নতুন মন্ত্রীরা আশার আলো দেখালেও সবকিছু নির্ভর করবে সুশাসনের ওপর। যে সুশাসন নয়া মন্ত্রী বা বদলে যাওয়া দপ্তরের মন্ত্রীদের পাশাপাশি নির্ভর করবে তাদের বাকসংযম, পরিমিতিবোধ আর কাজের ওপর।
Published : 14 Jan 2024, 05:25 AM
নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে আমাদের আশার কারণগুলো কী কী? দেশের রাজনীতি সঠিক পথে চলছে— এমন বলাটা মুশকিল। পথের কাঁটা হয়ে আছে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতি। মূলত পাকিস্তান ভাঙার আক্রোশ আর দ্বিজাতিত্ত্বের কারণে এই রাজনীতির পালে হাওয়া লেগেছিল। মজার বিষয় বয়স্কদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত। এদের কথায় দেশ চলে না। চলবেও না। ইতিহাস বলছে এরা সুযোগ পেয়েছিল। দখল করে, আধিপত্য বিস্তার করে সামরিক-বেসামরিক ছত্রচ্ছায়ায় এরা ক্ষমতার দাপট দেখাতে কসুর করেনি। কিন্তু দিনশেষে তারা টেকেনি। কারণ রক্তমাখা ইতিহাস আর দেশ তাদের ভোলেনি। ভোলেনি তার আত্মত্যাগী সন্তানদের কথা।
শেখ হাসিনার হাতেই রয়ে গেছে দেশের কর্তৃত্ব। তিনি যেসব পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন বা করেছেন তাঁর দিকে তাকালেও অনেক সরকারপ্রধানের হাত-পা কাঁপবে। কিন্তু সবকিছু সামাল দিয়ে আজ টানা চতুর্থ মেয়াদে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। এটা মানতেই হবে সবার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। জনবহুল দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সমাজ ও দেশের সরকারপ্রধানের কাজ সহজ নয়। তারপরও গুজবের ডালপালা সরিয়ে শেখ হাসিনা এগিয়ে চলেছেন। তাঁর কথা স্পষ্ট ও সরাসরি। মাঝে মাঝে তা আমাদের হতবাক করলেও পরে ঠিকই টের পাওয়া যায় কী কারণে এবং কেন তিনি তা বলেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যে আওয়ামী লীগ তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত তার ভিত্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাসে দলটি এগিয়েছে নানা আলোচনা ও সমালোচনার ভেতর দিয়ে। একসময় এমনও দেখেছি আওয়ামী লীগের মানুষজনই বাকশাল করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট করেছে। সেসব ঘটনার পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটের উদ্দেশ্য ছিল দলটিকে নির্মূল করে ফেলা। সে আশা পূর্ণ হয়নি। আজ আওয়ামী লীগই ইতিহাসে সবচেয়েবেশি সময় দেশ শাসনের গৌরবে গৌরবান্বিত এক দল।
বর্তমান মন্ত্রিসভার কাজ শুরু হলে এবং সময় গেলে তার মূল্যায়ন করা যাবে। কিন্তু এটা বলতেই হয়, এবারের মন্ত্রিসভায় বেশ কিছু মুখ আর তাদের পদবি আমাদের উৎসাহিত করে তুলেছে। শুরুতেই বলব চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান নওফেলের কথা। প্রয়াত মেয়র জননেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্রটি এবার শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। এর আগেও একই মন্ত্রণালয়ে ছিলেন, কিন্তু পূর্ণ মন্ত্রীত্ব ছিল না। তার এই পদায়ন আমার মতে সেরা সিদ্বান্ত। কথা শুনলেই আপনি বুঝবেন তিনি কতটা শিক্ষিত আর চমৎকার জ্ঞানসম্পন্ন। দীর্ঘসময় বিদেশে পড়াশোনা করা এবং ব্যক্তিজীবনে আধুনিক এই যুবকের হাতে আমাদের শিক্ষা যে তার সীমাবদ্ধতা দূর করেতে পারবে এটা ভাবাই যায়। যিনি পদে আসীন হবার পরই বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মানে জমি অধিগ্রহণ, বিল্ডিং নির্মাণ বা শিক্ষক নিয়োগ নয়। মূল বিষয় লেখাপড়ার মান। কথাতেই এমন বহুমাত্রিক, গতিময়, প্রাণবন্তা তরুণকে এই পদে নিয়ে আসার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।
পরিবেশ ও জলবায়ু এখন একটি গ্লোবাল ইস্যু। যে ইস্যুতে আমরা দোষী না হয়েও ভুক্তভোগী। আমি বলছি বাংলাদেশের কথা। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো দায়ী না হয়েও গ্লোবাল এই ইস্যুতে কোণঠাসা। তা ছাড়া দেশের জলবায়ু বা পরিবেশ নিয়েও সমস্যার অন্ত নেই। এই জায়গায় কাজ করার জন্য দরকার ছিল বহুমাত্রিক প্রতিভার একজন ভদ্রলোকের। যার পরিচয় বাঙালি হয়েও আন্তর্জাতিক। সাবের হোসেন চৌধুরী সুদর্শন এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তাঁর হাতে এই মন্ত্রণালয় যে নতুন রূপ লাভ করবে তা বলাই বাহুল্য।
এবারের চমক টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী হয়ে আসা ডা. সামন্ত লাল সেন। পারিবারিকভাবে তাঁকে জানি। দেখা না হলেও তাঁর কথা এবং গল্প শুনেছি অজস্রবার। মন্ত্রী হবার আগেও তিনি শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের হয়ে দেশ ও জাতির নজর কেড়েছেন। কখনো রাজনীতি না করলেও তাঁর সেবা আর পরিশ্রম আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে। বিশেষত বিএনপি জোটের ধ্বংসাত্মক জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতিতে যখন দেশে আগুন সন্ত্রাসের বিভীষিকা তৈরি হয়েছিল, তখনই তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন ত্রাণকর্তার মতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাঁটি জহুরি। ডা. সামন্ত লাল সেনের নির্বাচন যে স্বাস্থ্যখাতের জন্য জরুরি ছিল সময় সেটাই বলে দেবে বলে আশা করা যায়। আপামর মানুষ এই পদায়নকে অভিনন্দন জানিয়েছেন অকুন্ঠচিত্তে।
সবচাইতে কঠিন অবস্থায় পড়ার কথা অর্থমন্ত্রীর। একদা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মোহাম্মদ আলী কীভাবে সামাল দেন সেটা হবে দেখার বিষয়। বাংলাদেশের আর্থিক খাত আছে সবচাইতে নাজুক অবস্থায়। ব্যাংক, বীমাসহ প্রায় সব জায়াগতেই সীমাহীন দুর্নীতি। মানুষজনের মনে ব্যাপক ক্ষোভ। তাদের মনে ভয়ও আছে প্রচুর। দেশে-বিদেশে ছড়ানো গুজবের ১০ শতাংশও যদি সত্য হয় তাতে বুঝতে হবে আর্থিক খাতের অবস্থা করুণ। সহজ হবে না গুছিয়ে আনা।
নতুন মন্ত্রীরা আশার আলো দেখালেও সবকিছু নির্ভর করবে সুশাসনের ওপর। যে সুশাসন নয়া মন্ত্রী বা বদলে যাওয়া দপ্তরের মন্ত্রীদের পাশাপাশি নির্ভর করবে তাদের বাকসংযম, পরিমিতিবোধ আর কাজের ওপর। বাদ পড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাই বলি না কেন। ভদ্রলোক দায়িত্ব পাবার কিছুসময় পর থেকেই লাগামহীন কথা বলতে শুরু করেছিলেন। প্রতিবেশী ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক নাজুক হয়ে পড়ে মাঝে মধ্যেই। সেটা কার দায় সে আলোচনায় না গিয়েও বলা যায় এ বিষয়ে যত কম বলা যায় বা যতটা সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায় সেটাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। কিন্তু তিনি এসবের বাইরে গিয়ে এমন সব হাস্য রস ও বিতর্কের জন্ম দিতেন যা সরকার ও দেশের ভাবমূর্তিকেই বিপদে ফেলে দিত। তাকে সরিয়ে দেয়াটা মানুষ পছন্দ করেছে। যেমন করেছে বাণিজ্যমন্ত্রীর অপসারণ। আপনি কাজ করতে এসে উঠোন বাঁকা বলবেন, সিন্ডিকেট থাকবে বলে বিপদে ফেলবেন সেটা কি সম্ভব না গ্রহণযোগ্য?
মোটকথায় শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা ও নেতৃত্বে আবার আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নিতে পেরেছে। যে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত পিটার হাসের হাসিমাখা ছবিও দেখছি আমরা। রাজনীতির এসব সমীকরণ জটিল। যারা ভাঙচুর করে বিদেশিদের আশায় রাত গুজরান করেছে তাদের জন্য এখন করুণা ছাড়া আর কিছুই হয় না। জনগণের সুপ্ত ইচ্ছা বা দ্রোহকে ন্যায়সঙ্গত করাটাই রাজনীতির দায়িত্ব। বিএনপি তা পারেনি। আগামী পাঁচ বছর তাদের অস্তিত্ব টিকিয়েরাখার লড়াই।ওই যুদ্ধে জয়ী না হলে অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে দলটির।
প্রবাসীদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী শফিকুর রহমানের কাছে অনুরোধ, আমরা আনুকূল্য চাই না। আমাদের দরকার নিরাপত্তা আর হয়রানিমুক্ত ভ্রমণ। যথাযথ সম্মান আর মর্যাদা। রেমিটেন্স নিয়ে আসাা প্রবাসীদের শক্তিকে সম্মান ও স্বাগত জানালেই তা সম্ভবপর হতে পারে। নতুন মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরা কাজ শুরু করলেই আমরা টের পাব কোথাকার পানি কোথায় গড়াবে। তারপরও আশাই জীবন। ভালো কিছুর আশা মানুষ করতেই পারে।