বাংলাদেশের মানুষ ভারতের শুভবুদ্ধি ও আন্তরিকতাকে সবসময়ই স্বাগত জানায়। প্রতিবেশী হিসেবে তারা ভারতের কাছ থেকে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ আশা করে।
Published : 08 Aug 2024, 04:36 PM
ছাত্র-জনতার নিরস্ত্র প্রতিরোধ এবং ভীষণ রক্তপাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই লেখা লিখতে হচ্ছে। লিখছি বাংলাদেশের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনালগ্নে। জলের ধারার মতো রক্ত অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। অনেক কিশোর, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, তিনি পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারত সরকার সর্বদলীয় বৈঠক করেছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে। সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। রক্তপাত এখনো থামেনি। বাংলাদেশে অরাজক পরিস্থিতি এবং সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ভয় ও বিপদের ঘটনার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
গত কয়েকদিনে বাংলাদেশে অনেক করুণ ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে দুঃসহ সব ঘটনায়। সারা জীবনের জন্য অনেক স্মৃতি, বিভীষিকা ও বিবমিষা জমা হয়ে গেছে আমাদের মনে। একাত্তরের পর এই ধরনের রক্তপাত ও দমন-পীড়ন দেখেনি মানুষ। মানুষের এমন অভূতপূর্ব নির্ভীক জাগরণও আগে কেউ দেখেনি। এমন দুঃসহ দিনগুলোতে মানুষ স্বভাবতই বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে বেশি আলাপ-আলোচনা করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তেমন আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে, চেষ্টা করে নিজের ভেতরের দহন, ক্ষরণ, ক্ষোভ ও বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে।
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার পুরো পর্যায় ও পর্বে নানা লোকের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে নানাজনের সঙ্গে। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ নিজেদের মতো খুঁজছে নিজেদের কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার জবাব। আলোচনায় অন্যান্য দেশের কথা যত না আসছে তারচেয়ে বেশি আসছে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের প্রসঙ্গ। নানা দলমতের মানুষই আছে তাদের মধ্যে। কী বলছে তারা?
অনেক কথাই বলছে তারা। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলছে যে কথাগুলো সেগুলোই এখানে তুলে ধরা যাক। বাংলাদেশে এমন গুজবও আছে যে ভারতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা সরাসরি আন্দোলন দমনের মধ্যেও দেখা গেছে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে নেমে কেউ কেউ নাকি বাংলা বা ইংরেজি বলতে বলতে একসময় ক্ষেপে গিয়ে হিন্দি বলা শুরু করেছেন। হেলিকপ্টার থেকে ঢাকা শহরের ওপর টহল দেওয়া, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ— এসব ব্যাপারে ভারতীয় কোনো বাহিনীর গোপন তৎপরতা থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল যে ভারতের কোনো সংস্থার একটি প্রশিক্ষিত দল ছদ্মবেশে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে লোকজনকে টার্গেট করে মাথায় গুলি করে মারছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে র-এর লোকজন আছে বলেও বিপুল গুজব আছে। এসব ব্যাপারে কারও কাছে অবশ্য সুষ্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। গোয়েন্দারা যেহেতু প্রকাশ্যে কাজ করে না এবং তারা প্রেস রিলিজ, বিবৃতি কিংবা প্রকাশ্য প্রতিবেদন নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয় না, সেহেতু তাদের কাজকর্ম ও তৎপরতার সঠিক তথ্য পাওয়ার উপায় নেই। তাদের নিয়ে ভাসা ভাসা তথ্য, অপতথ্য, গুজব ও ফিসফাস থাকবেই।
বাংলাদেশ ইস্যুতে এই ধরনের প্রচারণা ও মনোভাবকে গুজব হিসেবে ধরে নিলেও কিছু বিষয় বলার থাকে। কারণ, তথ্য যেখানে অবাধ থাকে না সেখানে গুজব ও মনগড়া ধারণা দিয়ে মানুষ তার তথ্যের কৌতূহল মেটায়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, বিনা বাতাসে নদীতে ঢেউ জাগে না। নয়াদিল্লির ব্যাপারে এই যে গুজব ও সংশয় সেটি কিন্তু এমনি এমনি তৈরি হয়নি। নয়াদিল্লি দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের একটি দলের সরকারকে অকুণ্ঠ ও একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে গেছে বলেই মানুষ মনে করে। বারবার সেই দলের অবৈধ নির্বাচন, অনৈতিকতা ও অপতৎপরতাকে দিল্লির সমর্থন দিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জনগণের যে বদ্ধমূল ধারণা সেটিই বাংলাদেশের মানুষের মনে নয়াদিল্লির ব্যাপারে কিছু নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। এই ধারণা তৈরির দায় কিন্তু দিল্লি এড়াতে পারে না। এ ধারণা থেকেই গুজব তৈরি এবং গুজব কখনো কখনো হাতিয়ার হয়ে, গজব হয়েও আবির্ভূত হয়।
বিপুল ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মনেও নানা সংশয় দেখা দিয়েছে। ফাটল ধরেছে ভারতের প্রতি তাদের অন্ধ আস্থায়। ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনায় তাদেরও কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, চলমান আন্দোলন এবং ক্ষমতা হারানোর এই পরিস্থিতিতে ভারতের বিভিন্ন সংস্থার হয়তো নিষ্ক্রিয়তা ছিল। তাদের কেউ কেউ বলছেন, ভারত হয়তো পশ্চিমা দেশগুলোর বাংলাদেশ নীতির প্রতি মৌন সম্মতি জানিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বরাবর জানেন ও মানেন যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বদৌলতে আওয়ামী লীগ নামমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছর ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ছিল। ভারতের যে কেন্দ্রীয় সরকার অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় রেখেছে সেই সরকার বা তার গোয়েন্দা বাহিনী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় সবকিছু জেনেও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনে কেন জাগল এই সংশয়? এই প্রশ্নের সূত্র ধরে আরো একটু এগুনো যাক।
শুধু ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের এই সময় নয়, আগে ও পরে আরও অনেক সময়ের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় ‘র’ তথা দিল্লির গোপন তৎপরতা নিয়ে নানা গল্প-গুজব শোনা যায়। বাংলাদেশের যেকোনো ইস্যুতে যেসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মানুষের মনে গায়েবিভাবে উপস্থিত হয় কিংবা হাজির করা হয় সেগুলোর মধ্যে কোনো না কোনোভাবে দিল্লি কিংবা ‘র’ থাকে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে একটি কথা প্রবাদের মতো প্রচলিত হয়ে আছে, ‘বাংলাদেশে প্রতি চারজনের একজন র-এর দালাল।’ এ ব্যাপারে ‘র’-এর প্রথম প্রধান বি রমন তার আত্মজীবনী ‘র-এর কাওবয়েরা’ পুস্তকে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ময়দানে সদ্যগঠিত সংস্থাটির সীমিত জনবল নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন হবে বলে মনে হয়েছিল তার। কিন্তু যুদ্ধের সময় মাঠে নেমে তার উল্টো অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সামগ্রিক সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এত সহজ হতো না। এখন এসে মানুষ মনে করে, ভারতের সামগ্রিক সহযোগিতা ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের এত অন্যায় ও অন্যায্যতার পরও ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হতো না। আওয়ামী লীগেরও যেহেতু ক্ষমতায় থাকার জন্য দিল্লির অকুণ্ঠ সমর্থন দরকার ছিল সেহেতু মানুষ মনে করে আওয়ামী লীগ, তাদের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন, সমর্থকগোষ্ঠী, সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আওয়ামী সমর্থক ও সুবিধাভোগীরা ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের অনিবার্য প্রয়োজনই তাকে ভারতের সহযোগী করে তুলবে এটাও মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মনে করে। এখানে অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, একাত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে মানুষ মনে করত বাংলাদেশের সহযোগী আর এখন মনে করে, তারা আওয়ামী লীগের সহযোগী। প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের কূটনীতি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা তো বড় বিপদসংকেত।
এই প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বাংলাদেশের প্রতিদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের হাইকমিশন, ‘র’ এবং অন্যান্য সংস্থার তথ্যগত ঘাটতি থাকার কথা নয়। ২০২৪-এর জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হলো, শুরু থেকে সে আন্দোলনের তথ্য এবং সেটির গতিবিধি নিয়ে ‘র’ এবং দিল্লির বিভিন্ন সংস্থার কাছে কোনো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ থাকবে না তা তো হতে পারে না। যদি তা নিয়ে শুরু থেকেই তাদের পর্যবেক্ষণ থাকে তবে তা নিশ্চয়ই তারা দিল্লিতে পৌঁছে দিয়েছে এবং সেমতো দিল্লিও পরিস্থিতির ব্যাপারে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। যদি তেমন হয়ে থাকে, তবে হঠাৎ এমন পতনের আলামত ভারত আঁচ পারল না কেন? এই প্রশ্নই আওয়ামী লীগের লোকজনের মনে দিল্লির মনোভাব নিয়ে সংশয় জাগিয়ে দিয়েছে। তারা মনে করেছে, ভারত আর তিন তিন বারের ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতা আকড়ে থাকা আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নানা ব্যক্তিগত আলোচনায় যেসব উত্তর পেয়েছি সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে নয়াদিল্লির যা যা পাওয়ার ছিল তা তারা পেয়ে গেছে। বারবার অবৈধভাবে নির্বাচিত, প্রকারান্তরে অনির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে তাদের আর পাওয়ার কিছু ছিল না। বরং আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অপকর্মে জনগণের যে ক্ষোভ ও হতাশা তা ভারতবিদ্বেষও বাড়িয়ে তুলছিল। নয়াদিল্লির ওই মূল্যায়নও নিশ্চয়ই ছিল। সেই সংক্ষোভের প্রশমনও ভারতের জন্য ছিল জরুরি একটা কাজ। যে কারণে নয়াদিল্লি পরিস্থিতি বুঝে নতুন দিনের সরকারের দিকে কিংবা আওয়ামী লীগের শাসনবিরোধী জনগণের দিকে তাদের কূটনীতির দরজা এবং ইতিবাচক মনোভাবের দরজা খোলা রাখতে চেয়েছে। এই কারণে তারা নিজ দেশের ভেতরে যে বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি সেটিকেও পথ করে দিয়েছে। এই ধরনের আলোচনা ও গুঞ্জন কিন্তু একেবারে কম নয় গোটা বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যাপারে বরাবর ভারতের শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের একটা অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা আছে। ছোট দেশের প্রতি বড় দেশের মানুষের এই অহং ও অবজ্ঞা থাকেই। তারা বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব একটা খোঁজ-খবর রাখে না। হঠাৎ কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে তারা যখন বাংলাদেশের দিকে হঠাৎ মনোযোগ দেন তখন তাদের তথ্যহীনতা তাদের ভুল ধারণার জন্ম দেয় এবং তাদের সরকারের অবস্থানকে তারা সঠিক অবস্থান বলে ধরে নিয়ে তৃপ্ত থাকে। যে কারণে বাংলাদেশের যেকোনো পরিস্থিতিতে সচরাচর তাদের ভুল বোঝার ব্যাপার থাকে। এবার কিন্তু ঘটনা ঘটেছে একেবারে বিপরীত। ভারতের অনেক সাংবাদিক, কিছু রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন, পত্রিকা এবং ভিডিও ব্লগাররা ছাত্র-জনতার আন্দোলন সম্পর্কে যথার্থ সংবাদ ও তথ্য পেয়েছে এবং দিয়েছে। তাদের আলোচনায়ও বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলন ও হতাহতের প্রতি সহানুভূতি ছিল যথেষ্ট। বাংলাদেশ সরকারের বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার তত্ত্বে তারা এবার খুব একটা আস্থা রাখেনি বলেই মনে হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের এ ধরনের অনেক বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে ভারতের সচেতন নাগরিকদের এভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তেমন কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি। এবার কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক দল, সচেতন নাগরিক ও সাংবাদিকরাও বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলনের পক্ষে নানা কর্মসূচিও দিয়েছেন। একটা বিষয় বোঝা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে বাংলাদেশিদের প্রতিক্রিয়া ও কার্যক্রম দেখে তারা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান যে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ তীব্র করে তুলেছে সেটির বিরুদ্ধে তারা নিজেদের দেশের ভাবমূর্তির স্বার্থে একটি বিকল্প রাষ্ট্রীয় মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। নয়াদিল্লি সরকারের চেয়ে বরং তাদের এই মনোভাব বাংলাদেশে অনেক বেশি প্রতিবেশীপরায়ণ মনোভাব তৈরি করবে। এ বিষয়টি হয়তো তারা বুঝতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের শুভবুদ্ধি ও আন্তরিকতাকে সবসময়ই স্বাগত জানায়। প্রতিবেশী হিসেবে তারা ভারতের কাছ থেকে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ আশা করে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ জানে যে তিন দিকে ভারতবেষ্টিত একটি দেশ হিসেবে বিরাট প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে সে ভালো থাকতে পারবে না। সম্পর্ক রক্ষার জায়গা থেকে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক সমাজ তাই সবসময় ভারতকে সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে এগিয়ে রাখে। দুই দেশের অখণ্ড অতীত, অভিন্ন স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা, একাত্তরের সামগ্রিক সহযোগিতা, সামাজিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক অভিন্নতার কথা তারা কখনোই ভোলে না।
ভারতের নিজের ভেতরকার শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অখণ্ডতার প্রশ্নেও বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন অস্থিতিশীল থাকলে ভারতও অস্থিতিশীল হবে এটা খুব স্বাভাবিক এবং অনিবার্য সত্য। ভারতের সেভেন সিস্টারে যে অস্থিতিশীলতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে তা নিয়ন্ত্রণ করা আরও কষ্টকর হতো। আজ যে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে নতুন অর্থনৈতিক বলয় তৈরি হচ্ছে সেটিকে লাগসই করার জন্যও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও স্থিতিশীলতা জরুরি। ভারতের উত্তরের সাত রাজ্যের সঙ্গে বাকি ভারতের জীবনমান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভারসাম্য আনার জন্য যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে সেটিও বাংলাদেশের ওপর দিয়েই। বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক সরকার এবং অস্থিতিশীলতা থাকলে ভারত সেটির সুফল পাবে না। কোনো শাসকদলকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে কাগজের চুক্তি ও সমঝোতা পাওয়া যায়, সেই চুক্তি অনুযায়ী সড়ক, রেল ও নৌপথ পাওয়া যায়, কিন্তু জনগণকে বিক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট রেখে তা থেকে কোনোভাবেই কার্যকর, সুনিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের কাছে ভারত যা আশা করে তা কোনো অগণতান্ত্রিক সরকারকে দিয়ে লাগসই হবে না। সে আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক অগতান্ত্রিক সরকারই হোক কিংবা অরাজনৈতিক অগণতান্ত্রিক সরকারই হোক।
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের জনগণ, ভারত ভূখণ্ড এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে একসঙ্গে মেলায় না, আলাদাভাবে দেখে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের জনগণের অবস্থান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানকে কখনোই এক পাল্লায় মাপে না। তারা গোটা ভারতকে একদিকে রাখে আর একদিকে রাখে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়কে। তাদের কাছে দিল্লি মানেই কিন্তু ভারত নয়, যেমনটি নয় ভারতের কাছেও। ভারতের সচেতন নাগরিক সমাজ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই আস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি যে ভুল নয় তার প্রমাণও রেখেছে এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, খুবই আশার কথা যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা জুলাইয়ের এই গণ-আন্দোলনে হতাহতের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে, আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, বাংলাদেশে হত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ভারতের সচেতন নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, পেশাজীবী, রাজনীতিক এবং কিছু রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জানান দিয়েছে যে তারা সে বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। তারা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন ও আনুগত্যের চেয়ে প্রতিবেশী দেশের ভালবাসা ও আন্তরিকতার মূল্য অনেক বেশি। তাদের এই শুভবুদ্ধি, সাড়া, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতায় বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন চলা অবস্থায়ই কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছে। এই মানুষেরা আশা করে ভারতের সচেতন নাগরিক, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের এই সুচেতনা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কূটনীতিতেও প্রতিফলিত হবে। দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কূটনীতির চেয়ে জনকূটনীতির পরিসর আরও বিস্তৃত হবে।
২০২১ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় বিস্তারবাদের ব্যাপারে তার বক্তব্যে স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিস্তারবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা বিশ্বব্যবস্থায় নতুন কিছু নয়। এমনকি নয়া উপনিবেশবাদ এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদের কথা শুনতে শুনতেও এখন আমাদের কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেগুলোও এখন পুরনোই মনে হয়। ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে সে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে ওঠার পথেই আছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও তা জেনে নিয়েছে এবং তা মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষেরও তা অজানা নয়। ভারতের কেন্দ্রীয় শক্তিকেও একটা কথা জানতে হবে যে পুরনো সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় নয়া সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যায় না। তাকেও পুরনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কৌশল, কূটনীতি, ইতিহাস ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে উঠতে গিয়ে বিশশতকের প্রথমার্ধে জাপান যেসব কারণে ব্যর্থ হলো সেই কারণগুলোর পুনরাবৃত্তি ভারতকে সফল করবে না। ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী এশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী দেশটির যেসব ব্যর্থতা প্রতিবেশী জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে, ঠেলে দিয়েছে ইউরোপ তথা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের যেন সে অবস্থা না হয়, সে-ও তার কোনো ভুল পদক্ষেপে প্রতিবেশী বাংলাদেশকে অন্য বলয়ে যেন ঠেলে না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সংবেদনশীল দৃষ্টিতে।