Published : 26 Apr 2022, 11:21 AM
বাইবেলে বলা হয়েছে, সৃষ্টির প্রথমে ছিল 'শব্দ'। 'হও' বলেই নাকি ঈশ্বর সাত দিনে জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু যে আধুনিক সমাজ বা সভ্যতা আজ দেখছি আমরা, সেটি গড়ে তুলতে মরণশীল মানুষের কমপক্ষে গত দশটি হাজার বছর লেগেছে। আর যে কথাটি বলার জন্যে এ প্রবন্ধ, সেটি হচ্ছে, আধুনিক সভ্যতা গঠনের পেছনে অপরিহার্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে ইসলাম ধর্ম।
৫০০ খ্রিস্টাব্দে রোমের পতনের পর গ্রিক-রোমান জ্ঞানচর্চা থেকে ইউরোপ বিচ্যুত হয়েছিল। অন্ধকার যুগ চলেছিল প্রায় ৭০০ বছর, ১২০০ সাল পর্যন্ত। ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ (ধরা যাক, ঈশ্বরের ইচ্ছায়) আরব দেশে জন্ম নিলেন এক মহামানব হজরত মুহম্মদ (স.)। তিনি ইসলামের পতাকাতলে অসভ্য আরব বেদুঈনদের একতাবদ্ধ করলেন। নবীবংশের জাতশত্রু উমাইয়া বংশ আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে ইউরোপের স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্স পর্যন্ত দখল করে নিল। লুটপাট থেকে টাকা পয়সা যখন কিছু জমলো, তখন আরবেরা জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করলো, বাগদাদ এবং আন্দালুশিয়ায়। ইউরোপীয়রা সেই জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিল দুই ভাবে: প্রথমত, 'ক্রুসেড' করতে জেরুজালেম-সিরিয়া গিয়ে এবং দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রা করে আন্দালুশিয়ায় এসে।
এ জ্ঞানযজ্ঞে অপরিহার্য ভূমিকা রেখেছিল অনুবাদ। জ্ঞান দৈববাণী নয় যে, আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে সোজা মাথায় গিয়ে ঢুকে মহাপুরুষের মুখ দিয়ে বের হবে। মানুষকে পূর্বপুরুষের জ্ঞানের দধির সঙ্গে তথ্যের নতুন দুধ মিশিয়ে প্রশ্ন ও বিচারের দুই মন্থনদণ্ড দিয়ে প্রাণপণ ঘেঁটে জ্ঞানের ননী সৃষ্টি করতে হয়। সমস্যা হচ্ছে, নিজের পূর্বপুরুষ মূর্খ থাকতে পারে, আবার যে জাতি আজ শিক্ষিত, কালই সে জাতি মূর্খে পরিণত হতে পারে। 'চক্রবৎ পরিবর্ততে সুখানি চ, দুঃখানি চ।' সব জাতি সব যুগে জ্ঞানের সৃষ্টির লায়েক থাকে না। একেক জাতি, যেমন ভারতীয়, মিশরীয়, গ্রিক, রোমান, আরব নিজ নিজ স্বর্ণযুগে জ্ঞান সৃষ্টি করেছে। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে হলে, প্রথমে পূর্বে সৃষ্ট জ্ঞান অধিগত করতে হবে। নিজের মাতৃভাষায় পূর্বতন জাতির অর্জিত সব জ্ঞান অনুবাদ করে নেওয়া যেকোনও জাতির জন্য জ্ঞানচর্চায় অপরিহার্য একটি ধাপ।
একটি নতুন গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল তৎকালীন আরবে, বিশেষত আন্দালুশিয়ায়: 'মোজারাব'। ধর্মে এরা ছিল ইহুদি বা খ্রিস্টান, কিন্তু ভাষা-আচার-আচরণে ছিল আরব। মুসলিমরা মোজারাবদের উচ্চপদে নিয়োগ দিতেন এবং খুবই সম্মান করতেন। খ্রিস্টানরা স্পেন পুনর্দখল করার পরও ইউরোপে অনুবাদ ও জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন মিটাতে মোজারাবদের চাহিদা ছিল। তৎকালীন আরব সাম্রাজ্যে মুসলিম ও মোজারাবদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার প্রশ্নই ছিল না। মুসলিমরা জাকাত দিত, মোজারাবেরা দিত জিজিয়া কর। স্পেনে এখনও মোজারাব জনগোষ্ঠী এবং তাদের গির্জা আছে। ভারতবর্ষেও সুলতানি ও মোঘল যুগে যে সব হিন্দু উচ্চতর পদে নিয়োগ পেতেন, তারা ফার্সি জানতেন, মুসলমানি পোশাক-আদব-কায়দা রপ্ত করতেন। যেমন ধরুন, না চিনলে পিরালি বামুনের পোলা রবীন্দ্রনাথের জোব্বা পরা ছবি দেখে কে বলবে, তিনি একজন মুসলিম সুফি সাধক নন?
প্রধানত মোজারাবদের হাতে গ্রিক-লাতিন পাণ্ডুলিপিগুলো অনূদিত হয়েছিল আরবিতে। গ্রিক-লাতিন থেকে আরবিতে অনুবাদকর্ম চলেছে সাতশ বছর ধরে। আন্দালুশিয়া যখন জ্ঞানের শীর্ষে, তখন আরবি থেকে লাতিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, যাতে ইউরোপীয়রা পড়ে বুঝতে পারে। একাদশ-ত্রয়োদশ শতকে টোলেডো নগরে সৃষ্টি হয়েছিল বিখ্যাত 'টোলেডো অনুবাদ ঘরানা' বা 'টোলেডো স্কুল অব ট্রান্সলেশন'। এসব পাণ্ডুলিপি পড়েই একদিকে ইবনে সিনা, আল রাজি, আবু রুশদ, অন্যদিকে টাইকোব্রাহে, কোপার্নিকাস প্রমুখ বিজ্ঞানীর সৃষ্টি হয়েছিল।
দ্বাদশ শতকে ইউরোপে সরবোন-অক্সফোর্ড ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে কমপক্ষে চৌদ্দটি কারণ ছিল, যার একটি ছিল আরববিশ্ব থেকে শিখে আসা জ্ঞানের চর্চা। মনে রাখতে হবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল খ্রিস্টীয় গির্জা। এদিক থেকে দেখলে খ্রিস্টান ধর্ম আধুনিক সমাজ গঠনের দ্বিতীয় (বা প্রথম) গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। আরববিশ্বে জ্ঞানচর্চা হয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শুধু ইউরোপে, মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জ্ঞানচর্চা থেমে গেছে নবম শতকের আগেই। আন্দালুশিয়ায় পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জ্ঞানচর্চা চলমান ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। সেই যে জ্ঞানের মশাল হাতবদল হয়েছিল পুনর্জাগরণের অব্যবহিত পূর্বে, এখনও সেটা ইউরোপীয় হাতেই আছে। আরব বা মুসলমানেরা সেই মশাল পুনরায় হস্তগত করতে পারেনি শুধু নয়, হস্তগত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তাদের নেই। পক্ষান্তরে জাতি বা গোষ্ঠী হিসেবে হিন্দু এবং ইহুদিদের এই ক্ষমতাই কখনও ছিল না। ব্যক্তির কথা আলাদা এবং যেসব ইহুদি বিজ্ঞানীর নাম প্রাতঃস্মরণীয়, তাদের বেশিরভাগই নাস্তিক, যার মানে হচ্ছে, ইসরায়েলি ইতিহাসবেত্তা হারারির মতে, জ্ঞানচর্চায় ইহুদি জাতির উল্লেখযোগ্য কোনও অবদানই নেই।
যদি ইসলাম না আসতো, তবে পৃথিবীর ইতিহাস কেমন হতো? এই প্রশ্ন অবান্তর। যা হয়েছে, তা কীভাবে, কেন হয়েছে, সেটাই বিচার্য। আমার মনে হয়, মুহম্মদের (স.) যদি জন্ম না হতো, তবে আরবেরা অসভ্যই থেকে যেতো, অন্ততপক্ষে মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে (১০০০-১৫০০)। এই বিশেষ সময়ে আরবেরা অসভ্য থাকলে ইউরোপে মধ্যযুগের প্রথম পর্বে (৫০০-১০০০) হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান চিরতরে হারিয়ে যেতো। একটি যুগের, একটি জাতির জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব কোনো ঘটনা নয়। আমরা এখনও জানি না, মিশরের পিরামিড ঠিক কীভাবে নির্মিত হয়েছিল, অশোকের যুগের লৌহদণ্ডে জঙ পড়ে না কেন, কিংবা কীভাবে বানানো হতো গ্রেকোরোমান যুগের কংক্রিট। জ্ঞানের অভাবে ২০২১ সালেও অনেকের মানসিকতা যেমন মধ্যযুগে আটকে আছে, নবী মুহম্মদের (স.) জন্ম না হলে পৃথিবীর সব মানুষের মানসিকতা ওদের মতোই হতো।
এতে সমস্যা কী? সমস্যা আছে। আগামীকাল যদি আমরা জানতে পারি, একটি ধুমকেতু পৃথিবী ধ্বংস করতে এগিয়ে আসছে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যেই পৃথিবী ধ্বংস হবে, তবে গত ৫০০ বছরে জ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হবার বদৌলতে এই বিপর্যয় মোকাবিলার একটা উপায় আমরা হয়তো খুঁজে বের করতে পারি। আজ যদি এ ধরনের কোনও সমস্যার সম্মুখীন হন, তবে আপনি কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা সংস্থার শরণাপন্ন হবেন, নাকি হাটহাজারি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের কাছে যাবেন? উষ্ণায়নের কারণে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাবার কথা। খরা-বন্যা-দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হতে পারে যুদ্ধ, যেমনটা কিছু দিন পূর্বে হয়েছিল সিরিয়ায়। পাশ্চাত্যে পাঁচ শতাব্দী আগে জ্ঞানচর্চা শুরু হবার কারণে আমরা এসব সমস্যার এক বা একাধিক প্রযুক্তিগত সমাধান খুঁজে পেলেও পেতে পারি। আমাদের জ্ঞান যদি মধ্যযুগে পড়ে থাকতো, তবে কালিজিরা, থানকুনি পাতা খেয়ে এবং প্রার্থনা করেই সাম্প্রতিক কোভিড মহামারীর মোকাবিলা করতে হতো।
নবম শতকের আগেই সম্ভবত সুসভ্য আব্বাসীয় আরবরা পরাজিত হয়েছিল পর্বতবাসী অসভ্য তুর্কিদের হাতে। ১৪৫৩ সালে তুর্কিদের হাতে দখল হবার আগে কনস্ট্যান্টিনোপল ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। তুর্কি আক্রমণের কারণে কনস্ট্যান্টিনোপলের পণ্ডিতেরা পালালেন তাদের বইপত্র-পাণ্ডুলিপি নিয়ে ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিতে, যার অব্যবহিত ফল ইতালি এবং ইউরোপের পুনর্জাগরণ। কোনো দেশ থেকে একটা জনগোষ্ঠী যখন চলে যেতে বাধ্য হয়, তাদের যতটা না ক্ষতি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়, যে দেশ থেকে তারা পালায় সেই দেশের। যাই হোক, তুর্কিদের হাতে দখল হয়ে ইস্তাম্বুল হয়ে গেছে স্রেফ একটি টুরিস্ট স্পট। 'হায়া সোফিয়া' নামক হাজার দেড়েক বছরের পুরনো এবং জগদ্বিখ্যাত খ্রিস্টান গির্জাকে তারা সম্প্রতি আবার মসজিদে পরিণত করেছে, এই একুশ শতকে, যেন ইস্তাম্বুলে মসজিদের অভাব আছে। তুর্কিরা বুঝতেও পারছে না বিশ্বের কাছে ইসলাম এবং নিজেদের ভাবমূর্তিকে কীভাবে কালিমালিপ্ত করছে তারা। খ্রিস্টানেরা দখল করার পর আন্দালুশিয়াও অবশ্য আর জ্ঞানের কেন্দ্র থাকেনি। এই অঞ্চলটিও বহু দিন যাবৎ টুরিস্ট স্পট বটে। খ্রিস্টানেরাও যে বেশ কিছু মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করেছিল, সে কথাও মিথ্যা নয়। বিশ্বের সব ধর্ম, সব জাতির লোকেরাই ইতিহাসে কমবেশি নীচতা এবং অপদার্থতার প্রমাণ দিয়েছে।
লুটপাট করে তুর্কিরাও এক সময় শিক্ষিত হয়েছিল বটে, বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যও তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, কিন্তু দেশ জয়ে যতটা আগ্রহ ছিল তুর্কিদের, জ্ঞানচর্চায় ততটা নয়। আরব জাতির দেশজয়ের মশালটি সোৎসাহে তারা হাতে তুলে নিয়েছিল, কিন্তু জ্ঞানচর্চার মশালটি ফেলে রেখেছিল অনাদরে। সুতরাং যেভাবে হঠাৎ শুরু হয়েছিল, সেভাবে হঠাৎই একদিন শুকিয়ে গিয়েছিল আরবদের জ্ঞানচর্চার অভূতপূর্ব ধারা। গত অর্ধ সহস্রকের জ্ঞানচর্চায় তুর্ক-আরবদের অবদান নেই বললেই চলে, যার প্রমাণ, আপনার চারপাশের একটি বস্তুও তুর্ক-আরব জ্ঞানে নির্মিত হয়নি।
এর অন্যতম কারণ, আমার মতে, এক সময় আরবরা প্রশ্ন করার সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছিল। 'যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে।' আন্দালুশিয়া, বাগদাদে জ্ঞানচর্চা যখন বহমান-চলমান ছিল, মুসলিমদের যখন স্বর্ণযুগ ছিল, তখন ইসলামী সমাজ গ্রেকোরোমান জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে জেনেছিল। নিজেদের ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক গ্রেকোরোমান জ্ঞানের মোকাবিলা নিশ্চয়ই তারা 'চাপা' এবং 'চাপাতি' দিয়ে করেনি, প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর এবং প্রতিপ্রশ্ন দিয়েই করেছিল।
ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম সম্প্রদায় সফল এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে খ্রিস্টান নয়, ইহুদি নয়, হিন্দু নয়, শুধু মুসলিম এবং তাদের ধর্ম ইসলাম আধুনিক জ্ঞানচর্চায় কার্যকর প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। ইসলাম প্রবর্তিত না হলে বাগদাদে জ্ঞানের চর্চা কিংবা মোজারাব গোষ্ঠীর সৃষ্টি হতো না। মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্ম জ্ঞানচর্চায় বাধা দিয়েছে, কিন্তু ইসলামের উপর এই অপবাদ দেওয়া যাবে না। হারারির মতে, ইহুদি কিংবা হিন্দু ধর্ম কাউকে বা কিছুকে বাধা দেবার মতো ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতেই কখনও ছিল না।
পুনর্জাগরণ ও শিল্পবিপ্লব সফল হয়ে পৃথিবী আধুনিক যুগে প্রবেশ করার জন্য নবী মুহম্মদ (স.) এবং মুসলিমদেরই কি ধন্যবাদ দিতে হবে? হ্যাঁ এবং না। হারারি যেমনটা বলেন, বিজ্ঞানে আইনস্টাইনের অবদানের জন্যে আমরা ওনার মাকে ধন্যবাদ দিতেই পারি, কারণ তিনি রত্নগর্ভা। কিন্তু আমরা এও জানি, আইনস্টাইনকে জন্ম দেওয়ার চেয়ে খুব বেশি কিছু তিনি করেননি।
ইসলাম ধর্ম সভ্যতার অগ্রগতিতে অপরিহার্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে- এ দাবির সমর্থনে উপরে যে যুক্তিগুলো দিয়েছি, সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবার সম্ভাবনা আছে এ কারণে যে, এই যুক্তিগুলোর ভিত্তি বাহ্যিক প্রমাণ বা এক্সটারনাল এভিডেন্স। এই একই দাবি যদি আমি জাকির নায়েকের মতো স্রেফ কোরান ও হাদিসের ভিত্তিতে করতাম, তবে সেটা হতো 'চক্রাবর্ত যুক্তি' বা 'সার্কুলার রিজনিং'। 'সব কিছু ব্যাদে আছে', এই কথা নিছক বেদে লেখা থাকার কারণেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাহ্যিক প্রমাণ দরকার। আবার ধরা যাক, ইলিয়াডের একটি বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্যে আমি যদি মহাভারত থেকে আমি উদ্ধৃতি দিই, সেই যুক্তিবিন্যাসও গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ ইলিয়াড এবং মহাভারত দুটিই কবির কল্পনার ভিত্তিতে রচিত সাহিত্য, যাচাইকৃত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা ইতিহাস নয়। একইভাবে, জাকির নায়েক বা বেশির ভাগ ধর্মীয় বক্তা যেমনটা করে থাকেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, এক ধর্মগ্রন্থের তথ্য উদ্ধৃত করে অন্য ধর্মগ্রন্থকে সঠিক প্রমাণ করা যায় না।
যে কোনো ধর্মীয় বক্তার বক্তৃতা এ ধরনের চক্রাবর্ত যুক্তিবিন্যাস বা সার্কুলার রিজনিং- এ ভরপুর। যে কোনো আদালতে কিংবা গবেষণাকর্মে এই ধরনের যুক্তি পত্রপাঠ খারিজ হবে। বাইবেলের আদম-হাওয়ার কাহিনী, বোরাকে চড়ে সাত আসমানে ভ্রমণ, হনুমানের এক লাফে কন্যাকুমারী থেকে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে উপস্থিত হওয়া- এসব কাহিনীর সমস্যা হচ্ছে, এগুলোর সমর্থনে কোনো এক্সটারনাল এভিডেন্স বা নিরপেক্ষ-বহিরাগত প্রমাণ নেই। ধর্মপুস্তকে লেখা থাকা ছাড়া আর কোনোভাবে এই কাহিনীগুলো প্রমাণিত নয়। এই সব কাহিনী এবং যে কোনো ধর্মের বেশির ভাগ দাবি সার্কুলার বা চক্রাবর্ত যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
ধর্মীয় বিদ্যালয়গুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে, এসব বিদ্যালয়ে চক্রাবর্ত যুক্তির অসারতা এবং বাহ্যিক যুক্তির অপরিহার্যতার দিকে কখনই শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় না। ধর্মীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের বক্তৃতা শুনে ধর্ম ও বিচার শেখে দেশের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোকজন। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে আমাদের দেশের লোকজন সার্কুলার রিজনিং- এর অসারতা এবং এক্সটারনাল এভিডেন্সের অপরিহার্যতা বুঝতে পারে না বলে ভুল বোঝে এবং অতি সহজেই তাদের উত্তেজিত করে তোলা যায়। তরুণেরা যে জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করতে শুরু করে, উপযুক্ত শিক্ষার ঘাটতিই তার মূল কারণ।
ডারউইনের বিবর্তনবাদ এক্সটারনাল এভিডেন্স বা নিরপেক্ষ-বহিরাগত প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। ম্যামথের আগের যুগে আজকের হাতির জীবাস্ম পাওয়া যায়নি। হোমো সাপিয়েন্সের এমন কোনো ফসিল পাওয়া যায়নি যেটা হোমো ইরেক্টাসের চেয়ে পুরনো। যদি কখনও তেমন ফসিল পাওয়াও যায়, তবে বিবর্তনবাদ ঢেলে সাজানো যাবে, বিজ্ঞানে এটা সম্ভব এবং এটাই দস্তুর। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সত্য প্রমাণিত হতে পারে না, শুধু মিথ্যা বা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। যতক্ষণ ভুল প্রমাণিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু তত্ত্বটি সত্য।
পক্ষান্তরে আদম-হাওয়ার কাহিনী বা হনুমানের এক লাফে শ্রীলঙ্কা যাবার কাহিনী ভুল হবার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বাসীদের কাছে এইসব কাহিনী শুধু সত্যই হতে পারে, কারণ তাদের বিশ্বাস, ধর্মের প্রতিটি কথা সত্য। ধর্মের কোনো কথা যদি মিথ্যাও প্রমাণিত হয়, তবে বিশ্বাসীরা মনে করেন, সেটা মানুষের বুঝবার এবং বোঝাবার ভুল। এ কারণে আমি মনে করি, অন্ধবিশ্বাস বলে কিছু নেই, বিশ্বাস মাত্রেই অন্ধ হতে বাধ্য, কারণ যে কোনো বিশ্বাসীকে চোখ বন্ধ রাখার ধনুকভাঙা পণ করতেই হয়।
প্রাসঙ্গিক একটি কাহিনী দিয়ে প্রবন্ধ শেষ করা যাক।
১৪৯০ সালের আন্দালুশিয়া। গ্রানাডার আদালতে একদিন বিচারকার্য চলছিল। কাজির নাম জাহিদ বিন জাফর। তিনি একজন মোজারাব। মোজারাবেরা ধর্মে খ্রিস্টান, ভাষা-আচার-ব্যবহার-পোশাকে আরব। বাদি সাদ বিন মতুর্জা একজন মুসলিম। তার অভিযোগ, আলহামরা প্রাসাদের সম্মুখ থেকে তার ঘোড়াটি চুরি করেছে ইহুদি আলতাফ ইবনে ইছাক, কারণ খলিফার পুলিশ ঘোড়াটি ওর আস্তাবলেই খুঁজে পেয়েছে।
আলতাফ: হুজুর, ঘোড়াটি আমি চুরি করিনি। আজফার ইবনে এখলাস ঘোড়াটি চুরি করে আমার আস্তাবলে রেখে এসেছে।
সাদ: হুজুর, আলতাফের কথা সর্বৈব মিথ্যা।
কাজি: আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন যে ওর কথা মিথ্যা?
সাদ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস, আজফার ঘোড়া চুরি করতেই পারে না, কারণ সে একজন মুসলিম। পক্ষান্তরে আলতাফ একজন ইহুদি! আমাদের ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, ইহুদিরা লোক ভালো নয়।
কাজি: কীভাবে আপনি এমন সাক্ষ্য দেবেন? আপনি কি নিজের চোখে আলতাফকে ঘোড়া চুরি করতে দেখেছেন? অন্য কেউ কি দেখেছে?
সাদ: সাক্ষ্য দেবার জন্যে স্বচক্ষে দেখার প্রয়োজন নেই হুজুর। আল্লাহকে কোনো মুয়াজ্জিন দেখেননি, রসুলকেও নয়। অথচ আজান দেবার সময় তারা কি প্রতিদিন পাঁচ বার বলেন না যে 'আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই এবং মুহম্মদ (স.) তাঁর প্রেরিত রসুল?'
আদালতে পিনপতন স্তব্ধতা। কেউ কিছু বলতে পারছে না, কারণ কিছু বলা মাত্রই ধর্ম অবমাননা হবে। কাজি জাহিদ এবং বিবাদী আলতাফের মুখে কুলুপ, কারণ তাদের একজন মোজারাব, অন্যজন ইহুদি। সাদই নীরবতা ভঙ্গ করে।
সাদ: যে পুস্তকের উপর হাত রেখে বিচারের আগে সত্য বলার শপথ করেছি, হুজুর, তাতে বিশ্বাসকে সত্য বলে দাবি করা হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমি সত্য বলছি। এই ইহুদিই দোষী!
যুক্তি অকাট্য। এরপর থেকে গ্রানাডার খলিফা দ্বাদশ মুহম্মদ কোনো মোজারাব বা ইহুদিকে গ্রানাডায় কাজির আসনে বসানোর ঝুঁকি নেননি। কিছুদিন পরেই অবশ্য মুসলিমদের সামরিক দুর্বলতা এবং অর্ন্তকোন্দলের সুযোগ নিয়ে স্পেনের রানি ইসাবেলা গ্রানাডা দখল করে নেয়। যুদ্ধের ডামাডোলে ঘোড়ার সেই মামলার নতুন কোনো তারিখ পড়েনি।
অধিকাংশ ধর্মীয় বক্তা সাদ বিন মর্তুজার মতো সওয়াল করে এবং তাদের শ্রোতারা ধর্মীয় উন্মাদনায় এবং নিজেদের অজ্ঞতাবশত সেগুলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে। চারপাশে অন্য যারা সত্য দেখতে পায়, প্রাণ কিংবা ক্ষমতা হারাবার ভয়ে কাজি সাহেব এবং আলতাফের মতো মুখে কুলুপ দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে ক্ষতি হয় কিন্তু ইসলামেরই। ইসলামের যে মহত্ব প্রকৃতই স্মরণযোগ্য, তা মানুষের অগোচরে থেকে গিয়ে অনর্থক ইসলামের একটা নঞর্থক ভাবমূর্তির সৃষ্টি হয়।