মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি এককভাবে জিততেই অভ্যস্ত। শরিকদের ওপর নির্ভর করে এবং তাদের ভরসায় রাজ্য বা কেন্দ্র কোথাও সরকার চালাননি তিনি। তাই মোদীর জন্য চ্যালেঞ্জটা অনেক বড় এবার।
Published : 05 Jun 2024, 06:04 PM
ভারতের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকার আদৌ কী ক্ষমতা টিকাতে পারবে নাকি জোটের আজ্ঞাবহ দাস হবে? বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়াতেই এসব প্রশ্ন উঠছে সবার মনে। তদুপরি কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের অসাধারণ কামব্যক চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে শাসক শিবিরে। ভারতে এবারের নির্বাচনের ফলাফল জটিল সমীকরণে আবদ্ধ হয়েছে। দশ বছর আগের চিরায়ত দর কষাকষি পদ্ধতি আবারও চালু হয়েছে। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, এটি আসলেই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বিনির্মাণ ও গণতন্ত্রকে স্বাস্থকর করার লক্ষণ। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের রোল মডেল হতে এই বিষয়গুলো এখন অত্যাবশকীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই মেয়াদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদীর স্বেচ্ছাচারিতা ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে জনগণের মাঝে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখছেন বিশ্লেষকরা।
এনডিএ জোটের তুলনামূলক খারাপ ফলাফলের কারণ উচ্চ বেকারত্ব, দল ভাঙানো, বিভাজনের রাজনীতি, দীর্ঘদিন ধরে ভোট গ্রহণ, বিরোধীদের ইডি-সিবিআই দিয়ে দমন, আঞ্চলিক সমস্যা সমাধান না করা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথিত অভিযান পরিচালনা। অন্যদিকে কংগ্রেসের ভালো ফলের কারণ রাহুলের দূরদর্শী তারুণ্য নেতৃত্ব, ভারত জুড়ে ক্যাম্পিং, জনমুখী ইশতেহার, মুসলিমদের জন্য আলাদা প্রকল্প চালুর ঘোষণা, করপোরেট সংস্থার তোষামোদী বন্ধ করার মতো গণমুখী উদ্যোগ হাতে নেওয়া।
ভোটের ফলপ্রকাশের পরপরই সন্ধ্যায় ‘জয় জগন্নাথ’ দিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন নরেন্দ্র মোদী (ঘটনাচক্রে এবার ওড়িশায় বিপুল জয় পেয়েছে বিজেপি যার জন্য জয় জগন্নাথ বলা)। তৃতীয়বার এনডিএ জোট কেন্দ্রে সরকার গড়ার জাদুসংখ্যা পেরিয়ে যাওয়ার পর মোদীর ৩৪ মিনিটের বক্তৃতায় একবারও ‘জয় শ্রীরাম’ বললেন না। রাম মন্দিরের কথা বললেন যদিও। বিজেপি নয়, জোর দিলেন এনডিএ নামক জোটের ওপর। তার ভাষণে বার বার শোনা গেল জোট শরিকদের অভিনন্দন দেওয়ার স্তুতি।
লোকসভা নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনের মতো এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে পারেনি বিজেপি। তাই নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় মেয়াদ নির্ভর করছে এনডিএ-এর দুই শরিক, চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এবং নীতিশ কুমারের জেডিইউ-এর ওপর। ঘটনাচক্রে, অতীতে ওই দুই নেতারই একাধিকবার এনডিএ ত্যাগের এবং প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস রয়েছে। ভারতের ইতিহাসে মোদীই হতে চলেছেন দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি পর পর তিনবার ক্ষমতায় এলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জওহরলাল নেহরুর মতো পর পর তিনবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখলের রেকর্ড করা সম্ভব হলো না তার। যদিও মোদী একাধিকবার দাবি করেছিলেন, এককভাবে বিজেপি ৩৭০ আসনে জিতবে। ওই টার্গেট তো দূরের কথা, ২৪০ পার করাও কঠিন হয়েছে এবারে পদ্মশিবিরের। একাধিক এনডিএ শরিকের ওপরে নির্ভর করতে হবে বিজেপিকে, যা বিজেপির জন্য পুরানো হলেও মোদীর জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আদৌও মোদী কী পারবে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে? নাকি হ্যান্ড পার্লামেন্টের মতো, দোদুল্যমান অবস্থায় থাকবে। মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি এককভাবে জিততেই অভ্যস্ত। শরিকদের ওপর নির্ভর করে এবং তাদের ভরসায় রাজ্য বা কেন্দ্র কোথাও সরকার চালাননি তিনি। তাই মোদীর জন্য চ্যালেঞ্জটা অনেক বড় এবার।
ভারতের দুই প্রবীণ রাজনীতিক বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ও অন্ধ্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইডু। তাদের জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) ও তেলুগু দেশম পার্টির (টিডিপি) সমর্থন ছাড়া বিজেপির পক্ষে যে কেন্দ্রে সরকার গড়া সম্ভব নয়, সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর তারা সত্যিই শেষপর্যন্ত বিজেপিকে সমর্থন করেন, নাকি আরও একবার ‘পাল্টি’ খাবেন, তা নিয়েও বাড়ছে জল্পনা। এ দুজনই তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এতবার বিজেপির সঙ্গ ছেড়েছেন এবং ধরেছেন যে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও ওই হিসাব রাখতে হিমশিম খান রীতিমতো।
চন্দ্রবাবু নাইডুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বিজেপিকে ‘ল্যাজে খেলানোর’ ইতিহাস খুবই পুরনো। সেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময় থেকে তিনি এটা করে আসছেন। বাজপেয়ীর বিজেপি সরকারকে সমর্থনের বদলে একের পর এক সুবিধা তিনি আদায় করেছেন, আবার একপর্যায়ে বিজেপির সঙ্গ ছাড়তেও দ্বিধা করেননি তিনি। ৭৪ বছর বয়সী চন্দ্রবাবু নাইডু নরেন্দ্র মোদীর প্রায় সমবয়সী। তিনি হলেন অন্ধ্রের প্রবাদপ্রতিম চিত্রতারকা ও এককালের মুখ্যমন্ত্রী এন টি রামারাওয়ের (এনটিআর) জামাতা— যিনি নিজে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য স্বয়ং শ্বশুরের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা’ করতেও দ্বিধা করেননি। একটা সময় চন্দ্রবাবু ছিলেন অবিজেপি, অকংগ্রেস ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’-এর শীর্ষ নেতা, আবার পরে চলে আসেন বিজেপি শিবিরে। মাঝে বহুদিন বিজেপিকে ছেড়ে দিলেও এবার নির্বাচনের ঠিক আগে তিনি তেলুগু চিত্রতারকা পবন কল্যাণকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপির হাত ধরেন। কিন্তু ভোটের পরও চন্দ্রবাবু বিজেপির সঙ্গেই থাকবেন তার কোনও গ্যারান্টি নেই। তার ট্র্যাক রেকর্ড অন্তত তাই বলছে।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, ৭৩ বছর বয়সী নীতিশ কুমারের সম্পর্কেও প্রায় একই কথা খাটে। সেই ২০০৫ সাল থেকে গত আঠারো বছর ধরে তিনি একটানা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এই দীর্ঘসময়ে কখনও তার দল জেডিইউ-এর বিধানসভায় গরিষ্ঠতা ছিল, কখনও ছিল না। তাতে কিন্তু নীতিশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রী থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি। কখনও বিজেপির হাত ধরে, কখনও কংগ্রেস-আরজেডির মতো দলের হাত ধরে তিনি ঠিকই পরিস্থিতি ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছেন। গত এক দশকেই তিনি দু-বার বিজেপির হাত ধরেছেন এবং দু-বার আরজেডি-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। বিজেপির সঙ্গে নীতিশ কুমারের শেষ সমঝোতা হয়েছে লোকসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগেই। কিন্তু নির্বাচনের ফলে বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সেই সমঝোতা ভোটের পরও টিকবে কিনা এমন নিশ্চয়তা নেই কারণ চরিত্রটির নাম নীতিশ কুমার। ভারতীয় রাজনীতির এই দুই বর্ষীয়ান দিকপাল শেষ পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নেবেন ওই উত্তর কেবল তারাই জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা দুজনই যে পাশা খেলার গুটি সে বিষয়ে সবাই ওয়াকিবহাল।
অন্যদিকে, এই লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের দুর্দান্ত কিছু বিজয় জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের পুরানো প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে আনছে বলে দাবি বিশ্লেষকদের। বিরোধী দলনেতার পদের জন্য লোকসভায় ৫৫টি আসনে জেতা প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৪-এ ৪৪টি এবং ২০১৯-এ ৫২টি আসনে জেতা কংগ্রেস সংসদীয় বিধি অনুযায়ী ওই মর্যাদা পায়নি। এবার ভোটে এককভাবে ৯৯টি আসনে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধীর দল। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সব সহযোগী দল মিলে ২৩৩টি আসন টপকাতে পেরেছে। ফলে লোকসভার অধিবেশনেও এবার বিরোধীদের কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে মোদীকে। মাত্র একবছর আগে গড়ে ওঠা কংগ্রেস, তৃণমূল, আম আদমি, বাম-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির যৌথমঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) জোট।
এক্সিট পোল বা বুথফেরত সমীক্ষা সবসময় যে একশ শতাংশ মেলে না তার প্রমাণ এ নির্বাচন। ২০০৪ সালের বুথফেরত সমীক্ষা বিজেপিকে ২৪০-২৭৫ আসনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল কিন্তু অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিজেপি ১৩৮ আসন পেয়েছিল। তারা ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ স্বপ্ন বেঁচেও সরকারে ফিরতে পারেনি। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার গড়েছিল। ২০১৪ সালেও এনডিএকে ২৬১-২৮৯ আসন দিয়েছিল বুথফেরত সমীক্ষা। বিজেপির নেতৃত্বেই এনডিএ সরকার গড়েছিল বটে, কিন্তু তাদের আসন সংখ্যা ৩৩৬-এ পৌঁছে গিয়েছিল।
২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হবে বলে জানিয়েছিল বুথফেরত সমীক্ষা। কিন্তু বিজেপি ৩২৫ আসন জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গড়েছিল। আর ২০১৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বুথফেরত সমীক্ষা আর আসল ফলাফলের কথা সবার মনে থাকার কথা। সেখানেও ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সম্ভাবনার কথা বলেছিল ভোট শেষের পর করা সমীক্ষা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় জনতা দল (ইউনাইটেড) ও কংগ্রেসের সরকার হয় সেখানে। রাষ্ট্রীয় জনতা দল সবচেয়ে বেশি আসনে জেতে। এরকম অনেক উদাহরণ হাতের সামনে আছে যেখানে বুথফেরত সমীক্ষার উল্টো ফল হয়েছে ভোটগণনার পর।
নরেন্দ্র মোদীর রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বিলুপ্তি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) প্রতিশ্রুতি পূরণ, এক দেশ এক ভোট, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর, ৪০০ পার টার্গেটের স্লোগান এ সবকিছু ধরাশায়ী হলো কংগ্রেসের ভারতব্যাপী নবজাগরণের মধ্য দিয়ে। ভারতের ১৮তম লোকসভার ফল জানিয়ে দিল এই প্রথমবার সহযোগীদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে সরকার গড়তে হবে বিজেপিকে। ভারতের জনসংখ্যার নিরিখে তিনটি বৃহত্তম রাজ্য যথা উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শোচনীয় ফলাফল অনেকটাই চাঙ্গা করেছে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটকে। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি-কংগ্রেসের জোট, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস-শিবসেনা (উদ্ধব ঠাকরে)-এনসিপি (শরদ পওয়ার)-এর ‘মহাবিকাশ অঘাড়ী’ ধাক্কা দিয়েছে মোদীর দলকে।
কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের আসন আরও বাড়ত যদি সমঝোতার পরিসর মসৃণতর হতো বিহার, দিল্লি এমনকি মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে। আগামী দিনে কংগ্রেসের ভূমিকা কতটুকু শক্তিশালী হবে তা দেখতে মুখিয়ে আছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। যারাই ক্ষমতায় আসুক দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নিরাপত্তায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।