অন্তর্বর্তী সরকার দলনিরপেক্ষ হলেও তার কিছু স্টেকহোল্ডার বা অংশীজন আছে। সেইসব অংশীজনের মধ্যে যদি ডেভিল থাকে, সরকার কি তাদেরকে ধরবে বা ধরতে পারবে?
Published : 10 Feb 2025, 07:48 PM
শুরু হলো আরেক অপারেশন, মানে অভিযান। ‘অপারেশন’ শুনলে মনে আসে ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ কথা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে যে অপারেশনের নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ইতিহাসের নারকীয় গণহত্যা শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এরপর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের চালানো ‘অপারেশন জ্যাকপট’সহ আরও অনেকগুলো অপারেশনের কথা বইপত্রে আছে।
স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক অপারেশন নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল— যেগুলো পরিচালিত হয়েছিল মূলত অপরাধ দমন তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। বিশেষ করে ব্গিত সরকারের আমলে ২০১৬ সালে রাজধানীর হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পরে ২০১৭ সালজুড়ে বেশ কিছু অভিযান অপারেশন চালানো হয়। যেমন ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’, ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’, ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’, ‘অপারেশন হিটব্যাক’ ইত্যাদি।
তার আগে ২০০২ সালে বিএনপির আমলে পরিচালিত অপারেশন ‘ক্লিন হার্ট’ও অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে পরিচালিত ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট ’ নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশেষ করে ওই অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনের সঙ্গে সরকারি পরিসংখ্যানের বিস্তর ফারাক নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। প্রসঙ্গত, অধিকারের প্রধান নির্বাহী আদিলুর রহমান খান বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা।
এ মুহূর্তে চলছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেশের আলোচিত কয়েকটি অপারেশনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা যাক।
অপারেশন সার্চ লাইট
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তার নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ইতিহাস বলছে, এই অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। যদিও এর কোনো লিখিত নথি পাওয়া যায়নি।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সে স্মৃতিচারণা করে খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, “১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিই এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।” পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
১৯৮১ সালে মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম তার আলোচিত ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইতে (পৃ. ৮২-৮৩) লিখেছেন: “২৫শে মার্চ রাত ১২টার দিকে প্রধান লক্ষ্যস্থলগুলোর উপর আর্টিলারি শেল পড়তে শুরু করে। কামানের গোলায় সারা শহর কেঁপে ওঠে। ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট চতুর্দিকে ছুটতে থাকে। জনসাধারণ খাটের নীচে আশ্রয় নেয়। শিশুরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু তাদের কান্নার আওয়াজ তলিয়ে যায় বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের বিকট উচ্চ শব্দে। বৃদ্ধরা নফল নামাজ শুরু করে দেন, কেউ পবিত্র কোরান থেকে তেলাওয়াত আরম্ভ করেন। কিন্তু করলে কি হবে? এক অচিন্তনীয় হত্যার নেশায় পাকিস্তানীরা তখন উন্মাদ হয়ে পড়েছিলো। রাত তখন দেড়টা। একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া সৈন্যবাহী যান এবং সৈন্য বোঝাই একটি ট্রাক ধানমন্ডী আবাসিক এলাকার দিকে অগ্রসর হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের সামনে পৌঁছে যায়। পৌঁছেই সকল সৈন্য কিছুক্ষণ বাড়িটির দিকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়তে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন চিৎকার করে তাদের বল্লেন, তোমরা আমাকে গ্রেফতার করতে পারো, কিন্তু গুলী থামাও। সৈন্যরা প্রার্থিত ব্যক্তিকে পেয়ে খুশী হলো। তারা শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে গেলো এবং সেখান থেকে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ইতিমধ্যে নগরের বিভিন্নস্থানে কামানের গোলা ছোঁড়া শুরু হয়। ট্রাক ভর্তি সৈন্যরা পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে অগ্রসর হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি বিশুদ্ধ বাঙালী দল উদ্ধত মুষ্টি তুলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে থাকে। সৈন্যরা সে ভাষা বোঝেনি তাই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের একঝাক গুলী দিয়ে তারা জবাব দেয়।”
অপারেশন জ্যাকপট
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ-কমান্ডো বাহিনীর পরিচালিত প্রথম অভিযান ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৬ই অগাস্ট প্রথম প্রহরে দেশের দুইটি সমুদ্রবন্দর— চট্টগ্রাম ও মোংলা এবং দুটি নদী বন্দর— চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে একই নামে পরিচালিত অপারেশনগুলো চালানো হয়েছিল। অপারেশন জ্যাকপট ছিল একটি আত্মঘাতী অভিযান। এই অভিযানকে মুক্তিযোদ্ধারা সফল অভিযান বলে বর্ণনা করেন, কারণ এই অপারেশনে পাকিস্তান ও আরও কয়েকটি দেশ থেকে আসা অস্ত্র, খাদ্য ও তেলবাহী ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ অভিযানে অংশগ্রহণকারী কোনো গেরিলা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়েননি। এছাড়া, বিদেশি জাহাজ ধ্বংস হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যখন সে খবর প্রকাশ পায়, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোন যুদ্ধ হচ্ছে না বলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচারণা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়ে।
ইতিহাস বলছে, ১৯৭১ সালের অগাস্টের ১৫ তারিখ রাতে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এর পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল সেই বছরের মে মাসে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের একজন নেতা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম বন্দরের অভিযান তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইতে তিনি লিখেছেন: “পাকিস্তানি বাহিনীর নৌযান ধ্বংস এবং নৌ-যাতায়াত ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্য চলাচল, সমর-সরঞ্জাম ও রসদ পরিবহন ব্যাহত করা ছিল ওই অপারেশনের প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৩শে মে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় ভাগিরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। জুন মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাই করা স্বাস্থ্যবান ও ভালো সাঁতার জানেন এমন ৩০০ জনের একটি দল ‘সি-টু-পি’ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। জুলাই মাসের শেষদিকে প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এরপর দিনক্ষণ নির্ধারণসহ হামলার পরিকল্পনা করা হয়।”
অপারেশন ক্লিন হার্ট
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হতে থাকে। ঢাকার রাস্তায় একের পর এক ওয়ার্ড কমিশনারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যা ও ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বেসামাল হয়ে পড়ে সরকার। ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর সরকারের এক বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বীকার করেন যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ১৬ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে সারাদেশে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। নাম দেয়া হয় অপারেশন ক্লিন হার্ট। প্রথম দিনের অভিযানে প্রায় ১৪০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্ষমতাসীন বিএনপির নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসে দলের সিনিয়র নেতাদের কাছে অভিযোগ করেন যে সেনা সদস্যরা তাদের অপমান অপদস্থ করছে।অভিযান শুরুর পর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। তবে সেনাবাহিনীকে দৃঢ়তার সাথে কাজ করতে বলেন খালেদা জিয়া। (বিবিসি বাংলা, ১৭ অক্টোবর ২০২২)।
ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বাসায় তল্লাশি চলে। আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, আব্দুল জলিল, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বাসায় অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। এসব ঘটনার পরে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন সন্ত্রাস দমন না করে সেনাবাহিনীকে বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। অপারশেন ক্লিন হার্টে সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় যাদের আটক করে তাদের মধ্যে ৪০ জনের বেশি মানুষের হেফাজতে মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যদিও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। সেনাবাহিনীর এই অভিযান চলে ৮৪ দিন। যেদিন থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার শুরু হয়, তাদের আগের দিন ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ২০০৩’ জারি করা হয়। এর মাধ্যমে অপারেশন ক্লিনহার্টের অবসান ঘটে। কিন্তু অভিযানকে দায়মুক্তি দেয়ার ঘটনাটি পরবর্তীকালে বিতর্কের জন্ম দেয়। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে পরিচালিত অভিযানে হতাহতের ঘটনায় জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে অবৈধ ও বাতিল বলে রায় দেন।
হোলি আর্টিজান এবং তারপর
২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে ‘নব্য জেএমবি’র পাঁচজনের একটি দল। জঙ্গিদের হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ নাগরিক নিহত হন। এ ঘটনায় পরদিন ভোরে সেনা কমান্ডো দলের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’। এতে ৫ জঙ্গি ও রেস্টুরেন্টটির দুই কর্মী নিহত হন।
অপারেশন স্ট্রম-২৬
হোলি আর্টিজানের এই ঘটনার পরে জঙ্গি নির্মূলে বেশ কিছু অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে একটি অপারেশন স্ট্রম-২৬— যেটি পরিচালিত হয় রাজধানীর কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিলে (জাহাজ বাড়ি)। ওই বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা রয়েছে, এমন খবরে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই সেখানে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। এ অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়। এর মধ্যে ৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত করে পুলিশ।
অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭
২০১৬ সালের ২৭ অগাস্ট সিটিটিসি ও পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখা যৌথভাবে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ চালায়। এতে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ তামিম চৌধুরীসহ তিন জঙ্গি নিহত হয়।
অপারেশন রূপনগর
২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের ৩৩ নম্বর সড়কের ৩৪ নম্বর বাড়িতে জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ। এতে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার সামরিক প্রশিক্ষক মেজর (অব.) জাহিদ নিহত হয়। পুলিশ জানায়, জাহিদ ছিলেন নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।
অপারেশন আজিমপুর
রাজধানীর আজিমপুরে ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আরেকটি অভিযান চালায় পুলিশ। এতে জঙ্গি তেহজীব করিম ওরফে আবদুল করিম নিহত হয়।
অপারেশন শরতের তুফান
২০১৬ সালের অক্টোবরে গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিনটি অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে গাজীপুরের পাতারটেকে ‘অপারেশন শরতের তুফান’ নামের অভিযানে সাত জন, একই জেলার হাড়িনাল এলাকার আরেকটি বাড়িতে র্যাবের অভিযানে দুজন এবং টাঙ্গাইলের কাগমারা এলাকায় পৃথক অভিযানে আরও দুজন নিহত হওয়ার কথা জানায় সরকার।
অপারেশন রিপল ২৪
২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে রাজধানীর দক্ষিণ খানের পূর্ব আশকোনায় ‘অপারেশন রিপল ২৪’ পরিচালনা করে পুলিশ। তারা জানায়, জঙ্গি সুমনের স্ত্রী ও নারী জঙ্গি সারিকা তার শিশু সন্তানকে নিয়ে আত্মসমর্পণের করতে গিয়ে সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে সারিকা নিহত হয়। এ অভিযান চলাকালে গুলিতে নিহত হয় আফিফ কাদেরী নামে আরেক কিশোর। সে আজিমপুরে নিহত তানভীর কাদেরীর ছেলে। সন্তানসহ শীলা ও তৃষামণি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
অপারেশন অ্যাসল্ট ১৬
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ চালানো হয় ‘অপারেশন অ্যাসল্ট ১৬’। এতে এক নারী ও তিনজন নিহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাদেরকে জঙ্গি বলে অভিহিত করে।
অপারেশন টোয়াইলাইট
২০১৭ সালে সিলেটের ‘আতিয়া মহলে’ সেনা অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ ছিল সবচেয়ে আলোচিত অভিযান। ২৩ মার্চের অভিযানে নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হয়। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, নগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির ওই আস্তানাটি ছিল নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরকের মজুদখানা। অভিযানে আতিয়া মহলের বাইরে জঙ্গিদের রাখা বোমার বিস্ফোরণে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক চৌধুরী আবু মোহাম্মদ কয়সর ও জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম নিহত হন। ওই বিস্ফোরণে চারজন সাধারণ মানুষও প্রাণ হারান।
অপারেশন স্প্রিং রেইন
সিলেটের শিববাড়ি এলাকার উস্তার মিয়ার আতিয়া মহলে প্রথমে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষায়িত টিম সোয়াত অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নেয়। নাম দেয়া হয়, ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। ওই ভবনে অনেক সাধারণ মানুষ আটকা পড়ায় অভিযানের দায়িত্ব নেয় সেনাবাহিনীর ১১ পদাতিক ডিভিশনের প্যারা কমান্ডো ইউনিট। টানা চার দিন ধরে চলা অভিযান শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সকালে। শেষ হয় ২৭ মার্চ। অভিযানের শুরুতে পাঁচতলা বাড়িটির ৩০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৮ ফ্ল্যাটে বসবাসকারী নারী ও শিশুসহ ৭৮ জনকে উদ্ধার করেন কমান্ডোরা। অভিযান শেষে ওই আস্তানা থেকে দুজন পুরুষ ও দুজন নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
অপারেশন ম্যাক্সিমাস ও অপারেশন হিটব্যাক
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ মৌলভীবাজারের নাসিরপুর ও বড়হাটে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। নাসিরপুরে ২৯ মার্চ সন্ধ্যা থেকে ‘অপারেশন হিটব্যাক’ অভিযান শুরু করে সোয়াত। জঙ্গিরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। অভিযান শুরুর ২৪ ঘণ্টা পর এর সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। পুলিশ জানায়, অপারেশন চলাকালে ওই আস্তানা থেকে একজন পুরুষ, দু’জন নারী ও চারজন শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে নব্য জেএমবির দুর্ধর্ষ জঙ্গি লোকমান হোসেন রয়েছে। তার বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। নিহত অন্যদের মধ্যে লোকমানের স্ত্রী শিরিন আক্তার, বড় মেয়ে আমেনা খাতুন রয়েছে। বাকি চারজন শিশু।
৩০ মার্চ বড়হাটের আস্তানায় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ অভিযান শুরু করে সোয়াত। আস্তানায় তৈরি করা বাঙ্কার থেকে জঙ্গিরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা বোমা নিক্ষেপ করে। ১ এপ্রিল সকালে সোয়াত অভিযান সমাপ্ত করে। পরে ওই আস্তানা থেকে দুই পুরুষ ও এক নারী জঙ্গির লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, নিহত তিন জঙ্গির মধ্যে নব্য জেএমবির তৎকালীন প্রধান মাইনুল ইসলাম মুসা রয়েছে।
এরকম অনেকগুলো অভিযানের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৬ ও ২০ ১৭ সালে রাজধানীসহ সারা দেশে অনেকগুলো জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা। এ সব অভিযানে দুর্ধর্ষ অনেক জঙ্গি নিহত হয়েছে। গুলশান হামলার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত অনেক জঙ্গি ধরাও পড়েছে। অভিযান চলাকালে প্রাণ হারিয়েছেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ র্যাব-পুলিশের তিন কর্মকর্তা। ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্যও নিহত হন।
অপারেশন ফ্লাশ আউট
২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের পাল্টা হিসেবে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামে কর্মসূচি দমনে ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট ’ নাম দিয়ে চালানো হয় এই অভিযান।
এক যুগ পরে এবার সেই অভিযানে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ফেঁসে যাচ্ছেন। তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ থেকে শুরু করে থানার ওসি পর্যন্ত কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনতে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে তদন্ত সংস্থাটি। ব্ল্যাক আউট করে ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটে’র গণহত্যায় পুলিশের কার কার নির্দেশে গুলি করা হয়েছিল, কারা কত গুলি করেছিল, মাঠ পুলিশের কোন কোন সদস্য আন্দোলন দমনে অংশ নিয়েছিল তার বিস্তারিত তথ্য জানতে তদন্তকাজ শুরু করেছে অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর অপরাধের মাত্রানুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা আফসার মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, দেশের নাগরিক হিসেবে এর বিচার পাওয়া আমাদের অধিকার। আমরা এতদিন মজলুম ছিলাম। আমাদের ওপর হওয়া জুলুমের ইনসাফভিত্তিক বিচার চাই। আমরা শহীদদের তালিকা নতুন করে করতে শুরু করেছি। দ্রুতই এটি সম্পন্ন হবে। শাপলা চত্বরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর আমাদের কান্নারও উপায় ছিল না। (আমাদের সময়, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪)।
ডেভিল হান্ট
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার ঠিক ৬ মাসের মাথায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরসহ সারা দেশে শুরু করেছে ‘অপারেশনের ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, প্রথম দিনেই গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১ হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মানে ১ হাজার ৩০৮ জন ‘শয়তানকে’ ধরা হয়েছে।
অভিযান শুরুর পরদিন রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যতদিন ‘ডেভিল’ থাকবে, ততদিন অভিযান চলবে। তার মানে এই অভিযান কতদিন চলবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
প্রশ্ন হলো, এই ডেভিল বা শয়তান কারা? দেশে কী পরিমাণ ডেভিল আছে এবং তাদের সবাইকে ধরে ফেলতে বা হান্ট করতে কতদিন লাগবে— তা এখনও নিশ্চিত নয়। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, এই ডেভিল চিহ্নিত করার তরিকাটা কী? সরকার যাদেরকে মনে করবে শুধু তারাই ডেভিল বা শয়তান?
অপরাধ দমনের জন্য এই ধরনের অভিযান বরাবরই প্রশ্নের মুখে পড়ে কারণ সরকার তথা অভিযান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষ থাকেন না বা থাকতে পারেন না। অন্তর্বর্তী সরকার দলনিরপেক্ষ হলেও তার কিছু স্টেকহোল্ডার বা অংশীজন আছে। সেইসব অংশীজনের মধ্যে যদি ডেভিল থাকে, সরকার কি তাদেরকে ধরবে বা ধরতে পারবে?
অনেক সময়ই দেখা যায়, অপরাধ দমনের নামে পরিচালিত এইসব অভিযান মানবাধিকার হরনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। গত দুই দশকে বিভিন্ন অপরাধ দমনে পরিচালিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, বিশেষ অভিযান এবং গোপন আটককেন্দ্র (আয়নাঘর) নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে জঙ্গি বা মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বিনা বিচারে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রকৃত অর্থে অনেক অপরাধী থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষও ভিকটিম হয়েছেন। তাছাড়া একজন অপরাধীকেও যে বিনা বিচারে হত্যা করা যায় না, সেই নীতিটুকুও অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনুসরণ করে না। আবার অনেক সময় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লোকজন অনেককে মেরে ফেলেছে— এই অভিযোগও ভুরি ভুরি। ফলে যখনই কোনো একটি বাহিনী বা যৌথ বাহিনী এরকম অপরাধ দমনের নামে কোনো অভিযান শুরু করে, তখন জনমনে এই প্রশ্নটি দেখা দেয় যে, যারা ধরা পড়লেন তাদের মধ্যে নিরীহ কেউ নেই তো?