‘সড়ক দুর্ঘটনা’ ও ‘ডেঙ্গু উপদ্রব’– বাংলাদেশের কাঠামোগত সহিংসতার দুটি উদাহরণ। কারণ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতার ফলে এই দুটি ঘটনায় বিপুল প্রাণহানি ঘটে। তাই এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সড়ক দুর্ঘটনা ও ডেঙ্গু নিয়ে বছরের পর বছর বাংলাদেশে যা চলছে সেটি এক ধরনের ‘যুদ্ধাবস্থা’ও।
Published : 26 Oct 2024, 06:29 PM
২০১৪ সালের এপ্রিল মাস। ঋতুর হিসেবে উত্তর গোলার্ধে তখন বসন্তকালের মাঝামাঝি সময়। দীর্ঘ শীতের পর সর্বত্র বসন্তের উষ্ণতার রাজকীয় আগমন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ফ্লিন্ট শহরে বসন্তের সেই উচ্ছ্বাস নেই। শহরের মানুষ জটিল এক নিউমোনিয়া রোগে ভুগছে। দীর্ঘদিন দূষিত পানি পান করার কারণে ওই শহরের হাজার হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। ১২ জন মারাও যান।
দূষিত পানিতে মানুষের মৃত্যুর একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে। এক সময় মিশিগান রাজ্যের অন্যতম শিল্প কেন্দ্র ছিল এই ফ্লিন্ট শহর। সেখানকার অধিবাসীদের বেহাল অবস্থার শুরু হয় গত শতাব্দীর আশির ও নব্বইয়ে দশক থেকে। সেখানে অবস্থিত জেনারেল মোটরসের কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে। মানুষ চাকরি হারায়। ফলে ২০০২ সালে মিশিগান সরকার ফ্লিন্ট শহরে ‘অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ জারি করে এবং খরচ বাঁচানোর উপায় খুঁজতে থাকে। খরচ বাঁচানোর জন্য ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে সেখানকার পানি পরিবেশক দপ্তর ফ্লিন্ট নদী থেকে সরাসরি পানি সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়। এতেই বাঁধে বিপত্তি। নদীর পানি ছিল অতিমাত্রায় বিষাক্ত লিড মিশ্রিত। এই সিদ্ধান্ত ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওখানকার জনগোষ্ঠীর প্রতি চরম উদাসীনতার ফল। পরে এক নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, এই উদাসীনতার অন্যতম কারণ ছিল সেখানকার মানুষের বর্ণ পরিচয়। তখন ওই শহরের বসবাসকারীরা মূলত ছিল গরিব আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠী। এরপর যেসব প্রতিষ্ঠান সরাসরি এই অবহেলার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্থ করাসহ কিছু অভিযোগ আনা হয়। সেখানে তাদের শাস্তিও হয়। এই ধরণের বৈষম্যমূলক অন্যায় ও অবিচারকে কাঠামোগত সহিংসতা বলা হয়। এই ধারণার সুত্রপাত হয় ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। নরওয়ের সমাজবিজ্ঞানী ইয়োহান গাল্টং সর্বপ্রথম ‘কাঠামোগত সহিংসতা’র ধারণা প্রদান করেন।
এখন আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে।প্রথমে সড়ক দুর্ঘটনায় চিত্র দেখা যেতে পারে।রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ তথ্য মতে গত পাঁচ বছরে ৩২ হাজার ৭৩৩ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৪ এবং আহত ৫৩ হাজার ১৯৬ জন। এর মধ্যে শুধুমাত্র মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১১ হাজার ৩৮৪ জন। আবার বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনের বলা হয়, এ বছরের সেপ্টেম্বরে শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৯৩ জন। আর সড়ক, রেল ও নৌপথের দুর্ঘটনা মিলে সেপ্টেম্বরেই মোট মৃতের সংখ্যা ৫৫৪ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গত বছরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন। এখন প্রশ্ন হলো এগুলো কী শুধুই দুর্ঘটনা? রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন উদাসীনতাই কী এর জন্য দায়ী নয়?
এবার চোখ ঘোরানো যাক ডেঙ্গুর দৃশ্যপটে। গেল ২১ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায় ডেঙ্গুতে এবছর ইতোমধ্যে ২৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বছর শেষের এখনও দুই মাস বাকি। মৃতের সংখ্যার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে এবারও নতুন কোনো রেকর্ড সৃষ্টি হবে হয়তো। কারণ আক্রান্তের সংখ্যা এখনই অর্ধলক্ষের বেশি। সঙ্গে এই সংকট মোকাবেলায় নেই কোনো দৃশ্যগত পদক্ষেপ। গত তিন বছরের এই মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজারেও বেশি। ২০২৩ সালে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭০৫ জন। তার আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৮১ জন। সেইভ দ্য চিলড্রেন এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, ২০২৩ সালে বিশ্বের অতিমাত্রায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ২০টি দেশে সাড়ে ৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে। এই মধ্যে পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে মারা গেছে। ওই প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয় মৃতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন। শেষের দিক দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া তো আমাদের নেশার মতো। আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হই। আমরা দূষণে চ্যাম্পিয়ন হই। ডেঙ্গুতে নয় কেন!
এখন প্রশ্ন হল বাংলাদেশের ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ ও ‘ডেঙ্গু উপদ্রব’ সাধারণ আট-দশটা ঘটনার মতো নিত্য বা স্বভাবিক কোনো ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত জননিপীড়ন। সমাজ বিজ্ঞানের কাঠামোগত গণহত্যা তত্ত্বের সঙ্গে মেলালে বাংলাদেশের ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ ও ‘ডেঙ্গু উপদ্রব’ কাঠামোগত নিপীড়ন বা সহিংসতার অন্যতম উদাহরণ হয়ে ধরা পড়ে। কারণ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতার ফলে এই বিপুল প্রাণহানি। তাই এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সড়ক দুর্ঘটনা ও ডেঙ্গু নিয়ে বছরের পর বছর বাংলাদেশে যা চলছে সেটি এক ধরনের ‘যুদ্ধাবস্থা’। এ যেন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এক চলমান যুদ্ধ। যে যুদ্ধের শেষ কবে সেটা কেউ জানে না। যুদ্ধাবস্থা বলছি কারণ ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেইনের মধ্যে চলছে সত্যিকারের এক ভয়ানক যুদ্ধ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স (এওএভি) নামক একটি সংস্থার হিসেব মতে গত দশ বছরে ওই যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত ২৭ হাজার ৪৭৯ সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ১ জন। আর বাকি ২০ হাজার ৪৭৮ জন আহত। একটি প্রথাগত (কনভেনশনাল) যুদ্ধে যদি দশ বছরে ৭ হাজার মানুষের প্রাণ হারায় সেখানে বাংলাদেশে শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মারা যায় ২৫ হাজার। একে কী মহাযুদ্ধাবস্থা বললেও ভুল কিছু বলা হবে? তাই প্রতিবাদের পাশাপাশি এখন সময় এসেছে আমাদের ভাষায়ও বদল আনার। এই মৃত্যুকে মৃত্যু না বলে হত্যা বলা উচিত। এই দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলা উচিত। শুধু হত্যাকাণ্ড নয় গণহত্যা বলা উচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ফ্লিন্টবাসীর মতো আমরা এর সঙ্গে জড়িত আমাদের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে এই গণহত্যার কারণে কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে পারিনি। আমরা ব্যর্থ হয়েছি আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে।
এবার আশি বছর আগে বাংলায় সংগঠিত আরেকটি কাঠামোগত গণহত্যার উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যায়। ১৯৪৩ সাল। তখন সারা পৃথিবীতে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। বেঙ্গল তখনও ব্রিটিশ রাজের অধীন। ইতোমধ্যে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন করা এই মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। মিত্রশক্তির অন্যতম শক্ত খুঁটি এই ব্রিটিশ রাজ। রক্তক্ষয়ী এই মহাযুদ্ধের ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ইতোমধ্যে অক্ষশক্তি জাপান তৎকালীন বার্মা ও সিঙ্গাপুর দখলে নিয়ে নিয়েছে। তখন যুক্তরাজ্যের নেতারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এশিয়া অঞ্চলে তাদের সেনাদের জন্য রসদ মজুত করবে। ফলে বেঙ্গলের মানুষের খাদ্যদ্রব্য নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সৈন্যদের জন্য মজুত করতে শুরু করল। যুদ্ধের কারণে একদিকে খাবার সরবরাহে টান পড়তে শুরু করে। আবার অন্যদিকে এর আগের বছর ১৯৪২ সালের বেঙ্গলে সাইক্লোনের ফলে শরতের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে স্থানীয় খাবারের মজুতও চরমভাবে ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ রাজের বেঙ্গলের মানুষের খাদ্য সরবরাহ সংকোচন চরম খাদ্যসংকট ডেকে আনে। কৃত্রিম এই খাদ্য সঙ্কটে সৃষ্টি হয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মহামারি। খাবারের অভাবে ও অপুষ্টিতে সেই মহামারিতে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এটি পৃথিবীতে কাঠামোগত নিপীড়ন বা সহিংসতার ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল’। ১৯৪৩ সালের সেই মহামারি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নিজেই দেখেছেন। তখন তার বয়স ছিল ৯ বছর। যদিও পরবর্তীকালে তিনি তার ‘দারিদ্র্য ও মহামারি (১৯৮১)’ বইয়ে এই মহামারিকে ‘এনটাইটেলমেন্ট ফেইল্যুর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
রাষ্ট্র যদি তার জনগণের প্রতি প্রভুসুলভ আচারণ করে তাহলেই শুধু এমনটি সম্ভব। দুঃখের বিষয় প্রায় আট দশক আগে ঔপনিবেশিক শক্তি এই বাংলা ছেড়ে গেলেও জনগণের প্রতি শাসকগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সেই নিপীড়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন হয়নি আজও। আজও রাষ্ট্রের নিপীড়নে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতায় নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার। সন্তান হারাচ্ছে পিতাকে। পিতা হারাচ্ছে সন্তানকে। স্ত্রী হারাচ্ছে স্বামীকে। স্বামী হারাচ্ছে স্ত্রীকে। অথচ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একটু দায়িত্বশীল হলেই এই গণহত্যা রোধ করা সম্ভব।