নতুন রাষ্ট্রপতি: কিছু গল্প, কিছু প্রত্যাশা

নতুন রাষ্ট্রপ্রধানকে অভিনন্দন। ভরসা করি তার আমলে দেশে ন্যায্য অধিকার আর মানুষের সদিচ্ছার জয় হবে।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 25 April 2023, 06:01 PM
Updated : 25 April 2023, 06:01 PM

নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শপথ নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছেন মো. আবদুল হামিদ। পরপর দু-মেয়াদ পূর্ণ করার পর এমন বিদায় বাংলাদেশের আর কোনো রাষ্ট্রপতির জোটেনি। সেদিক থেকে তিনি ভাগ্যবান। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সুরসিক মানুষ। তাঁর আমলে আর কিছু হোক বা না হোক নির্মল আনন্দ জুটেছে জাতির ভাগ্যে। কথার ফোয়ারা ছোটানো বিদায়ী রাষ্ট্রপতি খাঁটি কিশোরগঞ্জের উচ্চারণে কথা বলতেন। আমি যতগুলো ভাষণ শুনেছি তার সিংহভাগই ছিল ব্যক্তিজীবনের গল্প। যে বিষয়টি সবচেয়ে ভালো লাগত, তিনি নিজেকে নিয়ে হিউমার করতে জানেন। কোথাও পড়েছিলাম, যে মানুষ নিজেকে নিয়ে কৌতুক করতে জানেন তিনিই মূলত বিজ্ঞ মানুষ।

হামিদ সাহেব ছাত্রজীবনের অকৃতকার্যতা আর রাজনৈতিক জীবনের টানাপোড়েনের গল্প বলতেন অকপটে। সমাবর্তনগুলোতে তাঁর অকৃতকার্যতার রসময় গল্পে জমজমাট থাকত পরিবেশ। পাশাপাশি মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতেন তিনি। কখনো কখনো দারুণ রসিকতা হয়ে যেত নিদারুণ কৌতুক। নিন্দুকেরা আড়ালে-আবডালে চোখ বাঁকিয়ে হাসত। কারও কারও মতে তাঁর বলা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার গল্প ছিল না মানানসই।

রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদবিধারী মানুষ। তিনি দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতীক। ওই কারণে সরকারের নিন্দা বা সমালোচনা করা গেলেও এই পদটির সমালোচনা প্রকারন্তরে নিষিদ্ধ। কিছুদিন আগে ইউটিউবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নয়া রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ভাষণ শুনেছি। অকুতোভয় এই নারীর জীবন সংঘাত আর সমস্যায় ভরা। ব্যক্তিজীবনও দুঃখের এক গল্প। স্বামী-সন্তান হারানোর পর প্রায় সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া দ্রৌপদী মহাভারতের সেই নারীর মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে আজ ভারতের মতো বিশাল দেশের রাষ্ট্রপতি। তাঁর আদব-কায়দা, কথা বলার ধরন এত স্বাভাবিক যে, দেখে মনে হতে পারে উনি কি সত্যি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান?

ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু কলকাতা সফরকালে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন ওই ভাষণটির কথাই বলছি। বঙ্গীয় মনীষীদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার স্ফুরণ যেমনি, তেমনি মনে লেগেছে তাঁর সরল অথচ ঋজু ভূমিকা। এমন একজন মানুষ অনায়াসে মনে করিয়ে দেন, সহজ জীবন ও উচ্চ চিন্তার সোনালি দিনের কথা। এই আড়ম্বরহীনতা আজকাল আমাদের সমাজে নেই।

একটি সত্যি গল্প বলি। মনে হবে কোনো এক রূপকথার গল্প বলছি! ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিনসহ বর্তমান বিশ্বের অনেক নেতা যখন নিজ নিজ দেশে নিজেদেরকে আরও ক্ষমতাবান করতে নানামুখী আয়োজনে ব্যস্ত ওইসময়ে আমাদের পাশের দেশ শ্রীলঙ্কায় একজন রাষ্ট্রপতি নিজের অনেক ক্ষমতা কেটে-ছেঁটে ফেলেছেন। এমনকি সব ক্ষমতা অন্যদের ওপর দিয়ে তিনি নিজেকে ক্ষমতাহীন করতে চেয়েছিলেন! রাষ্ট্রপতি পদকে আলঙ্কারিক পদে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্যদের বিরোধিতার মুখে তাঁর ইচ্ছার পুরো বাস্তবায়ন হয়নি।

শ্রীলঙ্কার ওই রাষ্ট্রপতি সিরিসেনার আমলে সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের বিধান চালু করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে কেউ দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। সংসদ, নির্বাহী এবং বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করতে রাষ্ট্রপতির আগের ক্ষমতার সংকোচন হয়েছে। কয়েকটি স্বাধীন কমিশন গঠনের বিধান করা হয়েছে যাতে বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ ছয় বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। শপথ নেওয়ার পরই সিরিসেনা ঘোষণা করেন যে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে নামবেন না। দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে তিনি তাঁকে ‘হিজ এক্সিলেন্সি’ এবং তাঁর স্ত্রীকে ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে সম্বোধন না করতে জনগণের প্রতিও আহবান জানান।

পৃথিবীতে এমনও অনেক দেশ আছে যে দেশের অনেক মানুষ জানেই না কে তাদের রাষ্ট্রপতি। তাদের কথা হলো, কেন জানতে হবে? জানলে ভালো আর না জানলেও কোনো লাভ-লোকসান নেই। আমাদের সমাজ মুখে যতই যা বলুক এখনো রাজনীতিনির্ভর। বিগত দুই দশকে রাজনৈতিক নেতারা জনগণের মনে কতটা আছেন বা নেই সেটা যতটা বড় বিষয় তার চেয়েও বড় ব্যাপার মিডিয়া এখনো রাজনীতি নিয়েই সরগরম। এ ছাড়া এখন আর কোনো বিনোদনও নেই। ফলে আমাদের দেশের এবং দেশের বাইরের বাঙালিদের জানতেই হয় কে নেতা কে নেতার চাইতে বড়। অথচ যে বিষয়টা চাপা পড়ে যায় সেটি হচ্ছে কল্যাণ আর জনমুখী নেতৃত্বের গল্প।

প্রণব মুখার্জী ছিলেন ভারতের বাঙালি রাষ্ট্রপতি। কংগ্রেস নেতা প্রণব বাবু বিজেপির মতো ঘোর রাজনৈতিক শত্রুর আমলে দাপটের সঙ্গে তার পদে ছিলেন। তার যে একটা দিক সবচাইতে আকর্ষণীয় মনে হতো। প্রেসিডেন্ট হাউজের বিশাল বাড়িতে মূলত দাপ্তরিক কাজের পর একা থাকা মানুষটি বলেছিলেন, এটাই সুযোগ এই অখণ্ড অবসরে তিনি সেখানকার লাইব্রেরির বইগুলো পড়ে শেষ করতে পারবেন। কতটা পেরেছিলেন জানি না কিন্তু তার কথা শুনলেই বোঝা যেত তিনি পড়াশোনা করেন। যেমনটি আমরা বিশ্বের বহুদেশের প্রেসিডেন্টের বেলায় দেখি। ইন্দোনেশিয়ার টালমাটাল রাজনৈতিক সময়ে সুহার্তো যখন বিদায় নিলেন তখন ওই দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন ইসলামিক স্কলার আবদুর রহমান ওয়াহিদ।

দোরগোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউ দেয়া আবদুর রহমান ওয়াহিদকে অনেককাল মনে থাকবে আমার। হাফ প্যান্ট পরিহিত প্রায়ান্ধ এই ভদ্রলোক আরব ইসরায়েল যুদ্ধ ও সংঘাত নিয়ে কী মূল্যবান সব কথা বলেছিলেন ওইদিন। তার মতে ফিলিস্তিন সমস্যা ওই দেশের রাজনৈতিক সমস্যা। এর জন্য যুদ্ধের যেমন দরকার নেই, তেমনি প্রয়োজন নেই দেশে দেশে হিংসা আর উত্তেজনার। চমকে দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন চীন-রাশিয়ার মতো স্বীকৃত ধর্মহীন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী দেশের সঙ্গে কেন কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে না মুসলিম দেশগুলোর? ইন্টারভিউয়ের শেষপর্যায়ে আবদুর রহমান ওয়াহিদ বলেছিলেন শেষজীবন তিনি মোজার্টের সিম্ফনি শুনে কাটিয়ে দেবেন। জানি না তিনি এখনো বেঁচে আছেন কি না?

বাংলাদেশেও আমরা জ্ঞানী বিবেচক ঋজু রাষ্ট্রপতি দেখেছি। আবার তার বিপরীত উদাহরণও ভুরিভুরি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন এদেশের রাষ্ট্রপতি। অমন বিশাল হৃদয় মানুষের আসীন চেয়ারটিতে যে বা যারা বসেন, তাদের কাছে আমরা গণতন্ত্র, উদারতা, ন্যায় আর প্রজ্ঞা আশা করতেই পারি। আশা করি, নয়া রাষ্ট্রপতি সেদিকেই পা বাড়াবেন। নতুন রাষ্ট্রপ্রধানকে অভিনন্দন জানাই। ভরসা করি তার আমলে দেশে ন্যায্য অধিকার আর মানুষের সদিচ্ছার জয় হবে।