২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল না করে সংস্কারের সুযোগ ছিল। একটা যৌক্তিক হারে কোটা বহাল রাখলে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
Published : 08 Jul 2024, 01:53 PM
সরকারি চাকরিতে কোটা থাকা না-থাকার ইস্যুটি আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে যেন জীবন-মরণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালসহ কয়েকটি দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন এখন শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।
সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি চালুর ইতিহাসটি অবশ্য বেশ পুরনো। স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন শ্রেণির চাকরিতে কোটাব্যবস্থা চলে আসছিল। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র জন্য ৫ শতাংশ কোটা ছিল। পরে ১ শতাংশ কোটা প্রতিবন্ধীদের জন্যও নির্ধারণ করা হয়। কোটা ব্যবস্থা নিয়ে প্রবল আন্দোলন শুরু হয় ২০১৮ সালে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের অক্টোবরে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। এই আন্দোলনের কারণে ঢাকা শহরে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে সরকার কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। আন্দালনকারীরাও ক্রমেই চরম কর্মসূচির দিকে ঝুঁকছে।
কোটা নিয়ে সরকারের ভূমিকাও খুব একটা স্বচ্ছ নয়। এর আগে আন্দোলনের মুখে সরকার যখন পুরো কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে, তখন কিন্তু কোটা সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সরকার আন্দোলনকারীদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পুরো কোটাব্যবস্থাই বাতিল করেছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, নারী ও পিছিয়েপড়া জাতিগোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। ২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল না করে সংস্কারের সুযোগ ছিল। একটা যৌক্তিক হারে কোটা বহাল রাখলে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
উচ্চশিক্ষা আর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বা সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের দেশে স্পষ্ট দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। ‘আমরা’ আর ‘তারা’। যারা কোটা তুলে দেওয়ার পক্ষে, তারা মনে করেন যে, কোটাভুক্তরা যথেষ্ট যোগ্য না হয়েও পড়াশোনা বা চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন। ‘আমাদের’ মুখের গ্রাস ‘তারা’ কেড়ে নিচ্ছেন, মানে আমাদের চাকরির সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছেন। ‘গ্রাস’-টা যে শুধু আমাদেরই ছিল, অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরির প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু ‘আমাদের’ প্রতিনিধিদেরই দেখা যাবে, এটাই আমাদের সযত্নলালিত ধারণা, কারণ আমরাই যোগ্য। ‘তারা’ ‘আমাদের’ মতো যোগ্য হয়ে আমাদের সঙ্গে লড়ে চাকরি পাক। তাদের জন্য সংরক্ষণ নয়।
সাদা চোখে দেখলে এই দাবির মধ্যে কোনো দোষ খুঁজে পাওয়া যায় না। মেধার ভিত্তিতে লড়াই হবে, সেখানে যোগ্যরা বিবেচিত হবে, তাতে কারও কিছু বলার থাকবে না। যদিও বাস্তবে এটা ‘ন্যায্যতাপূর্ণ’ হয় না। কারণ যারা পিছিয়ে পড়া, তারা তথাকথিত মেধার দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না। কারণ তারা সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারেন না। স্কুলে তারা সমান সুযোগ পান না। অভাবের সংসারে বাবা-মাও পড়াতে পারেন না। তাই তারা ও-ধারেই থেকে যাবেন। যদি তা না হতো, তাহলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধি আজও এত কম হতো না। অর্থাৎ, তারা নিজেরা উঠে আসতে পারছেন না, আর আমরাও তাদের দেখতে চাইছি না। এই দুইয়ের ফল হলো তাদের অদৃশ্য রয়ে যাওয়া।
যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কয়েকটা কথা বলতেই হয়। শিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ শুধু ঢোকার পথটা একটু সহজ করে দেয়, বেরোনোটা কিন্তু একই রকম থাকে। সিলেবাস, চাকরিবিধি, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি একই রকম থেকে যায়। আমাদের দেশে বেকারত্বের চাপ অনেক বেশি থাকায় বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। সংরক্ষিত ছাত্রছাত্রীরা সেখানে হয়তো কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এর মাধ্যমে যে সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তি মজবুত হয়। পিছিয়ে পড়ারা এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। সমাজের সব গোষ্ঠীর লাভবান হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত হয়।
যোগ্যতা কোনো বায়বীয় পদার্থ নয় যে, তা এমনি এমনিই সবার মধ্যে গড়ে উঠবে, পরিবেশ ও আর্থসামাজিক অবস্থা ও অবস্থানের ওপর তা প্রায় সরলরৈখিকভাবে নির্ভরশীল। যে তথাকথিত যোগ্যতার অহমিকায় আমরা ডগমগ হয়ে থাকি, তা আদৌ শুধু ব্যক্তিগত মেধা বা দক্ষতা নয়, আমরা কে কতটা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, তার ওপরও নির্ভর করে। যে ছাত্র প্রতিটি বিষয়ে দুজন করে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া ছাত্রটির চেয়ে ‘যোগ্যতর’ হয়ে উঠেছেন, তাদের যোগ্যতা কি সত্যিই তুলনীয়? তা ছাড়া যে দেশে যেকোনো স্তরেই বিভিন্ন বোর্ড এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে শিক্ষা দেয় আর বিভিন্ন প্রাইভেট কলেজ থেকে ছাত্ররা শুধু আর্থিক সংগতির জোরে ‘প্রফেশনাল’ ডিগ্রি নিয়ে বেরোয়, সেখানে যোগ্যতার মাপকাঠিটা কোথায়? উচ্চমাধ্যমিকের এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীও কখনো কখনো বুয়েট-মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় আটকে যায়। আবার বিভিন্ন ‘কোচিং সেন্টার’-এর উদ্যোগে যে সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে মোটের ওপর সাধারণ ছাত্রও কঠিন পরীক্ষার বাধা টপকে যায়। সুতরাং, যোগ্যতা ব্যাপারটা অনেকটাই আপেক্ষিক।
বরং এটা মনে রাখা ভালো যে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি, প্রতিবন্ধী, নারী, পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর শিক্ষার্থী এবং পিছিয়ে থাকা নৃগোষ্ঠীসহ সংরক্ষিত প্রার্থীরা মোট জনসংখ্যার যত অংশ জুড়ে আছেন, তারা যদি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে পেতেন, তাহলে সর্বস্তরে প্রতিযোগিতা বেড়েই যেত, কমত না। একসময় শিক্ষা ও কাজের জগতে মেয়েরা অনুপস্থিত ছিলেন। তখন তো মেয়েদের অযোগ্য বলেই মনে করা হতো। কিন্তু আসল কথাটা হলো, তখন মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগই ছিল না। ধীরে ধীরে মেয়েরা সুযোগ পেয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলেন। প্রথমে কেউ ‘মেয়ে ডাক্তার’ কী ‘মেয়ে মাস্টার’-এর কাছে যেতেন না, কারণ মনে করা হতো মেয়েরা যথেষ্ট দক্ষ নন। অথচ, আজ মেয়েদের যোগ্যতা যে আসলে এক চুলও কম নয়, তা বলে দিতে হয় না। এই উত্তরণটা সম্ভব হয়েছে কেবল সুযোগ পাওয়াতেই। আগে যে মেয়েদের পাওয়া যেত না, সেটা যোগ্যতার অভাবে নয়, সুযোগের অভাবে।
এখানে অবধারিত প্রশ্ন ওঠে, সাধারণের মধ্যেও তো প্রচুর দরিদ্র মানুষ আছেন, যারা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্যও তো তাহলে সংরক্ষণ দরকার। কথাটা ভিন্নভাবে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। কেননা দারিদ্র্য নানাভাবে জয় করা যায় (আর্থিক সাহায্য, বৃত্তি, ঋণ ইত্যাদি)। কিন্তু দারিদ্র্যের পাশাপাশি সামাজিক অবস্থানও যাদের পিছিয়ে থাকার একটা কারণ, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সত্যিই আলাদা। অসীম দারিদ্র্য জয় করে উঠে আসাটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে একটা কৃতিত্ব যেটা সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের ক্ষেত্রে একটা স্পর্ধা হিসেবে দেখা হয়। আদিবাসী, নারী, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছাড়াও আরও বহু ধরনের সংরক্ষণ আমাদের চারপাশে কাজ করে। যে কোনো চাকরিতে যে বয়ঃসীমা থাকে, তাও এক ধরনের সংরক্ষণ। এর সুবিধা আমরা সবাই পাই, তাই এটা নিয়ে আপত্তি নেই। তারপর বিভিন্ন চাকরিতে আছে ‘রাজনৈতিক কোটা’, ‘ডোনেশান কোটা’ এবং শেষ অবধি ‘রিলেশন কোটা’, যার কোনোটাই প্রার্থীর যোগ্যতা বিচার করে না। মোটকথা, আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে বিভিন্ন ধরনের সমান্তরাল যোগ্যতা তৈরি হয় এবং তার জোরে নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেওয়াও চলে। সেসব বিষয়ে চুপ করে থেকে আমরা সরব হই শুধু একটি ক্ষেত্রে।
এর একটা কারণ হলো, চোখের সামনে আমরা এমন অনেক সাধারণ পদবির মানুষকে দেখতে পাই, যারা কোনোভাবেই তেমন পিছিয়ে পড়া নন, অথচ সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে তারা যোগ্যতার তুলনায় অনেক ভালো চাকরি জোগাড় করে ফেলেন। এটা নিঃসন্দেহে পদবিনির্ভর সংরক্ষণের একটা সীমাবদ্ধতা এবং এই ক্ষেত্রে অসংরক্ষিত প্রার্থীদের ক্ষোভটুকু হয়তো সম্পূর্ণ অসংগত নয়। তবে পরিসংখ্যানে একটু নজর রাখলেই বোঝা যাবে সংরক্ষিত সব গোষ্ঠীর তুলনায় আমাদের চোখে পড়া এই উদাহরণ নেহাতই নগণ্য। কোনো ব্যবস্থাই তো নিখুঁত হয় না। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দাবি যেমন অসংগত নয়, তেমনি আদিবাসী, নারী, প্রতিবন্ধী, পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের দাবিও অযৌক্তিক নয়। আসলে একটা সাধারণ নিয়মের মাধ্যমে সমাজের সব জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। হয়তো সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন বা সংশোধনের দরকার আছে। আর সংরক্ষণ-বিরোধিতার গোড়ায় আছে ‘রিলেট’ করতে না পারা এবং সমস্যার গভীরে না যাওয়া।
মানুষ আসলে নিজের জীবন ও পরিমণ্ডলের বাইরে নজর ফেলতে পারেন না, তাই যেটুকু নজরে পড়ে তার ভিত্তিতেই মন্তব্য করে। তবে যে ক্ষোভ প্রায় বায়ান্ন বছর ধরে জেগে আছে, শুধু নিন্দা করে, একতরফা আলোচনা করে বা ‘সবার জন্য এক রকম সুযোগ’ তৈরি করে তা মানুষের মন থেকে দূর করা যাবে না। বরং, যেকোনো বিরোধিতার মতোই কোটা বা সংরক্ষণ-বিরোধিতার কথাও শুনতে হবে, এবং কিছু যৌক্তিক পরিবর্তনও আনতে হবে। অচল কোটা সচল করতে হবে। ‘সামাজিক ন্যায়’ ও ‘ন্যায্যতা’ মেনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ যদি শিক্ষা ও কর্মধারার মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, সেটা ঠিক হতে পারে না। আর কেবল আদালতের দোহাই দিয়ে কিংবা আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সমস্যার সমাধান খোঁজাটা আত্মঘাতী হতে পারে।