জীবন বিভক্ত করে, কিন্তু মৃত্যু এক করে। সত্যি গণআন্দোলনে প্রতিটি মৃত্যু হয়ে উঠছে সংযুক্তির বিশেষ কারণ। মরতে না শিখলে মহৎ কিছু অর্জন করা যায় না।
Published : 21 Aug 2024, 11:54 AM
যিনি চলে যান তিনি রেখে যান অসীমের বেদনা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যারা নিহত হয়েছেন তারা রেখে গেছেন ত্যাগের অনন্য মহিমা। মৃত্যুবরণ করার অসামান্য উদাহরণ। মানুষ কতটা মানুষপ্রবণ হলে নিজের জীবন এভাবে উৎসর্গ করতে পারেন।
মর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ মানুষের কাছে অনেক বড়। সকল মানুষেরই আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র যখন অধিকার কেড়ে নেয়, জীবনকে তুচ্ছ করে তোলে, তখন রুখে দাঁড়ানো ছাড়া মানুষের সামনে আর কোনো বিকল্প থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে দুটো প্রশ্ন এসে হাজির হয়; মানবিক মর্যাদা না জীবন বড়?
জীবন বেহাত হওয়ার পূর্ণ আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মানবিক মর্যাদার পথ ধরে সে। রুখে দাঁড়ায়। জীবন উৎসর্গ করে। যারা জীবন দিচ্ছেন, আহত বা নিহত হচ্ছেন, জেল খাটছেন তারা তা করছেন মূলত অন্যদের জন্য। এটি হলো পরার্থবোধ। জীবন ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব মানুষকে অমরত্ব দান করে। এমন মনোভাব যারা লালন করেন তারা উন্নত মানুষ।
আল মাহমুদ তার সনেট ‘সে গায় নিজের গান’ লিখেছেন:
‘‘সে গায় নিজের গান
নিজের সুরে
নিজের ভাষায়
তারি শব্দ লেগে থাকে উদায়ন্তে
মানুষের উদগ্র আশায়।’’
সত্যি সত্যি গণআন্দোলনে নিহতের ঘটনা অনেককে বিমূঢ় করেছে। কিন্তু করেনি আশাহত। অত্যন্ত মূল্যবান মৃত্যু, এসব মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী আশা জাগিয়ে গেছে। এগুলো পতনমুখী নয়, সোনালি সবুজের হাতছানি।
আল মাহমুদ তার ‘কালের অভয়’ নামক একটি কবিতায় আরও লিখেছেন:
“ভাবি কারো নয় বলে মৃত্যু এত দুঃসাহসী হয়
ভাবে তার আহার্যের গ্রাস বুঝি রয়েছে সুলভ
…
এ-কথা জানে না কাল, মৃত্যু আরও অজ্ঞ অতিশয়
যাকে ষ্পর্শ করে, ভাবে সেই বুঝি মৃত্যুর বিষয়। ”
মৃত্যুকেই প্রধান বিষয় করে তুলেছিল দেশত্যাগী শেখ হাসিনার সরকার। মানুষের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিল ক্ষমতাকে। ক্ষমতা মানুষের চেয়ে বড় হতে পারে না। শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এ মধ্যযুগীয় মনোভঙ্গি অস্বাভাবিকভাবে ভর করেছিল। বাংলামনন ফুলঝরিসদৃশ। তার এক মাথায় আগুন ধরলে পুরোটা নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। বাঙালির রক্তে রয়েছে এক দ্রোহী মনোভাব।
কৃষক-প্রজা, ফকির-সন্ন্যাসী, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পললভূমি বাংলাদেশ। বাঙালি মূলত প্রতিষ্ঠানবিরোধী, নিষ্পেষণের বিরোধী। লড়াই করে সে একজনকে ক্ষমতায় বসায়, অভব্য আচরণে পরক্ষণে তার অনীহা তৈরি হয়। বাঙালি আচরণগতভাবে কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করতে পছন্দ করে। কোনো শাসন তার উপর জেঁকে বসলে সে রুখে দাঁড়ায়। বাঙালিকে পোষ মানানো সহজ নয়। দ্রোহ ও প্রতিবাদ তার জীবনের অংশ। পরিস্থিতি বুঝে সে অভিযোজিত হয়, কিন্তু সুযোগ পেলে বিদ্রোহ করে বসে।
সাম্প্রতিক গণআন্দোলনে জনমানুষ বিশেষত ছাত্ররা মরতে শিখে গিয়েছিল। অন্যের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। একটি নিপীড়নমূলক স্বৈরাচারী শাসকের হাতে এত অল্পসময়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনার উদহারণ খুব বেশি পাওয়া যাবে না।
মানুষের মৃত্যু আকাঙ্ক্ষা ও আত্মত্যাগ কত শক্তিশালী হতে পারে শেখ হাসিনার সরকার তা তিলেতিলে টের পেয়েছে। মানুষ অজেয় প্রপঞ্চ। যাদের মেরে শেষ করা যায় না। মহৎমৃত্যু জন্ম দেয় অসংখ্যা জীবনের। মৃত্যু শেষ কথা নয়, মৃত্যুর ভেতর থাকে নতুন প্রাণ, নতুন বার্তা।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছে তাদের মৃত্যু সম্ভাবনাসূচক, নিষ্ফলা নয়। মৃত্যুগুলোর ভেতর লুকিয়ে আছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এগুলো সাধারণ মৃত্যু নয়, বিশেষ ধরনের মৃত্যু। নিহতদের কবর কেবল সবুজ ঘাসে ভরা ক্ষুদ্র জমিন নয়। হন্তা হৃদয়ের স্থায়ী ক্ষত। নিহতদের কবর প্রতিশ্রুতি আর অঙ্গীকারের স্মরণিকা।
সারি সারি তাজা লাশ গুণতে গুণতে আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। হাসপাতালে আহত অনেকে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। মানুষ দেখেছে মায়ের কোলে লাশ, বন্ধুর কোলে লাশ। পানি লাগবে পানি বলতে বলতেই মুগ্ধ চলে গেল মৃত্যুর মিছিলে। ক্ষত-বিক্ষত শরীরগুলো মানুষের স্বাভাবিক শরীরের পরিচয়কে অস্বাভাবিক করে তুলছিল। এসব নিহত ও আহতরা অবলীলায় ঢুকে পড়ছিল টেলিভিশনের পর্দায় আর মুদ্রিত হচ্ছিল সংবাদপত্রের রঙিন পাতায় ।
দর্শক- শ্রোতাদের ভেতর তৈরি হচ্ছিল এক ভীতিকর অনুভূতি। বয়স্ক, বৃদ্ধ ও শিশুরা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। মানুষের এত রক্তাক্ত শরীর কারও তেমন পূর্বপরিচিত ছিল না। জনগণের পয়সা দিয়ে কেনা অস্ত্র আর বুলেট দাগা হচ্ছিল মানুষজনের শরীরজুড়ে।
৭১-এর বাবা-মা বা স্ত্রীর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে গেছে এবারও ঠিক সেভাবে বাবা-মার অনুমতি নিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা মিছিলে গেছে, প্রতিবাদ সমাবেশে গেছে। অনেকে ফিরেছে, অনেকে ফেরেনি। অভিভাবকরা মর্গে লাশ শনাক্ত করেছে। দাফন করেছে।
এটা কেবল লাশের দাফন নয়। একেকটি পরিবারের সম্ভাবনা ও স্বপ্নের দাফন। স্বতন্ত্র স্বপ্নের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জেগেছে এক বৃহৎ স্বপ্ন। মানবিক মর্যাদা, বৈষম্যহীন ও সমতাভিক্তিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন। কী চমৎকারভাবে কবি জীবনানন্দ দাশ তার স্থবির জীবন কবিতায় বলেছেন, ‘‘মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে’’।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশু গ্রহণ করেছে বুলেট। পড়ছে একের পর এক লাশ। লাশের সারিতে ছিল সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। হাসপাতালগুলো উপচে পড়েছে আহত আর নিহতের ভিড়ে। সরকারি তরফে লাশের গুণতি নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। তথ্য ধ্বংস করতে চেয়েছে, লুকাতে চেয়েছে। বেঁচে থাকা মানুষ নিয়ে যেমন রাজনীতি তেমনি মৃত মানুষ নিয়েও রাজনীতি কম নয়। কারণ, জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষ অনেক বেশি শক্তিশালী।
নিপীড়নমূলক শাসনের কাছে মানুষ এক দলা প্রপঞ্চ। মানুষের দাবি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে না। মৃত্যু বুঝতে পারে না। তাই ৬৫০-এর ওপর মানুষ মেরেও বলে ওঠে ‘‘জনগণের কাছে আমার জিজ্ঞাসা আমার অপরাধটা কী?” কী এক গভীর ক্ষত, কী এক ভয়াবহ মনস্তত্ত্ব। স্বৈরাচারী শাসকদের কাছে মানুষ এক অবাধ্য বর্গ, স্থুল। তাদের ভাষায় জনগণ কিছু বুঝতে চায় না! কিন্তু এ স্থুল জনগণ তখনই সবচেয়ে শক্তিশালী হয় যখন তারা সংঘবদ্ধ হয় এবং শাসকগোষ্ঠীকে তাড়া করে ফেরে।
আমরা দেখেছি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদের বুক পেতে মৃত্যুবরণ করার দৃশ্য সাড়া পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছে। অপশাসন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এটি ছিল এক ভিন্ন উচ্চতার অভিব্যক্তি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা আন্দোলনরত ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শাহাদৎবরণ করেন। আবু সাঈদ অধ্যাপক জ্জোহাকে স্মরণ করে বর্তমান শিক্ষকদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এ আহ্বান শিক্ষকদের তীব্রভাবে নাড়া দেয়।
চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ তার বন্ধু তারেক শাহরিয়ারের প্রথম মৃত্যুবাষির্কীতে ইরানি কালচারাল সেন্টারে এক আলোচনায় বলেছিলেন, জীবন বিভক্ত করে, কিন্তু মৃত্যু এক করে। সত্যি গণআন্দোলনে প্রতিটি মৃত্যু হয়ে উঠছে সংযুক্তির বিশেষ কারণ। মরতে না শিখলে মহৎ কিছু অর্জন করা যায় না। প্রতিটি অর্জন একেকটি আত্মত্যাগের স্মারক।
এ মৃত্যুগুলোর ভেতর রয়েছে অবিচল লক্ষ্যের ইঙ্গিত। এগুলো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ধাবমান গতি। প্রতিটি বিপ্লবে নিশানা থাকে। পাবলো নেরুদা তার ‘ডেথ অ্যালন’ কবিতায় বলছেন–
“…মৃত্যু নিমজ্জিত শব্দে
যেমন পা ছাড়া চপ্পলের শব্দ, স্যুটের শব্দ অথচ কেউ তা পরেনি
আংটির মতো বেঁধে ফেলে, অথচ পাথরহীন, আঙ্গুলহীন
মুখ নেই, জিহ্বা নেই, নেই কণ্ঠস্বর তারপর চিৎকার করে…”
৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে পরিবর্তনের বারতা। হাজারও আঁকাআঁকিতে ফুটে উঠেছে বর্ণিল সব গ্রাফিতি— যা স্বপ্ন, অন্তর্ভুক্তি, শোকগাথা এবং আগামীর রূপকল্পসদৃশ।
অন্তর্বর্তী সরকার কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করছে। দাবি থাকছে এ গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহতের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ হোক। নিহতের সম্মানে জুলাই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের নামফলকের স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। সরকার নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াক। শত শত আহত মানুষ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কেউ পা হারিয়েছেন, কেউ হাত, কেউবা চোখ। ওষুধপত্রের অপ্রতুলতার কথা শোনা যাচ্ছে। প্রয়োজনে আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে হবে।
আহতদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে মৃত্যুদূত। প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখছি দু-চারজনকে নিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুদূত তাড়াতে হবে। কবি আজীজুল হকের কবিতা ‘শবাধার রাত’-এর কিছু স্পর্শিত অংশ উল্লেখ করছি–
“আমি তবে প্রেতটাকে কী করে ফেরাবো?
তার প্রেম অনিবার্য, অদৃশ্য শীতল
সমাধি স্তম্ভের ছায়া
আত্মার শিয়রে
সময়ের যক্ষ দেয় অনন্ত আয়ুকে পাহারা,
কী করে ফেরাবো।”
আহতদের শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত্যুদূত ফিরিয়ে দিতে হবে, আহতদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ হোক এ মুহূর্তের অঙ্গীকার।