চাকরিপ্রদানকারী সর্বোচ্চ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কিংবা চাকরি পাওয়া ও চাকরি করাকালীন সততার উপর থেকে দেশের তারুণ্যের এমন বিশ্বাসের সংকট তৈরি হওয়া দেশটির জন্য শুভ কিছু নয়, বরং ভীষণ ভয়ের।
Published : 10 Jul 2024, 06:23 PM
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারটি সামনে আসার পর, স্বাভাবিকভাবেই পিএসসির ভেতর-বাইরের যত ‘স্টেকহোল্ডার’ আছেন কিংবা গণমাধ্যম সবার কাছেই পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন এ নিয়ে কী বলবেন– তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাতির কাছেই। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেক কর্তাই চুপ মেরে যান, সামনে আসেন না। তবে তিনি এসেছেন, বেশ লম্বা সময় সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আমরা তা সরাসরি শোনার সুযোগ পেয়েছি।
‘ক্রাইসিস কমিউনিকেশনের’ তাত্ত্বিক ভাষায় প্রতিষ্ঠানের ‘ইমেজ ক্রাইসিসে’র সময় প্রতিষ্ঠানের এমন সর্বোচ্চ কর্তাকে সবার সামনে এসে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়। বলা হয়, তারা যেন নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন। সেদিক থেকে পিএসসি চেয়ারম্যান তার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব যথার্থই পালন করেছেন।
পিএসসি চেয়ারম্যান অনেক কিছুই বলেছেন, এমনকি বলেছেন, “সম্পৃক্ততা পেলে আমাকেও ‘ফায়ার’ করুন।” তবে সংবাদে যা আসেনি, তাতে খানিকটা নজর দেওয়া জরুরি মনে হলো। সংবাদ সম্মেলনের শেষদিকে এসে পিএসসি চেয়ারম্যান বললেন, “আমারও কিছু কথা আছে আপনাদের প্রতি। এই প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের দিকে লক্ষ লক্ষ তরুণ-যুবক তাকিয়ে আছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন এই প্রতিষ্ঠানে কোনো তদবির পর্যন্ত হয় না, নট ইভেন এ সিঙ্গেল ওয়ান। সেই প্রতিষ্ঠানটি যেন তার দায়িত্ব পালন করতে পারে সেই পর্যায়ের জন্য আমরা প্রত্যকের কাছে সমর্থন চাই। পাশাপাশি আমার কোনো সম্পৃক্ততা থাকলে আমাকেও ফায়ার করা হবে।”
তিনি লটারির পরীক্ষা যে কেবল আল্লাহই ভাল জানেন তা জোর দিয়ে বললেন, “আপনারা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন লটারির আগে কীভাবে সুনির্দিষ্ট পরীক্ষার প্রশ্ন বা সেট কীভাবে আসবে সেটা কীভাবে জানতে পারে। অনেকে প্রশ্ন নিয়ে প্রতারণার শিকার হন। অনেকে বোর্ডের প্রশ্নে মত অনুরূপ একটি প্রশ্ন করে, একটি প্রতারক চক্র সেগুলো বিক্রি করে টাকা কামাচ্ছে। সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের এজেন্সি আছে দেখবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সবার ওপরে, আমি আপনি না-ও থাকতে পারি কিন্তু এটি দেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান, অযথা যেন এই প্রতিষ্ঠানের সম্মান বা বিশ্বস্ততা নষ্ট না হয় এজন্য আমি সবার কাছে আবেদন করব।”
ক্রাইসিস কমিউনিকেশনে এমন ভাষা ঘটনার প্রতি মানুষের মনোভাব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ধরা পড়লে সেই প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা। কিন্তু পিএসসি চেয়ারম্যান এতগুলো প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ প্রায় অস্বীকার করে আল্লাহর দোহাই পর্যন্ত দিয়ে দিলেন। তিনি যখন এই সব কথা বলছিলেন, তখন তাদের গ্রেফতার হওয়া কর্মচারীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের প্রস্তুতি চলছিল। তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ড্রাইভারদের আকাশচুম্বি সম্পদের তালিকা দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, বড় আকারের দুর্নীতি হয়েছে। এরই মধ্যে গণমাধ্যম গোয়েন্দা সূত্র উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় সোমবার গ্রেফতার হওয়া ১৭ জনের মধ্যে ছয়জনের ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার বিষয়টি পিএসসির নিজস্ব তদন্তেই প্রমাণিত হয়েছিল। আর তাই ২০১৪ সালে চাকরিচ্যুত হন সৈয়দ আবেদ আলী। বরখাস্ত হয়েছিলেন খলিলুর রহমান। বদলি করা হয়েছিল জাহাঙ্গীর আলমকে।
তাহলে কেন পিএসসি অভিযোগের তালিকায় থাকা সবগুলো পরীক্ষা নিয়ে কোনো তদন্ত করবে না? সহজবোধ্য কারণ হচ্ছে, যতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার বাইরেও অনেকে রয়ে গেছেন– এমনটা ধারণা করার জন্য জ্যোতিষশাস্ত্র জানার দরকার নেই। ৫ জুলাইয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন জড়িত ছিলেন– এমনটাই জানা যাচ্ছে এখন। পিএসসির ভেতরের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত চক্রটিকে রক্ষা করার চেষ্টা চলছে বলে সন্দেহ করা হলে খুব অমূলক হবে।
পিএসসি চেয়ারম্যানের এই বক্তব্য শুনে মনে হলো বিসিএস প্রত্যাশীদের সঙ্গে আলাপ করা প্রয়োজন। তারা কী এই কথায় ভরসা পেলেন?
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী তাওহীদ হোসেন সানির সঙ্গে আলাপ হলো, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে আসার পর থেকে তার আর মনে হচ্ছে না আর বিসিএস দেওয়ার কোনো দরকার আছে। তার ভাষায়, “গত রাত থেকে আমার আর মনে হচ্ছে না বিসিএস দেওয়ার কোনো মানে হয়। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টা সামনে আসার পর বিশ্বাস উঠে গেছে, ত্রিশ হাজার টাকার একটা চাকরিতে কাউকে যদি লাখ লাখ টাকা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করে ঢুকতে হয়, তাহলে তো বাধ্য হয়ে অসৎ হতে হবে তার, ঘুষ-দুর্নীতি করতে হবে। এখন দেশের বাইরে যেখানে চলে যাওয়ার সুযোগ পাই চলে যাব। এটা শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু না।”
বিশ্বাস উঠে গেছে সানির। “আমাদের চাকরিপ্রার্থীদের যে বিশ্বাসের জায়গা ছিল সেখানে এখন দেখছি পুরোটাই ফাঁকি। দায়কে এখন অস্বীকারের কিছু নেই। পিএসসির চেয়ারম্যানের বক্তব্যে মনে হয় তারা পরোক্ষভাবে আগে যা ঘটেছে সেটা সমর্থন করছেন। তিনি বলছেন সামনে ঘটলে তিনি পরীক্ষা বাতিল করবেন, তবে আগেরগুলোতে বাতিল হলে তিনি কেন ব্যবস্থা নেবেন না।”
সানির মত এমন চাকরিপ্রার্থীদের এই যে আস্থার সংকট সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তৈরি হলো, প্রতিষ্ঠানের সম্মানের ব্যাপারে সচেতন চেয়ারম্যান তারুণ্যের এই মানসিক সংকট কীভাবে মেটাবেন তা কী ভাবছেন? তিনি বারবার তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কমিশনের কথা। বলেছেন কমিশনের সিদ্ধান্ত বোর্ডে হয়, এককভাবে নেওয়া হয় না। সেই বোর্ড কি ভাবছে, কীভাবে তারা এই বিশ্বাসের সংকট দূর করবেন।
তারুণ্যের এই বিশ্বাসের সংকটের আরও অনেক মাত্রা আছে। শুধু যে সরকারি কর্মকমিশন কিংবা প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারের পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়ে তারা বিশ্বাস হারিয়েছেন তা কিন্তু নয়। তারা মোটাদাগে বিশ্বাস হারিয়েছেন, দেশের উপর থেকে, বিশ্বাস হারিয়েছেন কর্মজীবনে সৎ হওয়া কিংবা সৎভাবে প্রতিযোগিতায় নামার উপর থেকেও।
পিএসসির প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে আসার পর থেকে সামাজিক মাধ্যম সয়লাব পিএসসির প্রশ্নফাঁসে অভিযুক্ত এক সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর ‘সৎ ও পরহেজগার’ জীবন-যাপন আর তার সন্তানের ‘মানবতা ফেরি’র বিজ্ঞাপনে। সেইসব পোস্ট, ছবি, ভিডিও আমাদের তরুণেরা শেয়ার করছেন। তাদের অনেকেই লিখছেন, “তবে ড্রাইভিং শিখলেই তো ভাল ছিল”, “জীবনে এমন ড্রাইভার হতে পারলেই চলবে”।
এইসব লেখা যে কেবল স্যাটায়ার, তা বললে, আমাদের তারুণ্য যে কর্মজীবনে সৎ থাকার ওপর থেকেও গভীর আগ্রহ হারিয়েছে তাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। পিএসসির এমন অল্প বেতনের সরকারি চাকরিজীবীর এমন বিলাসবহুল জীবন, চাকরিতে প্রবেশের জন্য অপেক্ষায় থাকা তারুণ্যের সামনে যেমন স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে, তেমনি তৈরি করে সামাজিক হতাশাও। চাকরিতে প্রবেশের সবচেয়ে প্রধানতম লক্ষ্যই থাকে আর্থিক সক্ষমতা অর্জন। সেখানে যদি আমরা হতাশা প্রকাশ করা সানির কথাতে ফিরে যাই কিংবা সামাজিক মাধ্যমে তরুণদের লেখার দিকে তাকাই, তবে বলতে হবে যেখানে আবেদ আলীরা কাগজে-কলমে গাড়িচালিয়ে আলিশান প্রাসাদ গড়েন, গাড়ি চড়েন, সমাজসেবার বিজ্ঞাপন দিয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন সেখানে তারুণ্য কীভাবে সততার সঙ্গে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা আর কর্মজীবনে সৎ থাকার প্রতি বিশ্বাস আর আশাটুকু জিইয়ে রাখবে? এই বিশ্বাসের সংকট সংস্কারে পিএসসি কী করবে?
তারুণ্য বিশ্বাস হারিয়েছে দেশের সিস্টেমের ওপর থেকেও। তারুণ্য সামাজিক মাধ্যমে লিখছে আইইএলটিএস-জিআরইর প্রশ্নও ফাঁস হয় কি না। তারা লিখছেন, তারা এই দেশে ক্যারিয়ার খোঁজার আগ্রহ হারিয়েছেন। কর্মজীবন থেকে শিক্ষাছুটি নিয়ে বিদেশে পড়তে আসার পর থেকেই অনেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফোনকল বা মেসেজ পেতাম, দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা জানতে চাইতেন। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আরাধ্য পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সংবাদ সামনে আসার পর থেকে তা দ্বিগুণ হয়েছে।
গতরাতে ফোন করে একজন প্রথম কথাটি বলেছেন, “দেশের যে অবস্থা, তিন চার বছর বেকার থেকে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেব সেখানেও যদি প্রশ্নফাঁস হয়ে যায় তবে আর দেশে থেকে লাভ কী! কীভাবে আসা যায় পরামর্শ চাই।” এই আসা কিংবা পরামর্শ চাওয়ার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। তবে হতাশা আছে, আছে দেশের চাকরিবাজার আর ভবিষ্যতের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট। কেননা, যারা আসতে চাইছেন তারা সবাই জানাচ্ছেন তারা ভিনদেশেই থিতু হয়ে যেতে চান, তারা ফিরতে চান না। তারা মনে করছেন, তাদের এই মেধার মূল্যায়ন দেশে নেই।
একটা দেশের সিস্টেম, চাকরিপ্রদানকারী সর্বোচ্চ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কিংবা চাকরি পাওয়া ও চাকরি করাকালীন সততার উপর থেকে দেশের তারুণ্যের এমন বিশ্বাসের সংকট তৈরি হওয়া দেশটির জন্য শুভ কিছু নয় বরং ভীষণ ভয়ের।
প্রতিষ্ঠানের সম্মানের সংকটে সবার কাছে সহযোগিতা চাওয়া পিএসসি চেয়ারম্যানকে, তাই এই তারুণ্যের আস্থার সংকট তিনি কীভাবে ফেরাবেন তা নিয়েও ভাবতে হবে। শুধু তিনি না পুরো পিএসসিকেই তা ভাবতে হবে।
যেসব বিসিএস ও অন্যান্য চাকরি পরীক্ষার ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে সেগুলোর ব্যাপারে যথাযথ ও পক্ষপাতহীন তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। যদি অভিযোগ সত্য হয় তবে এভাবে যারা চাকরি পেয়েছেন বা নিয়েছেন তাদের চাকরি বাতিল করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে জড়িতে পিএসসির ভেতর ও বাইরের, সাবেক ও বর্তমান প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনতে হবে।
পিএসসির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও সরবাহের পুরো প্রক্রিয়াকে পুনর্মূল্যায়ন করে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে তারুণ্যের বিশ্বাসের সংকট দূর করতে হবে।