দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়েরা দেশকে অশান্ত করে তাদের কায়েমী স্বার্থ হাসিল করতে চায়। বুঝে বা না বুঝে কেউ যদি এই অদৃশ্য ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে সংকটকে আরও তীব্রতর করে তোলে, তাহলে সর্বনাশ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
Published : 22 Mar 2025, 08:05 PM
দেশে অস্থির ও দমবন্ধ অবস্থা নতুন নয়। কিন্তু যখন মনে করা হচ্ছিল, এই অস্থিরতা ও দমবন্ধ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি মিলবে আমাদের, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এটি যেন কোনো ভয়ঙ্কর ঝড়ের পূর্বমুহূর্ত, যে কোনো সময় এই পরিস্থিতি বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। দেশের সর্বত্রই সংকটের ছায়া। রাজনীতিতে সুখবর তো দূরের কথা, বরং অস্থিরতা বাড়ছে।
দেশ পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের ওপর বর্তায়। কিন্তু এখন অবস্থা এমন যে, অদৃশ্য সুতার টানে যেন সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অথবা নিয়ন্ত্রণহীনতা চলছে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সুনির্দিষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোরও অনেকেই স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালাতে পারছে না। ঘৃণা-বিদ্বেষ, নানা ধরনের কলঙ্কের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা আছে আপাতত অস্তিত্বের সংকটে। অন্যদিকে রাজনীতির মাঠে আপাতত যারা সক্রিয়, তাদের কেউ কেউ অর্বাচীন, কেউ কেউ আবার উগ্রপন্থী— এমন বাস্তবতায় রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার জন্য, সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যে বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতা প্রয়োজন, তা দেখা যাচ্ছে না।
একটি রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। কোনো সহজ কাজ নয়। দেশ কোনো ক্লাব বা পেশাজীবী সংগঠন নয়। দেশ একটি বিশাল ব্যবস্থা, যেখানে কোটি কোটি মানুষ, হাজার হাজার গোষ্ঠী, মত এবং চাহিদা রয়েছে। সামর্থ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সবাইকে শান্ত রাখতে হয়। কাউকে ভয় দেখিয়ে, কাউকে আইন দেখিয়ে, আবার কাউকে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত রাখার কাজটি রাজনীতিবিদদের। তারা এই কাজটি করায় অভ্যস্ত, করে থাকেন সবসময়। এখানে হাজারও গোষ্ঠী, ভিন্ন মতাদর্শ ও জনগণের স্বার্থ জড়িত থাকে। দেশ পরিচালনার জন্য কৌশলী ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। রাজনীতিবিদ ছাড়া দেশ চালানো যায় না। অন্তর্বর্তী সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা সেনাবাহিনী শুধুই দুর্দিনের সাময়িক সমাধান হতে পারে। হাল্কা বৃষ্টিতে গাছের পাতার নিচে কিছুক্ষণ আশ্রয় নেওয়ার মতো। কিন্তু স্থায়ী সমাধান নয়। রাজনীতি হলো সেই ছাউনি, যেখানে প্রবল ঝড়বৃষ্টি এলেও আশ্রয় প্রত্যাশা করা যায়।
কে বা কারা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা এক ধাঁধা। নির্বাচন কবে হবে, তা বলা হলেও আসলে কবে নির্বাচনটি হবে, এর কোনো স্পষ্ট রূপরেখা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের তরফে ডিসেম্বরের কথা বলা হলেও জনগণ তা বিশ্বাস করছে বলে মনে হচ্ছে না। উল্টোদিকে সমস্যা ও সংকট দিন দিন বাড়ছে। এক ধরনের দমবন্ধ অবস্থা। ঝড়ের পূর্বমুহূর্তের এই নিস্তব্ধতা ভেঙে যে কোনো সময়ে সবকিছু উল্টেপাল্টে যেতে পারে।
দেশ ও জাতির জন্য তেমন কোনো সুখবর না থাকলেও মারামারি-সংঘাতকে উসকে দিতে নতুন নতুন ফ্রন্ট খোলা হচ্ছে। রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশের পর এবার টার্গেট করা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। শুরু করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির শীর্ষনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি ফেইসবুক পোস্ট দিয়ে। পরে অন্যরাও যুক্ত হয়েছেন। হাসনাতের দাবি, গত ১১ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। তার মতে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য আসন সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং একাধিক রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবে শর্তসাপেক্ষে রাজি হয়েছে। তবে এই অভিযোগের পক্ষে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ তিনি দেননি।
হাসনাত আবদুল্লাহ আরও দাবি করেছেন, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে গঠন করা হবে, তারা এপ্রিল-মে মাস থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে এবং হাসিনাকে অস্বীকার করবে। তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করার প্রতিশ্রুতি দেবে। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও তাদেরকে বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার তাদের নিতে হবে। হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্ট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। তার অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। কিন্তু এই দাবি কতটা যৌক্তিক? সেনাপ্রধান সত্যিই আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করেছেন কিনা, তা নিয়ে কোনো স্বচ্ছ প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের অভিযোগ সেনাপ্রধানকে নিয়ে হাসনাতদের যত সমালোচনা। কিন্তু সরকার প্রধান যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না বলে সিদ্ধান্তের কথা জানালেন– এ নিয়ে তারা নিশ্চুপ কেন? এই দ্বিমুখী অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এমনিতেই হাসনাত আবদুল্লাহর দাবির কোনো প্রমাণ নেই। ক্যান্টনমেন্টের যে বৈঠকের কথা তিনি বলেছেন, সেখানে কার বা কাদের সাথে কথা হয়েছে সেটি তিনি বলেননি। ওই বৈঠকে তিনি ছাড়া তার দলের অন্য কে উপস্থিত ছিলেন সেটিও তার স্ট্যাটাসে উল্লেখ নেই।
এ ধরনের কার্যকলাপ একশ্রেণির মানুষকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। দেশের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য যা রীতিমতো হুমকি। এমনিতেই দেশে এখন নানাবিধ সংকট চলছে। দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়েরা দেশকে অশান্ত করে তাদের কায়েমী স্বার্থ হাসিল করতে চায়। বুঝে বা না বুঝে কেউ যদি এই অদৃশ্য ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে সংকটকে আরও তীব্রতর করে তোলে, তাহলে সর্বনাশ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে সকলের উচিত অত্যন্ত দায়িত্বশীল আচরণ করা। কারও ফাঁদে পা না দেওয়া। এখন আসলে দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পুনরাভিষেক দরকার। যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো সহজে অরাজকতা তৈরি করে। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে একটি চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলে এর দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
দেশ আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতির ছাউনিতে ফিরতে হবে। রাজনীতিবিদদেরই এই দায়িত্ব নিতে হবে। নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।