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘতর এবং অফুরন্ত। তারপরও মোটাদাগে বলা যায় বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডার গড়ে উঠেছে বহু আদিবাসী ভাষার শব্দপুঞ্জে। কৃষিতে মিশ্র ফসলের চাষ, শস্যবৈচিত্র্য এবং শস্য আবর্তন আদিবাসী কৃষির অবদান। জুম আবাদ, মিশ্র ফসলের বিন্যাস কিংবা খাসি পানজুম বৈশিষ্ট্যময় কৃষিচর্চার অনন্য উদাহরণ। আদিবাসী গীতবাদ্য ও পরিবেশনা শিল্পমাধ্যমকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। মণিপুরী শাড়ি, বম চাদর, চাকমা পিনন কিংবা আদিবাসী তাঁত আজ দেশের বস্ত্রখাতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আদিবাসী খাদ্যভাণ্ড জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে অবদান রাখছে। দেশের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতন্ত্র, প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রাণসম্পদ সুরক্ষায় আদিবাসীদের অবদান প্রমাণিত।

সামাজিক অবদানের পাশাপাশি ব্যক্তি হিসেবে বহু আদিবাসীজন দেশের শিল্প-সংস্কৃতি-উৎপাদন-অর্থনীতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। কেবল ক্রীড়াবিদ হিসেবে নয়, নানা ক্ষেত্রে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে বহু আদিবাসী নক্ষত্র। টংক আন্দোলনের রাশিমনি হাজং কী কুমুদিনী হাজং, তেভাগা আন্দোলনের শিবরাম মাঝি, মেহনতি মানুষের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কিংবা তীর-ধনুক নিয়ে প্রথম রংপুর ক্যান্টেনমেন্টে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কি ভুলে যেতে পারব? চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা কিংবা জয়দেব রোয়াজা; ক্রীড়াবিদ জুম্মন লুসাই; লেখক-গবেষক ও সংস্কৃতিজন মৃত্তিকা চাকমা, রাজা দেবাশীষ রায়, প্রশান্ত ত্রিপুরা, সঞ্জীব দ্রং,একে শেরাম, শুভাসিস সিনহা, মিঠুন রাখসাম, মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, পরাগ রিছিল; কারুশিল্পী মঞ্জুলিকা চাকমা; বক্সার সুরোকৃষ্ণ চাকমা; সাঁওতালি উইকিপিডিয়ান মানিক সরেন; পরিবেশবাদী অনিল ইয়ংইয়ং, জুয়ামলিয়ান আমলাই, অজয় এ মৃ কিংবা এই তালিকা নানাভাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠবে। কাঠামোগত বৈষম্যের ময়দানে দেশের তারা হয়ে ওঠা এই মানুষদের যাত্রাপথ কতটা ক্ষতবিক্ষত ছিল তা কেবল তাদের ব্যক্তিগত স্মৃতি নয়, পরিবার এবং সমাজও তাদের সেইসব দুঃসহ স্মৃতি ধারণ করে আছে।

বঞ্চনা ডিঙিয়ে করতালির মাঠে

প্রতিদিন ছিনতাই হওয়া মাঠ-ময়দানের দেশে ছেলে কিংবা মেয়ের খেলোয়াড় হয়ে ওঠা এখন এক প্রবল বিস্ময়। তার ভেতর পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন মেয়ের খেলোয়াড় হয়ে ওঠার রাস্তা নিদারুণ দুর্গম। আর সেই মেয়ে যদি কোনো আদিবাসী সমাজ থেকে আসে তবে তাকে সামাল দিতে হয় আরও ঝক্কি ও চোখরাঙানি। চলতি লেখাটির শুরুতে দেশকাঁপানো ফুটবলার যে মেয়েদের কথা লেখা হলো, তাদের অঞ্চল ও সমাজের কিছু বাস্তবতা তুলে ধরা যাক। প্রত্যেকেই সহস্র বঞ্চনা আর ক্ষরণের ভেতর দিয়ে আজ করতালির মাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন। রাঙামাটির নানিয়ারচরের ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভুয়োআদামে এক জুমিয়া পরিবারে জন্ম রূপনা চাকমার। ২০২২ সালের সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে তিনি সেরা গোলরক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন। খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ির সুমন্তপাড়া গ্রামের মেয়ে মনিকা চাকমা। তার পরিবারও জুম এবং কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ২০১৯ সালে ‘বঙ্গমাতা অনুর্দ্ধ-১৯ নারী আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্টে গোল করে ফিফা থেকে তিনি ‘ম্যাজিকেল চাকমা’ খেতাব পান।

রাঙামাটির কাউখালীর ঘাঘড়া ইউনিয়নের মগাছড়িতে ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়ি। নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ দলের অন্যতম ফুটবলার তিনি। খাগড়াছড়ির জুমিয়া পরিবারের মেয়ে আনুচিং মোগিনি। জাতীয় নারী ফুটবল দলের আক্রমণভাগের এক দুর্দান্ত খেলোয়াড় তিনি। রূপনা, মনিকা, ঋতুপর্ণা কিংবা আনুচিং হয়ে ওঠার সম্ভবনা আরও সহস্র পাহাড়ি মেয়ের থাকলেও সবাই পারেনি। তারা পেরেছে। তারা অনন্য। তাদের মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদি পূর্বসুরীদের বহুজন হয়তো পারত। কিন্তু পূর্বসুরীদের বহুজনকে ছাড়তে হয়েছিল জন্মভিটা, শৈশবের খেলার মাঠ পেছনে ফেলে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছিল। ১৯৬০ সালে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বাঁধের পানির তলায় ডুবিয়ে দিয়েছিল পূর্বসুরীদের সকল পরিচয়। লাখো মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। রূপনা চাকমার নানিয়াচরেরই মেয়ে ছিল কল্পনা চাকমা। আত্মপরিচয়ের অধিকারের দাবিতে ছিল সোচ্চার। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তাকে অপহরণ করা হয়। রূপনা কিংবা ঋতুপর্ণাকে কাপ্তাই বাঁধ কিংবা অপহরণ পাড়ি দিতে হয়নি। তবে পাহাড়ে জিইয়ে থাকা জনমিতির রাজনীতি, উন্নয়নের বাহাদুরি কিংবা বিপন্ন প্রকৃতির বাস্তবতাকে সামাল দিয়েই খেলার মাঠে আসতে হয়েছে।

ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের মান্দি কৃষক পরিবারের মেয়ে শিউলি আজিম। জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের একজন অন্যতম ডিফেন্ডার তিনি। কলসিন্দুর গ্রামেরই কৃষক পরিবারের মেয়ে মারিয়া মান্দা। অনুর্ধ-১৫ সাফে যার বাহুতে বেঁধে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের আর্মব্যান্ড। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের এক সাঁওতাল কৃষক পরিবারে জন্ম সোহাগী কিস্কুর। ২০১৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও জেলা ফুটবল দল বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয় এবং নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের অন্যতম খেলোয়াড় তিনি। শিউলি, মারিয়া কিংবা সোহাগীর পরিবার ও সমাজ আরও প্রান্তিক এবং এবার সকলেই কার্যত ভূমিহীন পরিবারের সন্তান। কিন্তু এদের পূর্বসুরীরা কেউ ভূমিহীন ছিল না। দেশভাগ, দাঙ্গা, যুদ্ধ এবং নানা রাজনৈতিক ঘটনা এবং বাঙালি কর্তৃক প্রশ্নহীন ভূমিদখলের কারণেই ময়মনসিংহ কিংবা ঠাকুরগাঁওয়ের আদিবাসীরা আজ ভূমিহীনতার এক নিদারুণ কাল পাড়ি দিচ্ছেন।

শিউলি কিংবা মারিয়ারই স্বজন মধুপুরের গীদিতা রেমা কিংবা পীরেন স্নাল। ভূমি ও অরণ্য বাঁচাতে উভয়েই শহীদ হয়েছিলেন। সোহাগীর স্বজন আলফ্রেড সরেনকে ২০০০ সালের ১৮ অগাস্ট হত্যা করা হয়। কারণ নওঁগার ভীমপুরে আলফ্রেড আদিবাসী ভূমি সুরক্ষার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ভূমি বাঁচানোর লড়াইয়ে মঙ্গল মার্ডি, রমেশ টুডু, শ্যামল হেমব্রম নিহত হন যারা সোহাগীরই জ্ঞতি-স্বজন। শিউলি, মারিয়া কিংবা সোহাগী এসব দুঃসহ দাগ ও ক্ষত ডিঙিয়েই কিন্তু আজ আমাদের আলোঝলমলে খেলার মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশকে বারবার এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি একটিবারও তাদের পরিবার এবং সমাজের অমীমাংসিত সব বঞ্চনাকে প্রশ্ন করব না? নাকি করতালির পর করতালির জোয়ারে আদিবাসী জীবনের সব বঞ্চনা ও নিপীড়নের আহাজারি চাপা দিয়ে রাখা হবে? কিন্তু ইতিহাস বলে এটি কখনোই সম্ভব নয়। কাউকে দাবায়া রাখা যায় না। আর তাই কেউ কেউ বঞ্চনাকে চুরমার করেই করতালির ময়দানে আলোকশিখা হয়ে ওঠে। 

আদিবাসী জীবনের ক্ষত ও দাগ

‘আদিবাসী’ পরিচয়টিকে আমরা মানি বা না মানি, কোনোভাবেই রূপনা চাকমা বা মারিয়া মান্দার জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার করতে পারব কি? একই নয়াউদারবাদী করপোরেট ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী শ্রেভিবিভক্ত সমাজে আমরা বাস করছি। বাঙালি বা আদিবাসী কেউই কাঠামোগত বৈষম্য আর বৈশ্বিক রাজনৈতিক চাপকে অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু একইরকম বাস্তবতার ভেতর বসবাস করেও আদিবাসীদের প্রান্তিকতা, বঞ্চনা ও ক্ষতের দাগগুলি ভিন্নতর। কেবল বাংলাদেশ নয়; আমাজন থেকে শুরু করে সামিল্যান্ড সর্বত্র আদিবাসীরা এই বঞ্চনার আওয়াজ তুলেছেন। বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ ঘোষিত নানা আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়। জলাভূমি দিবস, নারী দিবস, পরিবেশ দিবস, প্রাণবৈচিত্র্য দিবস, যুব দিবস, মানবাধিকার দিবস, আদিবাসী দিবস, শিশু দিবস, প্রবীণ দিবস কিংবা খাদ্য দিবস। উল্লিখিত সবকটি দিবস পালন করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ এখনো ‘আদিবাসী দিবস’ আয়োজন করেনি। অথচ সংবিধানে আদিবাসীদের ‘নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ ও ‘উপজাতি’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে আদিবাসী জনসংখ্যা এবং মোট জাতিসংখ্যা নিয়ে তর্ক আছে। অস্পষ্ট পরিসংখ্যান ও খতিয়ান আছে। ১৯৮৪ সনের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল ৮,৯৭,৮২৮ জন এবং তখন মাত্র ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৯৯১ সনের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয় ১২,০৫,৯৭৮ জন এবং জাতিসত্তা দেখানো হয় ২৯টি। প্রায় ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে একটি জাতিগোষ্ঠী বেড়ে যায়। ২০০১ সনের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা উধাও ছিল। সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন। বিস্ময়করভাবে প্রায় ত্রিশ বছরে জাতিসত্তা বেড়ে হয়েছে ৫০টি। সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ ভাগ। ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২(১) এবং ধারা ১৯-এ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, সাঁওতাল, ডালু, উসাই (উসুই), রাখাইন, মণিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওরাও, বর্মণ, পাহাড়ী, মালপাহাড়ী, কোল এবং বর্মণ নামে মোট ২৭ জনগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পূর্বের ২৭ জাতির পাশাপাশি পরে কুর্মি মাহাতো, কন্দ, গঞ্জু, গড়াইত, মালো, তুরি, তেলী, পাত্র, বানাই, বাগদী, বেদিয়া, বড়াইক, ভূমিজ, মুসহর, মাহালী, রাজোয়ার, লোহার, শবর, হদি, হো এবং কড়া এ ২১ জাতির নাম তফশিলভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সনে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। যদিও রাষ্ট্রীয় জনশুমারিতেও এই কডা, রেংমিটচা ও সৌরা জাতিগোষ্ঠীর নাম নাই।

আমরা অপেক্ষা করছি

আমরা যদি বাংলাদেশে আদিবাসী বসতির ভৌগলিক ও জনমিতি বিন্যাস দেখি তাহলে দেখতে পাই সমতল, পাহাড় এবং উপকূলে আদিবাসী জনঘনত্ব বেশি। কিন্তু নিদারুণভাবে এসব অঞ্চলে আদিবাসীদের জনসংখ্যা কমেছে এবং আদিবাসী ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠিত ও বেহাত হয়েছে। আদিবাসীরা আজ কার্যত ভূমিহীন। ভূমির পাশাপাশি আদিবাসী অঞ্চলগুলো আজ পরিবেশগতভাবে গভীরতর অসুস্থ। নয়াউদারবাদী উন্নয়ন আর করপোরেট মুনাফার কারণে আদিবাসী অঞ্চলের নদী, টিলা, পাহাড়, অরণ্য থেকে প্রাণসম্পদ সবই আজ রক্তাক্ত। অথচ আদিবাসী আত্মপরিচয় কিন্তু এসব প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আর বাস্তুতন্ত্রকে ঘিরেই বিকশিত হয়েছে। লাগামহীন স্থাপনা আর তথাকথিত উন্নয়নের চাপে প্রশ্নহীনভাবে নিরুদ্দেশ হচ্ছে প্রাণ ও প্রকৃতির ঐতিহাসিক নির্দশন। আমরা আশা করব এসব প্রশ্নহীন ক্ষত ও দাগ মুছে যাবে। মারিয়া, সোহাগী কিংবা আনুচিংয়ের চোখেও সমাজ রূপান্তরের গতিপ্রকৃতি দেখবার চর্চা করবে বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখি কোনো একদিন আদিবাসী ফুটবলারদের মাতৃভাষার সম্ভাষণে দেশের জনগণকে অভিবাদন জানাবেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সহস্র করতালি আর স্বপ্নময় ভালোবাসা নিয়ে আমরা দিনটির অপেক্ষা করছি।